তিন দশক আগে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আঞ্চলিক সমন্বয়ের স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট সার্ক। নানা কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে খুঁড়িয়ে চলছে জোটটি। সামনের দিনগুলোতে এটি টিকিয়ে রাখা অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। কারণ, সার্কের তহবিলে টান পড়ার ‘শঙ্কা’ দেখা দিয়েছে।
 
সার্কের তহবিলে যে পরিমাণ অর্থ আছে তা দিয়ে চলতি বছর পার করা গেলেও আগামী বছর কীভাবে এর কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে তা নিয়ে সংশয়ে আছেন সংশ্লিষ্টরা।
 
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ে বৈঠক না হলেও সার্কের ফাংশনাল কর্মকাণ্ড চলমান। আফগান (আফগানিস্তান) পরিস্থিতির কারণে কিছুদিন ধরে সার্কের ফাংশনাল বা গভর্নিং বডির কার্যক্রমে কিছুটা ভাটা পড়েছে। আলাপ-আলোচনা স্থগিত রয়েছে। নীতিনির্ধারক মহল থেকে কোনো পদক্ষেপ বা দিকনির্দেশনা না নিলে জোটটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন চলে আসবে। 

জোটটি বর্তমানে যেভাবে চলছে সেটি ধরে রাখতেও অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু সার্ক তহবিলে যে অর্থ রয়েছে তা দিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা যাবে। হয়তো আরও মাস-চারেক টেনেটুনে চলা সম্ভব, এরপর…

জোটটি বর্তমানে যেভাবে চলছে সেটি ধরে রাখতেও অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু সার্ক তহবিলে যে অর্থ রয়েছে তা দিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা যাবে। হয়তো আরও মাস-চারেক টেনেটুনে চলা সম্ভব, এরপর…। 


 
নাম প্রকাশ না করে মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছয় বছর সার্কের সম্মেলন হচ্ছে না। তবে ফাংশনাল বা গভর্নিং বডি পর্যায়ে আমাদের কাজগুলো হচ্ছিল। মিটিং নিয়মিত হচ্ছিল, আমরা চাঁদাও দিচ্ছি। হয়তো কাজটা ধীরগতিতে হচ্ছে। তবে নতুন দিকনির্দেশনা আসছে না। শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ে সম্মেলন বা বৈঠক হচ্ছে না। আফগানিস্তান পরিস্থিতির কারণে চলমান প্রক্রিয়া বা সার্কের গভর্নিং বডির যে মিটিং হয় সেটির এখন কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একটা আনফোল্ড অবস্থা!
 
সার্কের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ চলছে না। বাজেট চালু না থাকলে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম তো চালানো যাবে না। কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হবে। অফিস চালাতে গেলে, প্রোগ্রাম চালাতে গেলে তো অর্থ দরকার— বলেন ওই কর্মকর্তা। 

শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ে সম্মেলন বা বৈঠক হচ্ছে না। আফগানিস্তান পরিস্থিতির কারণে চলমান প্রক্রিয়া বা সার্কের গভর্নিং বডির যে মিটিং হয় সেটির এখন কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামসের ভাষ্য, অর্থ সংকটে পড়বে না সার্ক। অন্তত সদস্য রাষ্ট্রগুলো যতদিন চাঁদা নিয়মিত দিয়ে যাবে ততদিন অর্থের সংকট হবে না। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চাঁদা রেগুলার হলে সংগঠন থাকবে। তবে চাঁদা দেওয়া যদি বন্ধ হয়ে যায় সেটা আলাদা কথা। প্রোগ্রামগুলো চালানোর জন্য যে বাজেট অ্যাপ্রুভাল হয় সেটা না থাকলে প্রোগ্রামগুলো কনটিনিউ করা যাবে না, এটাই সমস্যা।’
 
‘কোভিড পরিস্থিতির কারণে গত দেড় বছরে কোনো মিটিং হয়নি। আফগানিস্তান ইস্যুটিও সামনে আসল। সমস্যা হচ্ছে, আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্ব কে করবে? তালেবান থেকে আসতে পারে, তবে তাদের তো জনগণের একটা ম্যান্ডেট নিয়ে আসতে হবে। আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে ঝামেলা রয়েছে।’ 

এদিকে, সার্কের বর্তমান অবস্থার জন্য ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের তিক্ততা দায়ী— এমনটি মনে করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘সার্কের অনেকগুলো ইনস্টিটিউশন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এর প্রসেস খুবই স্লো। ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের তিক্ততার কারণে এটি হয়েছে। বড় দুটি দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হলে সার্কেরও অবস্থান পরিবর্তন হবে, শক্তিশালী হবে জোট। তাদের মধ্যকার তিক্ততা যদি দূর হয় তখন কোনো সমস্যাই থাকবে না। এটি না হলে বিভিন্ন বাধার মুখে পড়বে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক এ জোট ।’ 


