নিরিবিলি পরিবেশ, বাইরে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের সাইনবোর্ড। অনেকেই মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির জন্য আসতেন সেখানে। কিন্তু ভেতরের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ভেতরে রোগীদের ওপর চালানো হতো নির্যাতন। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আড়ালে মাদক ব্যবসা, রোগীদের শারীরিক নির্যাতন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় ভর্তি রেখে অর্থ আদায় এবং অনৈতিক কার্যক্রম চলত গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে। শুধু তাই নয়, পুনর্বাসন কেন্দ্র হলেও প্রতিষ্ঠানটির মালিক থেকে কর্মচারী সবাই নিজেরাই মাদকাসক্ত।

ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রের মালিক নাজনিন ফিরোজা বাঁধনসহ ৫ জনকে গ্রেফতার ও একজন চলচ্চিত্র অভিনেতাসহ ২৮ জনকে উদ্ধারের পর এ তথ্য জানিয়েছে র‍্যাব।

র‍্যাব বলছে, অন্য মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে কৌশলে নিরিবিলি চিকিৎসা পুনর্বাসনের কথা বলে ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে রোগী ভাগিয়ে আনা, রোগীদের আটকে রেখে নির্যাতন করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করাই ছিল মালিক নাজনিন ফিরোজা বাঁধনের মূল ব্যবসা। যারাই প্রতিবাদ করত তাদেরই নির্যাতন করত বাঁধনের স্বামী সিপন ও তার গুণ্ডা বাহিনী।

বুধবার (৫ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর বছিলা র‍্যাব-২ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, গত ১ জানুয়ারি “বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমিতির” পক্ষ থেকে র‍্যাব-২ এর কাছে অভিযোগ করা হয় যে, একজন চিত্রনায়ক দীর্ঘদিন তাদের কার্যক্রমে অনুপস্থিত রয়েছেন। ওই চিত্রনায়ককে গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে।

প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে র‍্যাব সদর দফতর ও র‍্যাব-২ এর গোয়েন্দা দল অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে।

অভিযোগের সত্যতা ও নিরাময় কেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়মের সম্পর্কে জানতে পেরে গতকাল ৪ জানুয়ারি বিকেলে র‍্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-২ এর একটি দল মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রতিনিধিসহ ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে আটকে রাখা চিত্রনায়কসহ ২৮ জনকে উদ্ধার করা হয়।

অভিযানকালে মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রের আড়ালে রোগীদের নির্যাতন ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে মালিক ফিরোজা নাজনিন ওরফে বাঁধন (৩৫), স্বামী মনোয়ার হোসেন ওরফে সিপন (৩১), রায়হান খান (২০), দিপংকর শাহ ওরফে দিপু (৪৪) ও জাকির হোসেন আনন্দকে (২৭) আটক করা হয়। তল্লাশীকালে ৪২০ পিস ইয়াবা (মাদকদ্রব্য), নির্যাতনে ব্যবহৃত লাঠি, স্টিলের পাইপ, হাতকড়া, রশি, গামছা, খেলনা পিস্তল ও কথিত সাংবাদিকের পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়।

তাৎক্ষণিকভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।

আটকে রাখা নায়ক সম্পর্কে জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, নায়ক করোনাকালীন সময়ে পাঁচটি সিনেমা করেছিল। যার কোনোটিই রিলিজ হয়নি। এরমধ্যে তার তিনটি রেস্টুরেন্টও ছিল। সেখানে ব্যবসাতেও লোকসান করে হতাশা-বিষাদে ভেঙে পড়েন। অর্ধকোটি টাকা ঋণে জর্জরিত হয়ে হতাশায় তিনি নিয়মিত ঘুমের ওষুধ সেবন শুরু করলে তার আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। ২০২১ সালের মার্চ মাসে তার মা চিকিৎসার জন্য তাকে ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তবে ডোপ টেস্টে তাকে মাদকাসক্ত পাওয়া না হলেও তিন লাখ টাকা ভর্তি ফি ও ৫০ হাজার টাকা মাসিক খরচায় চিকিৎসার জন্য তাকে সেখানে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে সেখানে তিন মাস পরপর ভিকটিম নায়ককে অসুস্থ দেখা যেতো। মূলত চিকিৎসার নামে তাকে আটকে রেখে প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা আদায় করাই ছিল প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য।

গ্রেফতার ফিরোজা নাজনিন বাঁধনকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত কমান্ডার মঈন বলেন, তিনি ২০০৯ সালে ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রটি অনুমোদনহীনভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩-১৪ সালে সাময়িক অনুমোদন পায়। প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি নিজেই। কর্মী সংখ্যা ৪ জন এবং রোগীর সংখ্যা বর্তমানে ২৮ জন। তিনি যে ভবনটিতে থাকতেন সেটির ভাড়া বাবদ প্রতিমাসে ৪০ হাজার টাকা বাড়ির মালিককে পরিশোধ করতেন।

