ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অপরাধ ভুবনে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। যেমন ঘটেছে বুয়েটের সনি হত্যার মতো শাহজাহানপুরের প্রীতি হত্যার ঘটনায়। ২০ বছর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়—বুয়েটের রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সনি ২০০২ সালের জুন মাসে বিএনপি সমর্থিত ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন।

বুয়েট ক্যাম্পাসে দুই গ্রুপের মধ্যে এলোপাতাড়ি গোলাগুলিতে নিহত হয়েছিলেন তিনি। আর ২৪ মার্চ রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে মাইক্রোবাসে করে শাহজাহানপুর আমতলা কাঁচাবাজার হয়ে বাসায় ফেরার পথে বন্দুকধারীদের হাতে খুন হন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু। এ সময় এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন রিকশাযাত্রী কলেজ ছাত্রী প্রীতি। ক্ষমতাসীন দলের চাঁদাবাজির আধিপত্য ও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে টিপুকে খুন করতে গিয়ে হত্যাকারীর গুলিতে প্রাণ যায় এই কলেজ ছাত্রীর।

সনির মতোই প্রীতি, অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে। এবং সাধারণ নাগরিক যেভাবেই, যে অন্যায় ব্যবস্থারই শিকার হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। তাই এই পরিবারটির পাশে গিয়ে রাষ্ট্র, সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের কেউ দাঁড়ায়নি। অনেকে বলছেন, এই পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। সেটা তো দূরের কথা, সামান্য সান্ত্বনাও কেউ দেয়নি।

প্রীতির বাবা মামলা করতে চান না। এটা শুধু এ কারণে না যে, বিচার ব্যবস্থার প্রতি তার অনাস্থা। এ কারণেও, হত্যার পেছনে যারা আছে তারা এতটাই শক্তিশালী যে, এই মামলা করার কারণে তার পরিবারের ওপর যদি অদূর ভবিষ্যতে নিপীড়ন নেমে আসে তখনো কেউ পাশে থাকবে না।

টিপু হত্যা আমাদের সামনে নিয়ে এলো ফিল্মি স্টাইলের আরও এক রাজনৈতিক খুনের দৃশ্য। ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাতে গুলশানে শপার্স ওয়ার্ল্ড নামে একটি বিপণী বিতানের সামনে ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক মিল্কিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাকেও একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

প্রীতির বাবা মামলা করতে চান না। এটা শুধু এ কারণে না যে, বিচার ব্যবস্থার প্রতি তার অনাস্থা। এ কারণেও, হত্যার পেছনে যারা আছে তারা এতটাই শক্তিশালী যে, এই মামলা করার কারণে তার পরিবারের ওপর যদি অদূর ভবিষ্যতে নিপীড়ন নেমে আসে তখনো কেউ পাশে থাকবে না।

মিল্কি হত্যার অভিযোগপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন টিপু। এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে অনেক দিন কারাগারে ছিলেন তিনি। পরে জামিনে মুক্ত হন। পুলিশ জানায়, মিল্কি হত্যা মামলার এজাহারে টিপুর নাম থাকলেও ওই সময় তদন্তে তার সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় আদালত তাকে ওই মামলা থেকে জামিন দিয়েছিলেন। টিপু মতিঝিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ থানার নেতা, তার স্ত্রী সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর। রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় পুলিশ দ্রুততার সাথে অভিযুক্ত খুনিকে আটক করেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন নতুন নয়। এই ব্যাধি মজ্জাগত হয়েছে দলের ক্ষমতা সুদৃঢ় রাখতে দুর্বৃত্তদের ব্যবহার করার কারণে। বরাবরই এরা ছিল। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে এদের অনাচার মানুষকে বিপন্ন করছে। এ কারণেই কিছু সেলিব্রিটি দুর্বৃত্তকে পাকড়াও করা হয়েছিল যাকে আমরা নাম দিয়েছি ‘ক্যাসিনোকাণ্ড’। কিন্তু অনাচার থামেনি। দুর্নীতি, সন্ত্রাস এবং দৌরাত্ম্য রাজনীতির সর্বাঙ্গে পক্ষাঘাতের লক্ষণ ক্রমে স্পষ্ট করে তুলছে। এই ব্যাধির উপশম কোথায় কে জানে?