 
বিশ্লেষকরাও বলছেন, সার্কের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতা। এ দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্কের রাজনৈতিক যে অনিশ্চয়তা তা সার্কের উন্নয়নযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এতে জোটটি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পাশাপাশি বাকি ছয়টি সদস্য রাষ্ট্র তাদের কূটনৈতিক নীতি বাস্তবায়নের সুযোগ হারাচ্ছে। 

সার্কের গত কয়েক বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুই বড় রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের পরস্পর-বিরোধী মনোভাব বা দ্বন্দ্ব সার্কের ধীরগতি অর্থাৎ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার মূল কারণ। সবশেষ, ২০১৪ সালে নেপালে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আর কোনো সম্মেলন হয়নি। এমনকি সার্কের মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ের বৈঠকও অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। সদ্য সমাপ্ত জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনের ফাঁকে নিউ ইয়র্কে প্রস্তাবিত সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকও বাতিল হয়।
 
মূলত, আফগানিস্তানকে ভার্চুয়ালি বৈঠকে রাখায় এটি বাতিল হয়। কারণ, তালেবান সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে পাকিস্তান ছাড়া বৈঠকে বসতে রাজি ছিল না সদস্য রাষ্ট্রগুলো।
 
যদিও মাঝে মহামারি মোকাবিলায় বড় আশাজাগানিয়া বার্তা আসে ভারতের পক্ষ থেকে। দেশটি করোনা মোকাবিলায় সার্কের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব দেয়। এ নিয়ে সার্কের শীর্ষ নেতারা মিলিত হন ভার্চুয়াল বৈঠকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ওই বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে ও আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি যুক্ত হন। পাকিস্তানের পক্ষে দেশটির স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জাফর মির্জা আলোচনায় অংশ নেন।
 
শীর্ষ নেতাদের ওই বৈঠক থেকে বিশেষ তহবিল গঠনের মাধ্যমে কোভিড মোকাবিলার বার্তা আসে। নেতারা যার যার অবস্থান থেকে তহবিলে অর্থ দেওয়ার ঘোষণা দেন। সেই তহবিল থেকে সার্কের দেশগুলো একে-অন্যকে করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার সরঞ্জামসহ ওষুধ-সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করেছে। বিশেষ তহবিল থেকে সহযোগিতার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ না হলেও বর্তমানে কার্যক্রমটি বন্ধ। মূলত টিকার পর্যাপ্ততার কারণে এটি স্থগিত হয়ে যায়। 


 
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্কের ভবিষ্যৎ কী— জানতে চাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের কাছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সার্ক দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এখনও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজ সার্কের যে অবস্থা, এটি মূলত তৈরি হয়েছে ভারত-পাকিস্তানের জন্য। ১৯৮৫ সাল থেকে শুরু করে আজ অবধি দেশ দুটির সম্পর্কের মধ্যে যে অবিশ্বাস, অনিশ্চয়তা; বিভিন্ন সময়ের দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ শুধু এ জোটকে নয়, এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এতে সার্কের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আঞ্চলিক শান্তিও বিনষ্ট হচ্ছে। সার্কের বাকি সদস্যদের মধ্যে কূটনৈতিক রীতিও সেভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।’ 

‘এটি বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান বা মালদ্বীপের সমস্যা না; আফগানিস্তানের পরিস্থিতি না হয় এখন অন্যদিকে গেছে…। একটি অঞ্চলের শক্তিশালী দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার অবিশ্বাস ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে, নিজেদের উজ্জীবিত করতে পারলেই সার্ককে আরও সামনে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। এতে জোটের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তাও কাটবে‘—  যোগ করেন এ কূটনৈতিক বিশ্লেষক।
 
দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং নিজেদের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির দর্শন নিয়ে ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করে সার্ক। ওই বছরের ৭ থেকে ৮ ডিসেম্বর ঢাকা সম্মেলনের মাধ্যমে জোটটি সাংগঠনিক কাঠামো পায়। এর সদর দপ্তর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অবস্থিত।
 
এখন পর্যন্ত সার্কের ১৮টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সবশেষ, ২০১৪ সালে নেপালে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৬ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানে সার্কের ১৯তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের উরির সেনাঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে সম্মেলন বয়কট করে ভারত। ভারতের সঙ্গে যোগ দেয় বাংলাদেশ, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। এরপর থেকে মোটামুটি অকার্যকর দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনাময় এ সংস্থা।
 
এনআই/এইচকে