জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জানেন না বেশিরভাগ ভুক্তভোগী। আবেদন প্রক্রিয়া জানা না থাকায় বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই এনআইডি সংশোধন করতে চলে আসছেন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রধান কার্যালয়ে। 

রোববার (৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এনআইডি সংশোধন সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে কমিশনের বাইরে দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে আছেন ভুক্তভোগীরা। কেউ এসেছেন সংশোধন চেয়ে আবেদন করা এনআইডি কী অবস্থায় আছে তা জানতে। আবার কেউ এসেছেন কীভাবে আবেদন করতে হবে সে বিষয়ে জানতে। অনেকে আবার দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢুকতে না পেরে লাইন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। 

কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা ঢাকা পোস্টকে জানান, সপ্তাহের শুরুর দিন হওয়াতে মানুষের ভিড় বেশি। তাছাড়া ভেতরে খালি হলে তারপর বাইরের লাইন থেকে লোক ঢুকানো হচ্ছে।

রাজধানীর বাড্ডা থেকে এনআইডির প্রধান কার্যালয়ে এসেছেন সুজন নামের এক যুবক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি অনলাইনে এনআইডি সংশোধনের জন্য আবেদন করেছিলাম। সে সময় আমার জন্ম তারিখ সংশোধনের আবেদন করেছিলাম। কর্তৃপক্ষ আমার এনআইডি সংশোধন করেছে, কিন্তু বয়স সংশোধন করে দেয়নি। বয়স সংশোধন কেন হলো না এটাই জানতে এখানে এসেছি।’ 

আবদুল ওয়াদুদ নামের একজন এসেছেন খিলগাঁওয়ের নন্দিগ্রাম থেকে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে এবং দীর্ঘ লাইন দেখে তিনি নিজে থেকেই চলে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি এনআইডি কার্ড সংশোধনের জন্য এসেছি। কিন্তু এখানে যে পরিস্থিতি দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে আমার এনআইডি কার্ড সংশোধন করার দরকার নাই।’

তিনি বলেন, ‘আমি দেড় মাস আগে এনআইডি কার্ড সংশোধনের জন্য আবেদন করেছি। এখন পর্যন্ত কোনো এসএমএস আসেনি। যেখানে আবেদন করেছি সেখান থেকে আমাকে হেড অফিসে আসতে বলেছে। এজন্য আজ এসেছিলাম।’  

আরিফ নামের এক ভুক্তভোগীর বড় ভাই ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার ভাই বিদেশ যাবে। কিন্তু এনআইডি সংশোধন না হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। আমার ভাইয়ের বর্তমান এনআইডিতে জন্ম তারিখ ১৯৯৪ সাল। সেখান থেকে সংশোধন করে ১৯৮৯ করতে হবে। আমরা কুষ্টিয়ায় যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু তারা বলেছে, ঢাকা হেড অফিসে যেতে। এজন্য আজ এখানে এসেছি।’

এখানে কার কাছে যাবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাকে কুষ্টিয়া থেকে বলে দিয়েছে, থানা, জেলা, কুষ্টিয়ার অফিস আছে। সেখানে যেতে বলেছে তারা। আমার ভাই লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে গেছে।’  

আলী আকবর খান মিঠু এসেছেন রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার আম্মার নামের সংশোধন করতে এখানে এসেছি। আমি এখনও আবেদন করিনি। আবেদনের প্রক্রিয়া কী, সে বিষয়ে আমরা সাধারণ জনগণ জানি না। জানানোর জন্য কোনো উদ্যোগও তো নেই। তাই জানতে এসেছি।’

এ প্রসঙ্গে এনআইডি মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ুন কবীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এভাবে যারা আমাদের কাছে আসছে আমরা তাদের সংশ্লিষ্ট থানা নির্বাচন অফিসে পাঠিয়ে দিচ্ছি। নির্বাচন থাকায় এতদিন এনআইডি সংক্রান্ত কোনো কাজ থানা নির্বাচন অফিস থেকে করা হয়নি। কিন্তু আমরা এখন আদেশ দিয়েছি, এনআইডির কাজ থামানো যাবে না। একইসাথে সাধারণ জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করা হচ্ছে। কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিয়ে বসব। সাধারণ মানুষ যেন ভোগান্তি ছাড়া এনআইডি সেবা পায় সেজন্য চেষ্টা করছি।’