রোগীদের থেকে আদায় করা হতো ১০-৩০ হাজার টাকা 

ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে নির্যাতিত ভিকটিমরা র‍্যাবকে জানিয়েছে, বাঁধন প্রতি রোগীর কাছ থেকে মাসিক চার্জ হিসাবে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে আদায় করতেন। নিরাময় কেন্দ্রে দুজন চিকিৎসক থাকার কথা বললেও কোনো চিকিৎসককে অভিযানকালে পাওয়া যায়নি। সেখানে ২০ জন রোগীর চিকিৎসার অনুমোদন থাকলেও ২৮ জন রোগী পাওয়া যায়। ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বেশকিছু গুরুতর অভিযোগ পাওয়া যায়।

শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা হতো রোগীদের

উদ্ধার ভিকটিম ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, যেভাবে নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করার কথা, চিকিৎসা দেওয়ার কথা, রোগীদের সেবা করার কথা তার ব্যাপক অনিয়ম এখানে পাওয়া যায়। নিরাময় কেন্দ্রে রোগীদেরকে চিকিৎসার নামে শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করা হতো। এখানে চিকিৎসার নামে রশির সাহায্যে ঝুলিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হতো।

দেওয়া হতো নিম্নমানের খাবার, ছিল না চিকিৎসক

ভিকটিম-কর্মচারীরা জিজ্ঞাসাবাদে র‍্যাবকে জানিয়েছেন, ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে খাবারের মান অত্যন্ত নিম্নমানের ছিল। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কর্তৃক যে সকল নির্দেশনা দেওয়া ছিল তার অধিকাংশই এখানে পাওয়া যায়নি এবং নিরাময় কেন্দ্রে সবসময় ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও তা অনুপস্থিত ছিল।

মালিক-কর্মচারী সবাই নিজেরাই মাদকাসক্ত

মালিক এবং কর্মচারীদের তৎক্ষণাৎ র‍্যাপিড ডোপ টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায় তারা সকলেই মাদকাসক্ত। মূলত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের নামের আড়ালে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করা হতো। এলাকায় মাদকগ্রহীতারা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের নিকট হতে মাদক সংগ্রহ করতো।

গ্রেফতার বাঁধন ২০০৯ সালে ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করে। তার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট। তার প্রথম স্বামীর সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর মনোয়ার হোসেন ওরফে সিপনের সাথে দ্বিতীয় বিবাহ সম্পন্ন হয় বলে সে জানান। সিপন তার সাথে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে বসবাস করত। তিনি একটি ভুঁইফোড় পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতেন।

গ্রেফতার সিপনের গ্রামের বাড়ি গাজীপুর। গ্রেফতার বাঁধনের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন সিপন। সিপন ২০১৬ সালে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয়। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। মাদক নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মূলত তিনি ও তার গুণ্ডা বাহিনী শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন এবং নিরাময় কেন্দ্রের ঘটনাসমূহ কাউকে না বলার জন্য ভিকটিমদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন ও জখমের ভয়ভীতি প্রদর্শন করতেন।

মাদকাসক্ত থেকে পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্মচারী

গ্রেফতার দিপংকর শাহ ওরফে প্রোগ্রামার দিপু দীর্ঘ ১০ বছর যাবত নিরাময় কেন্দ্রের মালিক নাজনিনের প্রধান সহকারী হিসেবে কর্মরত। পূর্বে নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্তির কারণে ১০ মাস চিকিৎসা গ্রহণ করেন। অন্যান্য ভলেন্টিয়ারদের সাথে নিয়ে তিনিও বিভিন্ন জায়গা থেকে পরিকল্পিতভাবে ভিকটিমদের অভিভাবকদের উন্নত চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের ভাওয়াল মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আসতেন। সেখানে তাদের অন্যায়ভাবে আটক রেখে করে রাখত, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত। অভিভাবকদের নিকট হতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করত এবং জোরপূর্বক নিজের ইচ্ছামত তাদের চিকিৎসা প্রদান করতেন।

গ্রেফতার রায়হান খান ও জাকির হোসেন আনন্দ ছিলেন মাদক নিরাময় কেন্দ্রের যথাক্রমে সহকারী ও ভলেন্টিয়ার। তারা দিপংকরের অনুমতিতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ভিকটিমদের জোরপূর্বক মাদক নিরাময় কেন্দ্রটিতে ধরে আনার কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

জেইউ/এইচকে