করোনা মহামারির ছাপ ছিল চলতি বছরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের পাঁচ অধিবেশনেও। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী মহামারি ছড়িয়ে পড়লে সীমিত পরিসরে সংক্ষিপ্ত অধিবেশন আয়োজন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতা ছিল এ বছরেও। সীমিত সংখ্যক সংসদ সদস্য করোনা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই অংশ নিয়েছেন অধিবেশনে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। সাধারণত কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে অধিবেশনের মেয়াদ ঠিক করা হয়।

জাতীয় সংসদের সরকার দলীয় হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ২০২০ এবং ২১ সাল জাতীয় সংসদ পরিচালনা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল। কিন্তু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার মতো পবিত্র দায়িত্ব এবং সংবিধান প্রদত্ত কার্যাবলী সম্পাদনে আমাদের জাতীয় সংসদ বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করেনি। সম্ভবত ২০২০ সালে করোনার ভয়াবহতার মধ্যে সমগ্র বিশ্বে প্রথম আমাদের সংসদ অধিবেশন করে এপ্রিল মাসে। 

তিনি বলেন, প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে সংবিধান সমুন্নত রেখে সব সংসদ সদস্যদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে একাধিক টিমে বিভক্ত করে রেশনিং পদ্ধতি চালু এবং করোনা টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়। অধিবেশনগুলো তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত হলেও প্রত্যেকটি কাজ সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়েছে। সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রচুর লিখিত বিষয়াবলী টেবিলে উপস্থাপিত হয়েছে। বিরোধী দলের সম্মানিত সদস্যরা নানা ইস্যুতে কথা বলেছেন। 

একাদশ অধিবেশন
সাধারণত বছরের প্রথম অধিবেশন দীর্ঘ হলেও চলতি বছরের প্রথম অধিবেশনটি ছিল ১২ কার্যদিবসের। গত ১৮ জানুয়ারি শুরু হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশনটি মুলতবি হয় ২ ফেব্রুয়ারি। শুরুর দিন সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সংসদে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে তার ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব আনেন প্রধান হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী। মহামারিকালে পুরো অধিবেশন জুড়েই সংসদ সদস্যরা ওই ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করেন। 

সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৩২ জন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ২৫ ঘণ্টা ২৫ মিনিট আলোচনা করেন। এ অধিবেশনে পরীক্ষা ছাড়াই এসএসসি ও এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশে পৃথক তিনটি আইনসহ ৬টি বিল পাস হয়। কার্যপ্রণালি-বিধির ৭১ বিধিতে ৪৬টি নোটিশ পাওয়া যায়। যার মধ্যে একটিও আলোচনায় আসেনি। প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দেওয়ার জন্য মোট ৮৪টি প্রশ্ন পাওয়া যায়, এরমধ্যে তিনি ২৮টি প্রশ্নের উত্তর দেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের উত্তর দেওয়ার জন্য মোট এক হাজার ৬৮৯টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। যার মধ্যে মন্ত্রীরা উত্তর দিয়েছেন ৮২০টির। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালাতে মহামারিকালের অন্য চারটি অধিবেশনের মত বছরের প্রথম অধিবেশনে সীমিত সংখ্যক সংসদ সদস্য অংশ নেয়। প্রথম দিন করোনাভাইরাস পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়া সংসদ সদস্যরা অংশ নেন। এরপর প্রতি কার্যদিবসে সর্বোচ্চ ৯০ জনকে পর্যায়ক্রমে আমন্ত্রণ জানানো হয়। 

দ্বাদশ অধিবেশন
গত বছরের ১ এপ্রিল শুরু হয়ে তিন কার্যদিবসে শেষ হয় একাদশ সংসদের দ্বাদশ অধিবেশন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মহামারিকালের অন্য অধিবেশনগুলোর মত সীমিত সংখ্যক সংসদ সদস্য অংশ নেয়। তালিকা ধরে করোনাভাইরাস পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়া সংসদ সদস্যরা অংশ নেন। সংক্ষিপ্ত এ অধিবেশনে পাঁচটি সরকারি বিল উত্থাপন করা হয়। গত ১৫ মার্চ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এ অধিবেশন আহ্বান করেন। এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি শেষ হয় সংসদের একাদশ অধিবেশন। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী সংসদের দুইটি অধিবেশনের মধ্যে ৬০ দিনের বেশি বিরতি থাকার সুযোগ নেই। যে কারণে এ অধিবেশন ডাকতে হয়েছে।

বাজেট অধিবেশন
চলতি বছরের ৩ জুলাই মুলতবি হয় জাতীয় সংসদের ত্রয়োদশ অধিবেশন। মহামারিকালের দ্বিতীয় বাজেট অধিবেশন। এর আগে গত ২ জুন অধিবেশন শুরু হয়েছিল। গত ৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল ২০২১-২২ অর্থ বছরের জন্য ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। যা গত ৩০ জুনে পাস হয়। দুই দিন আলোচনা করে চলতি ২০২০-২১ অর্থ বছরের সম্পূরক বাজেট পাস হয়। সপ্তাহখানেক বিরতি দিয়ে টানা চার দিন ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনা চলে। এরপর আরও ১০ দিন বিরতি দিয়ে দুই দিন বাজেটের ওপর আলোচনা হয়। সব মিলিয়ে ৮৫ জন সংসদ সদস্য বাজেটের ওপর আলোচনা করেন। সম্পূরক বাজেটসহ বাজেটের ওপর ছয় দিনে ১৫ ঘণ্টা ৩২ মিনিট আলোচনা হয়। এর আগে ২০২০ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত বাজেট অধিবেশন হয়েছিল। নয় দিনের ওই বাজেট অধিবেশনে ১৮ জন সংসদ সদস্য ৫ ঘণ্টা ১৮ মিনিট আলোচনা করেছিলেন।

