হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ভুয়া অফিস আদেশ

পুরান ঢাকার চকবাজারের দোকানি শিবলী হুসাইন। গত বছরের ২৯ নভেম্বর ঢাকার আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে ই-পাসপোর্টের আবেদন করেন তিনি। গত ৩ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) তার মুঠোফোনে একটি কল আসে। বলা হয়, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে ফোন করা হয়েছে।

ফোনে তার নাম-পরিচয় ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর যাচাই করা হয়। এরপর বলা হয়, ‘আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দিন, একটি অফিস আদেশ পাঠাব।’

কিছুক্ষণের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একটি ‘ভুয়া’ আদেশ পাঠানো হয়। আদেশে শিবলীর নাম, এনআইডি নম্বর ও জন্মতারিখসহ বেশ কয়েকটি তথ্য ছিল। পাশাপাশি আদেশে উল্লেখ করা হয় ‘আরটিফি আবেদন ফি হিসেবে তিন হাজার ৮০০ টাকা জমা দিতে হবে’। আদেশের নিচের অংশে হাতে লেখা ছিল ‘জামানত ফেরত পাবেন’।

ওই আদেশে পাসপোর্ট সংগ্রহের তারিখ দেওয়া রয়েছে ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ এবং এটি ৩১ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে ইস্যু করা। এসব তারিখের কোনোটিই সঠিক নয়। 

আদেশে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পাসপোর্ট ও ভিসা বিভাগের প্রধান ইসহাক আলী ও কারিগরি বিভাগের পরিচালকের সই ও সিল ছিল। পাশাপাশি ‘অনুমতি প্রদান করা গেল’ সংবলিত একটি সিল দেওয়া ছিল। নিচের দিকে একটি রবি নম্বরও লেখা ছিল ওই আদেশে।

আদেশে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পাসপোর্ট ও ভিসা বিভাগের প্রধান ইসহাক আলী ও কারিগরি বিভাগের পরিচালকের সই ও সিল ছিল। পাশাপাশি ‘অনুমতি প্রদান করা গেল’ সংবলিত একটি সিল দেওয়া ছিল। নিচের দিকে একটি রবি নম্বরও লেখা ছিল ওই আদেশে।

হোয়াটসঅ্যাপে আদেশটি দেখে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফের শিবলীর ফোনে কল আসে ওই নম্বর থেকে। এসবি পরিচয়দানকারী ওই ব্যক্তি বলেন, ‘পাসপোর্ট এর জরুরি আবেদনের ভেরিফিকেশনের জন্য এখনই তিন হাজার ৮০০ টাকা বিকাশ করতে হবে।’ আদেশে কর্মকর্তাদের সিল-সই দেখে দাবি করা টাকা বিকাশ করে দেন শিবলী। 

পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষে গত ৬ ফেব্রুয়ারি অধিদপ্তরের আগারগাঁও কার্যালয় থেকে পাসপোর্ট আনতে যান শিবলী। পাসপোর্ট হাতে পেয়ে অফিস আদেশ দেখিয়ে ৩ হাজার আটশ টাকা ফেরত চান তিনি। অধিদপ্তরের লোকজন তাকে জানান, ওই আদেশটি ভুয়া!

শিবলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘টাকা দেওয়ার পর পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য আমার ফোনে অন্য নম্বর থেকে কল দেওয়া হয়। তিন দিন পর পুলিশ ভেরিফিকেশনের ফলাফলও সন্তোষজনক হয়। তাই আমি এটিকে সত্যিকারের অফিস আদেশ মনে করেছিলাম।’

সরেজমিনে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের আগারগাঁওয়ের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে পাওয়া গেল প্রতারণার শিকার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ভুইয়া নামে আরেক ভুক্তভোগীকে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি আমার পরিবারের চারজনের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করি। আমাকে কল দিয়ে চারটি পাসপোর্টের জন্য একটি অফিস আদেশ পাঠায়। তাতে ‘ফেরতযোগ্য’ ১৫ হাজার টাকা দাবি করা হয়। আমি টাকা দিয়ে দিই। পরে জানতে পারি এটি ভুয়া।’

এ বিষয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ২/১ দিন পরপর এ ধরনের ভুয়া অফিস আদেশ নিয়ে জামানতের টাকা ফেরত নিতে আসেন আবেদনকারীরা। অধিদপ্তর থেকে এমন কোনো ‘অফিস আদেশ’ পাঠানো হয় না বলে জানান তারা।

জানতে চাইলে পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আইয়ূব চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ ধরনের অফিস আদেশ ও জামানতের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুয়া। যারা অপপ্রচার চালিয়ে অধিদপ্তরের নামে এ ধরনের ভুয়া আদেশ তৈরি করে আবেদনকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বর্তমানে পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনের দায়িত্বে রয়েছে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)। তাদের পক্ষ থেকে আবেদনকারীর কাছে এ ধরনের কোনো আদেশ দেওয়া হয় কি না, জানতে চাইলে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি।

তবে এসবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এসবি হলো তদন্তকারী ও গোয়েন্দা সংস্থা। তারা কেউ মিডিয়ায় কথা বলতে পারে না। তবে পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় ভুয়া আদেশ পাঠানোর বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রতারণা।’

তিনি  আরও বলেন, ‘ভেরিফিকেশনের জন্য একজন এসবি অফিসার আবেদনকারীকে কল করে দেখা করার সময় নির্ধারণ করেন। পরে তার সঙ্গে দেখা করে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পাসপোর্ট অধিদপ্তরে পাঠান। লেনদেন কিংবা ভুয়া আদেশ পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। যারা এসবির নাম ব্যবহার করে এ ধরনের কাজ করছে, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।’

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের নামে পাঠানো ‘ভুয়া আদেশে’ থাকা মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার ফোন করে ঢাকা পোস্ট। প্রতিবারই নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। 

এআর/আরএইচ/জেএস