বলা হয়, ধনতন্ত্রে এক ধরনের আদিম স্পৃহা লাগে পুঁজি বাড়ানোর জন্য। হয়তো আমরা সেই আদিম স্পৃহার এরকম উন্মত্ত প্রদর্শন এখন দেখছি। কিছুদিন আগে শেষ হওয়া ইউনিয়ন পরিষদসহ বেশকিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে হিংসার এই উন্মত্ততা প্রান্তিক মানুষেরা যার যার এলাকায় দেখেছে, সয়েছে।

প্রশ্ন জাগে, রাজনীতি যদি সাধারণ মানুষের কল্যাণেই হয় তাহলে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক বিচারে এই দুর্বৃত্তায়ন অথবা দুর্নীতির কোনো সমালোচনা কী হচ্ছে কোথাও? বিশেষ করে দলীয় নীতিনির্ধারণী জায়গায়? কী সেই সামগ্রিক রাজনৈতিক বোধ, যাতে সাধারণ মানুষ এই দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতিকে নির্লিপ্তভাবে মেনে নিচ্ছে?

রাজনীতি যদি সাধারণ মানুষের কল্যাণেই হয় তাহলে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক বিচারে এই দুর্বৃত্তায়ন অথবা দুর্নীতির কোনো সমালোচনা কী হচ্ছে কোথাও?

হানাহানি আর রাজনীতি সমার্থক হয়ে যাওয়া সামাজিক অমঙ্গল। অথচ ঘটছে সেটাই। আমাদের দেশ জুড়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও অস্থিরতা শুধুমাত্র ভোটকে কেন্দ্র করে হচ্ছে, এমন নয়। এখন জায়গার দখল, চাঁদার দখল, এমনকি ফেসবুকের প্রতিক্রিয়া নিয়েও নিজেদের ভেতর অস্থিরতা তৈরি করছে দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক কর্মীরা। আর এই অস্থিরতা, এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে লোকালয়ে, শহরে, গ্রামে, পাড়ায়, চায়ের দোকানে বা একেবারেই বাড়ির ভেতরে, পারিবারিক আবহে, ভিড়ের মাঝে, যার শিকার এখন প্রীতির মতো নাগরিকরা।

রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানে যুক্তির প্রেক্ষিতে বিপরীত যুক্তি। সেটা এখন আর নেই। এখন শুধু নিঃশেষ করে দেওয়ার অনুশীলন। এখন কেবলই উত্তেজনা, অস্থিরতা। এমনটা ছিল না আমাদের চারপাশে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোথায় যেন চলেছি আমরা।

রাজনীতি আমাদের সুস্থ সমাজ গঠনের স্তম্ভ। অথচ সাধারণ মানুষ এখন রাজনীতিকে ভয় পায় ভীষণ। কারণ রাজনীতি যুক্তির বিরোধিতায়, চিন্তার বিরোধিতায় শক্তিশালী এখন। আসলে, বহুদিন আয়নার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না রাজনীতিকদের।

সততার সাথে মুখোমুখি হলে উঠে আসবে আত্মশ্লেষ আর প্রশ্ন, যার উত্তর সোজাসাপ্টা কিছু নেই। মানুষ মনে করে, রাজনীতিকরা অসংখ্য মিথ্যার আশ্রয় নেন, সাধারণ জনতাকে তারা বিপদে ফেলেন এবং তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া অন্য কিছুতেই বিশ্বাস রাখেন না। মানুষ দেখছে, রাজনৈতিক ভাবে বেঠিকরা জামার কলার তুলে ঘোরাফেরা করছে। সেই রাজনীতি দিয়ে কি সুশাসন আর জনকল্যাণ হয়?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী, গ্লোবাল টিভি