এনআইডি সংশোধন করবেন যেভাবে

নাগরিক জীবনে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) গুরুত্ব অপরিসীম। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো চালু হয় এটি। ওই সময় এনআইডির গুরুত্ব সেভাবে উপলব্ধি করা না গেলেও বর্তমানে সর্বক্ষেত্রে এর ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। শুরুর দিকে সেভাবে বুঝতে না পারায় অনেকে তথ্য দিতে ভুল করেন। এছাড়া নতুন যারা ভোটার হয়েছেন তাদেরও অনেকে এনআইডির গুরুত্ব না বুঝে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ফরম পূরণ করেন।

কেউ কেউ জন্মনিবন্ধন ও এনআইডিতে দেওয়া নাম ও বয়স গুলিয়ে ফেলেন। পরবর্তীতে তারা নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য আবেদন করেন। এছাড়া প্রয়োজনীয় তথ্য না দেওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে আবেদন সংশোধন করা যাচ্ছে না বলে জানান এনআইডি সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা।

তারা জানান, এনআইডি সংশোধনে আবেদনগুলো চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি আবেদন ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ ও ‘ঘ’ এ চার ক্যাটাগরির যেকোনো একটিতে নির্ধারণ করা হচ্ছে। এনআইডি সংশোধনের জন্য অনলাইনে আবেদনের পর সংশ্লিষ্টরা ধরন অনুযায়ী এসব ক্যাটাগরিতে ভাগ করে দিচ্ছেন।

নাম সংশোধনের মতো ছোটখাটো আবেদন করলে সেটি ‘ক’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাই এটি সংশোধন করতে পারেন। 

এসএসসি সার্টিফিকেটের সঙ্গে মিল রেখে বয়সের সংশোধন আবেদন ‘খ’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হচ্ছে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা নিজস্ব ক্ষমতাবলে এটি সংশোধন করতে পারেন। 

নামের আমূল পরিবর্তন ও বয়স কম বা বেশি— এমন সংশোধনের আবেদনটি ‘গ’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হচ্ছে। এ ক্যাটাগরির আবেদনটি আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও এনআইডি হেড অফিসের দুজন পরিচালকের তদন্ত শেষে সংশোধনের এখতিয়ার রয়েছে। 

এর বাইরে আরও জটিল আবেদন অর্থাৎ এসএসসি পাস ছাড়া জন্মনিবন্ধন ও অষ্টম পাসের সার্টিফিকেট দিয়ে এনআইডি সংশোধন করতে চাইলে তা ‘ঘ’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হচ্ছে। এসব আবেদন তদন্ত রিপোর্টসহ এনআইডি মহাপরিচালক সংশোধন করে থাকেন।

একজন মহাপরিচালক, সারাদেশে ১০ জন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, ৬৪ জন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এবং উপজেলা ও থানা নির্বাচন কর্মকর্তা এনআইডি সংশোধনের আবেদনগুলো ক্যাটাগরি অনুযায়ী সংশোধন করে থাকেন। তবে এনআইডি সংশোধনের জন্য আবেদনকারীকে অবশ্যই ক্যাটাগরি বুঝে খোঁজ নিতে হবে।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত যারা ভোটার হয়েছেন, এমন কয়েক কোটি ভোটারের দুই নম্বর ফরম ইসির অনলাইনে নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ফেলে রাখায় এসব ফরমের বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। ওই সময় ভোটারদের পূরণ করা ইসির দুই নম্বর ফরমটির বেশির ভাগই এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ইসির অপারেটররা এনআইডিতে ভুল লিখলেও সেটা চেক করার সুযোগ থাকছে না। এনআইডির ভুল সংশোধন করতে এসে উল্টো আরও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ।

এসআর/এইচকে