বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১১১টি সুপারিশের মধ্যে মোটরসাইকেলে আরোহীর হেলমেট পরিধান ছাড়া অন্য কোনো সুপারিশের বিষয়ে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ছবি : ঢাকা পোস্ট

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশৃঙ্খল সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও যাত্রী নিরাপত্তায় ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১১১ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছিল ২২ সদস্যের একটি কমিটি। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে তখন সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। টাস্কফোর্সের অধীনে গঠিত হয় চারটি উপকমিটি। এরপর প্রায় তিন বছর কেটে গেলেও ১১১ সুপারিশের মধ্যে আলোর মুখ দেখেছে কেবল একটি সুপারিশ। 

করোনার অজুহাতে সুপারিশ বাস্তবায়ন শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে। সেই সুযোগে এক বছরের ব্যবধানে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ, বেড়েছে সড়কে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণহানিও। 

এই অবস্থায় ওই ১১১ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য আগামী ২৭ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে বসছে এ সংক্রান্ত কমিটি। সুপারিশগুলো মধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সংশ্লিষ্ট সুপারিশ রয়েছে প্রায় ৩০টি। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়েই বৈঠকে আলোচনা হবে বলে জানা যাচ্ছে। 

১১১টি সুপারিশ প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ১১১ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের সভা আগামী ২ ফেব্রুয়ারি হতে পারে। তার প্রস্তুতি নিতেই আগামী ২৭ জানুয়ারি বৈঠক হবে। আমিও বৈঠকে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছি। এ বৈঠকে সড়ক ও মহাসড়ক সংক্রান্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১১১টি সুপারিশের মধ্যে মোটরসাইকেলে আরোহীর হেলমেট পরিধান ছাড়া অন্য কোনো সুপারিশের বিষয়ে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।  

এই ১১১টি সুপারিশের মধ্যে ২০ নম্বর সুপারিশে বলা হয়েছে, জেব্রাক্রসিং উঁচু করে তৈরি করতে হবে; বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও ধর্মীয় উপাসনালয়ের সামনে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে জেব্রাক্রসিংগুলো রঙ দিয়ে চিহ্নিত করা থাকলেও সেখানে গাড়িচালকরা গতি কমান না। তা উঁচু করা হলে গতিরোধকের কাজ করবে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে সওজ অধিদপ্তর, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও এলজিইডির মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। ঢাকায় জেব্রাক্রসিংয়ের বিষয়টি তদারকি করছে শুধু সিটি করপোরেশন।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে জেব্রাক্রসিংগুলো রঙ দিয়ে চিহ্নিত করা থাকলেও সেখানে গাড়িচালকরা গতি কমান না।

৪২ নম্বর সুপারিশে বলা হয়েছে, স্কুলের পাশের সড়কে যানবাহনের গতিবেগ ৪০ কিলোমিটারের বেশি হলে স্কুল জোনিং করার সুপারিশ করা হয়েছে। স্কুল কমিটির শিক্ষার্থীদের পারাপারের জন্য সাহায্যকারী রাখার কথা। ডিটিসিএসহ বিভিন্ন সংস্থার এই সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা। তবে কাগজেপত্রে সুপারিশটি আছে; বাস্তবে নেই। বাকি সুপারিশগুলোও ঝুলে আছে একইভাবে।   

এ বিষয়ে অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়তে হবে। না হলে এভাবে সুপারিশ ঝুলতেই থাকবে। সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হলে শুধু সভা করলেই হবে না, তা সময় মতো বাস্তবায়নের জন্য তদারকিও দরকার। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য একটি দপ্তরও দরকার, তাও নেই।

গত ২৩ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে নিরাপদ সড়ক সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভা হয়েছিল। সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদার ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ১১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে গঠিত চারটি কমিটি তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে। এখন আমরা ১১১ দফা সুপারিশ ধীরে ধীরে বাস্তবায়নে যাব। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশের অনেকগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও তিনি জানান। তবে তিনি বলেছিলেন করোনা সংক্রমণের জন্য বাস্তবায়নের গতি ধীর ছিল।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা আনা ও নিরাপত্তার জন্য আমরা নিয়মিতভাবে চালক ও পথচারীদের সচেতন করতে প্রচারণামূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ১১১টি সুপারিশের মধ্যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দক্ষ চালক তৈরি করার বিষয়ে। দক্ষ চালক তৈরির জন্য আমরা প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছি। তবে আমি মনে করি ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নে জড়িত সব সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।

এক বছরের ব্যবধানে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ

তিনি বলেন, দক্ষ চালক তৈরির জন্য প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বাড়ানো হচ্ছে। এ যাবত ১৩৯টি ড্রাইভিং স্কুলের ও ২৭০ জনকে ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টরের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দক্ষ চালক তৈরির জন্য আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে এই প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। গাজীপুরে আমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া লক্ষাধিক চালক তৈরির জন্য ধাপে ধাপে কাজ চলছে।

ঢাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে টানা আট দিন আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। তারপর ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পেশ করা হয় সড়কে শৃঙ্খলা আনার ও নিরাপত্তার ১১১ সুপারিশ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুপারিশগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখনও সড়ক নিরাপদ হয়নি। আগে থেকে চলা কিছু প্রকল্প ও কর্মসূচিই আমরা দেখতে পাচ্ছি। খোদ রাজধানী ঢাকায় শিক্ষার্থীদের প্রাণহানির হারও বেড়েছে।  

সড়কে প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ২৪ জানুয়ারি ট্রাফিক পুলিশ ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি’ ব্যানার নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মানুষকে সচেতন করে। তাতে নেতৃত্ব দেন ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডেমরা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. ইমরান হোসেন মোল্লা।

বাংলাদেশ পুলিশের হিসেবে, গত বছর সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ৫ হাজার ৮৮ জনের। ২০২০ সালে ৩ হাজার ৯১৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। এই পরিসংখ্যান আমলে নিলে বলা যায়, এক বছরের ব্যবধানে সড়কে প্রাণহানি বেড়েছে ২৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। 

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। ২০২০ সালে মারা যান ৫ হাজার ৪৩১ জন। এ সংগঠনের হিসাবেও দেখা যাচ্ছে প্রাণহানি বেড়েছে। অথচ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ৮৫ দিন গণপরিবহন বন্ধ ছিল।

এছাড়া গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স  ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, ২০২১ সালে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত হয়েছেন। আগের বছরের চেয়ে তা ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি। 

২০২১ সালে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত হয়েছেন : যাত্রী কল্যাণ সমিতি

সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়কে প্রাণহানি কমানোর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ দেখছি না, মাঝে-মধ্যে সভাই হচ্ছে।  এ কারণে সুপারিশগুলো ঘুমিয়ে থাকে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন না করে শুধু সুপারিশ আর কমিটি করা হচ্ছে। এসব শুধু করার জন্য করা হয় বলে মনে হচ্ছে।

পিএসডি/এনএফ