ফরিদপুর ও মুন্সিগঞ্জ জেলা থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া মোবাইল ব্যাংকিং হ্যাকার চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৪।

র‍্যাব জানায়, তারা হ্যাকিংয়ের জন্য ব্যয়বহুল পেইড অ্যাপ কিনে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিত। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন নামের ২৪টি সিম ও ১৩টি মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া আসামিরা হলেন; মো. নুরুজ্জামান মাতুব্বর, মো. সজিব মাতুব্বর, মো. সুমন শিকদার।

বুধবার (২৬ জানুয়ারি) বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব-৪-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মোজাম্মেল হক বলেন, আসামিরা মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণার মাধ্যমে এজেন্টসহ জনসাধারণের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এই প্রতারক চক্রটি সাধারণত মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের টার্গেট করত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সাধারণ গ্রাহকদেরও প্রতারিত করেছে বলে স্বীকার করেছে। প্রতারক চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন অসাধু মোবাইল সিম বিক্রেতার সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশে অন্যের এনআইডি দিয়ে সিম কার্ড রেজিস্ট্রেশন করে। অ্যাপস ব্যবহার করে নম্বর ক্লোনিং করে নিজেকে মোবাইল ব্যাংকিং হেড অফিসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ফোন করে কৌশলে এজেন্টদের পিন কোড জেনে অ্যাকাউন্টটি নিজের দখলে নেয়। তারপর নম্বর ক্লোনিং করে সেই এলাকার এসআর-এর কাছে ওই দোকানের পরিচয় দিয়ে চাওয়া হতো মোটা অংকের টাকা, ওই টাকা অ্যাকাউন্টে আসার সঙ্গে সঙ্গে নিজের দখলে থাকা অ্যাকাউন্ট থেকে কৌশলে দেশের বিভিন্ন নম্বরে স্থানান্তর করে দিত। তাদের যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শনাক্ত করতে না পারে তার কৌশল হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে টাকা পাঠিয়ে তার অধীনে থাকা এজেন্ট থেকে টাকা সংগ্রহ করত। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ গ্রুপের ২০-২৫ জন সদস্য রয়েছে।

৩ গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতারণার জাল

র‍্যাব জানায়, আসামিরা ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতারণা করত। এ চক্রের প্রথম গ্রুপের সদস্যরা মোবাইল ব্যাংকিং হেড অফিসের অসাধু কর্মকর্তার/কর্মচারীর কাছ থেকে এসআর (সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ/এজেন্ট) এর নম্বর সংগ্রহ করে।তারপর এসআরকে মোবাইলে কল করে বিভিন্নভাবে মোটা অংকের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দলে যোগ দিতে আগ্রহী করে। কিছু কিছু অসাধু এসআর প্রতারক চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হয়। সময় সুযোগ বুঝে এসআর প্রতারক চক্রের সদস্যকে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর নিয়ে ফোন দিয়ে বলত এখন কাজ হবে ফোন দেন। সাধারণত যখন মূল এজেন্ট দোকানে উপস্থিত থাকে না, তার অন্য কোনো প্রতিনিধি বা যে এজেন্ট একটু সহজ সরল তাদেরই মূল টার্গেট করা হতো। 

প্রাপ্ত তথ্যের পরপরই দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যরা এসআর-এর নম্বর স্পুফিং/ক্লোনিং করে এজেন্টের নম্বরে কল করে উন্নত সেবার জন্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট হালনাগাদ করার অনুরোধ করে এবং বলে যে কল সেন্টার থেকে আপনাকে কল দেওয়া হবে। প্রতারক গ্রুপের অপর সদস্য কল সেন্টার নম্বর স্পুফিং/ক্লোনিং করে এজেন্টকে ফোন দিয়ে উন্নত সেবা পেতে সার্ভিস পরিবর্তনের জন্য অফার করা হয়। প্রতারক মোবাইল ফোনের কিবোর্ড বা বাটনে বিভিন্ন অক্ষর বা সংখ্যা চাপতে বলে। ধাপে ধাপে বিভিন্ন তথ্য দিতে বলা হয়। কয়েকটি সংখ্যা দেওয়ার এক পর্যায়ে ভেরিফিকেশনের নামে একটি মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে তা ডায়াল বা মেসেজ অপশনে গিয়ে 'ওকে' বাটন চাপতে বলে। এভাবে এজেন্টের কাছ থেকে পিন নম্বর নিয়ে এজেন্টের অ্যাকাউন্ট নিজেদের দখলে নিয়ে এজেন্টের অ্যাকাউন্টে থাকা সব অর্থ প্রতারক সদস্যরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের অন্যান্য সহযোগীদের কাছে ট্রান্সফার করে দেয়। 