মহামারির মধ্যে অনুষ্ঠিত অন্য অধিবেশনগুলোর মত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংসদ চলে। এক্ষেত্রে কোভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ থাকা সংসদ সদস্যরাই অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। প্রতিদিন ১০০-১২০ জন সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে বসে সংসদ।

চতুর্দশ অধিবেশন
চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর মুলতবি হয় একাদশ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশন। দুইজন সংসদ সদস্য মারা যাওয়ার কারণে দুই দফা মুলতবি করা হয়। সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফের মৃত্যুতে প্রথমদিনের বৈঠক এবং হাসিবুর রহমান স্বপনের মৃত্যুতে পরদিন ২ সেপ্টেম্বরের বৈঠক মুলতবি করা হয়। টানা নয় দিন বিরতির পর ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদ বসলেও জাতীয় পার্টির (জাপা) সংরক্ষিত আসনের এমপি অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী মারা যাওয়ায় সংসদের রীতি অনুযায়ী এদিন অন্যান্য কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। শোক প্রস্তাবের আলোচনার পর মুলতবি হয় সংসদ।

ওই অধিবেশন মাত্র চার কার্যদিবস চালিয়ে ৪ সেপ্টেম্বর শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও সংসদে শোকপ্রস্তাব গ্রহণের কারণে সেটা বাড়াতে হয়। তিনটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে স্পিকার ৫ সেপ্টেম্বরে অস্ট্রিয়া যাওয়ার কর্মসূচি থাকার কারণেই মুলত বিরতি দেয়া হয়। এই অধিবেশনে কার্যদিবস ছিল সাতটি। নয়টি বিল পাস হয়। চারটি সংসদীয় স্থায়ী তাদের প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপিত হয়। ৭১ বিধিতে ৩১টি নোটিশ পাওয়া যায়, যার মধ্যে একটিও আলোচনা হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দেওয়ার জন্য মোট ২৪টি প্রশ্ন পাওয়া যায়, যার মধ্যে তিনি জবাব দেন ১৬টির। অন্যমন্ত্রীদের জন্য প্রশ্ন জমা পড়ে ৫৮৪টি। মন্ত্রীরা ৩৮৯টি প্রশ্নের জবাব দেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে মহামারিকালের অন্য অধিবেশনগুলোর মত সীমিত সংখ্যক সংসদ সদস্য অংশ নেন। করোনাভাইরাস পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়া সংসদ সদস্যরাই সংসদের বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। করোনাভাইরাসের কারণে শুক্রবারও জাতীয় সংসদের বৈঠক বসে।

পঞ্চদশ অধিবেশন
চলতি বছরের ২৮ নভেম্বর মুলতবি হয় বছরের শেষ পঞ্চদশ অধিবেশন। গত ১৪ নভেম্বর শুরু হওয়া অধিবেশন একজন সংসদ সদস্য মারা যাওয়ার কারণে একবার মুলতবি করা হয়। শেষ হওয়া অধিবেশেনের কার্যদিবস ছিল নয়টি। ৯টি বিল উত্থাপন হয়েছে। পাস করা হয়েছে নয়টি বিল। ৭১ বিধিতে ৪২টি নোটিশ পাওয়া যায়, যার মধ্যে একটিও আলোচনা হয়নি। এগুলোর লিখিত জবাবও দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দেওয়ার জন্য মোট ৪১টি প্রশ্ন পাওয়া এসেছিল এর মধ্যে তিনি জবাব দেন ১০টির। অন্য মন্ত্রীদের জন্য প্রশ্ন জমা পড়ে ১ হাজার ১২টি। তার মধ্যে ৫৬৬টি উত্তর তারা দিয়েছেন। যেগুলোর উত্তর টেবিলে উপস্থাপিত হয়েছে।

ইউনেস্কো কর্তৃক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর দ্য ক্রিয়েটিভ ইকোনোমিকস’ প্রবর্তন করায় সংস্থাটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে কার্যপ্রণালি বিধিরি ১৪৭ বিধিতে সাধারণ আলোচনা হয়। এটি জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবটি এনেছিলেন প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে একটি বিশেষ আলোচনার আয়োজন করা হয়।

আলোচনার শুরুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বক্তৃতা করেন। এজন্য রাষ্ট্রপতি সংসদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান স্পিকার। তিনি বলেন, এ প্রস্তাব সাধারণ উত্থাপন করেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। তিনি তার বক্তব্য রাখেন। এ প্রস্তাবের ওপর ২৪ ও ২৫ নভেম্বর বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ৫৯ জন সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। ১০ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের আলোচনা পরে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতমতে প্রস্তাব সাধারণ গ্রহণ করা হয়।

এইউএ/এসএম