তৃতীয় গ্রুপের সদস্যরা অসাধু সিম বিক্রেতাদের কাছ থেকে প্রতি সিম কার্ড ১০০০ টাকা দিয়ে কিনে নেয়। এরপর ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে নিবন্ধিত সিম কার্ড ব্যবহার করে ভুয়া মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলে। ওই অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করে পরবর্তীতে অন্য এজেন্ট থেকে ক্যাশ আউট, বিভিন্ন কেনাকাটায় পেমেন্ট, মোবাইল রিচার্জসহ বিভিন্নভাবে টাকা উত্তোলন করে গ্রুপের সব সদস্য মিলে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়।

মোজাম্মেল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে প্রতারক চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে টাকা ট্রান্সফার করে। টাকা ভাগ বাটোয়ারার ক্ষেত্রে প্রতি এক লাখ টাকায় এসআর পায় ২০-২৫ হাজার টাকা, যে এজেন্টদের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করা হয় সে প্রতি লাখে ১০-১২ হাজার টাকা এবং বাকি ৬৫-৭০ হাজার টাকা প্রতারক চক্রের অন্য সদস্যরা ভাগ করে নেয়। তারা এ পর্যন্ত কোটি টাকার উপরে আত্মসাৎ করেছে।

তিনি বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারক চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন অসাধু মোবাইল সিম বিক্রেতাদের সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশে প্রতি সিম ১০০০ টাকা বা তার অধিক আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অন্যের নাম-ঠিকানা দিয়ে নিবন্ধিত সিম কার্ড সংগ্রহ করে। এই প্রতারক চক্রের প্রত্যেক সদস্যের কাছে ৫০-৬০টির অধিক বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির সিম কার্ড রয়েছে। প্রতারণার কাজ শেষে ব্যবহৃত সিম কার্ডটি নষ্ট করে ফেলে তারা। মোবাইল নম্বর স্পুফিং বা ক্লোনিংয়ের জন্য অনলাইন থেকে তারা বিদেশি পেইড অ্যাপস ক্রয় করে।

গ্রেফতারকৃতদের কার কি পরিচয়

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মো. নুরুজ্জামান মাতুব্বর (৩৫), ফরিদপুরের স্থানীয় একটি স্কুল থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। সে ২০০০ সালের শুরুতে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় এসে স্যানিটারিমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করে। ২০১৫ সালে সে ঢাকা থেকে তার নিজ এলাকা ফরিদপুরে গিয়ে কৃষি কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে মোস্তাকের মাধ্যমে ডিজিটাল প্রতারণার কাজে যোগ দেয়। ২০২১ সালে পুলিশ কর্তৃক ডিজিটাল প্রতারণার মামলায় গ্রেফতার হয় সে। ৩ মাস আগে জামিনে বের হয়ে পুনরায় প্রতারণার কাজে যোগ দেয়। তার নামে ৩টি মামলা রয়েছে।

গ্রেফতার মো. সজিব মাতুব্বর (২১) ফরিদপুরের স্থানীয় একটি স্কুল থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে কাঠমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করে। সে ২০১৭ সালে মোস্তাকের মাধ্যমে ডিজিটাল প্রতারণার কাজে যোগ দেয়। সে ২০২১ সালে প্রথমে র‌্যাবের মামলায় এবং পরবর্তীতে পুলিশের করা ডিজিটাল প্রতারণার মামলায় গ্রেফতার হয়। ২ মাস আগে জামিনে বের হয়ে পুনরায় সে প্রতারণার কাজে যোগ দেয়। তার নামে ১টি ডিজিটাল প্রতারণা এবং ১টি মাদক মামলা রয়েছে।

গ্রেফতার মো. সুমন শিকদার (৪৫) মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় একটি স্কুল থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ১৯৯৬ সালে শ্রমিক ভিসায় সৌদি আরবে যায়। ২০০১ সালে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে মোবাইলের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করে। ২০০৫ সালে মোবাইলের দোকানের কাজ বাদ দিয়ে স্থানীয় একটি এনজিওতে কাজ শুরু করে। ২০১০ সালে এনজিও বন্ধ হয়ে গেলে পুনরায় সে মোবাইলের দোকানে কাজ শুরু করে। ২০১৪ সালে সে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের এসআর হিসেবে কাজ শুরু করে। ২০১৭ সালে শেষের দিকে সে আর্থিক প্রলোভনে পড়ে প্রতারক চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়। সে প্রতারিত অর্থের কমিশনের বিনিময়ে প্রতারক চক্রের কাছে বিকাশ এজেন্টদের তথ্য সরবরাহ করত।

এআর/এসকেডি