ছবি : সংগৃহীত

গত একযুগে বাংলাদেশের অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। অর্থনীতির সব সূচকে বিস্ময়কর ইতিবাচক দিক। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর অনেকে বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে মনে করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে একটি তলাবিহীন ঝুড়ি। কিন্তু সেই ঝুড়িতে আজ উপচেপড়া ফসল।

সত্যি সত্যি বিশ্ব এখন অবাক তাকিয়ে রয়। পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। কোনো কোনো সূচকে বাংলাদেশ ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। মাথাপিছু আয় প্রায় ২ হাজার ৬০০ ডলার। নিজ অর্থে বানানো পদ্মা সেতুতে গাড়ি চলাচল শুরু হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এবছরই মেট্রোরেলে ট্রেন চলবে, গাড়ি চলবে কর্ণফুলী টানেলে। উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে দেশে।

কিন্তু এতসব উন্নয়ন অর্থহীন হয়ে যায়, যখন মানুষ ঠিকমতো খেতে না পায়। উন্নয়ন তখনই স্বস্তি আনবে, যখন উন্নয়নের সুফল সব মানুষের ঘরে পৌঁছাবে। এটা বলতে অনেক ভালো শোনায়। কিন্তু উন্নয়নের সুফল সব মানুষের ঘরে পৌঁছানোর ধারণা অসম্ভবই নয় শুধু, অবাস্তবও বটে।

সমাজতান্ত্রিক হোক আর পুঁজিবাদী পৃথিবীর কোনো দেশই সব মানুষের ঘরে সমান সুযোগ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। সবাই কখনো সমান হবে না। কেউ কেউ একটু বেশি বড় হবে। কিন্তু সব সুযোগ না হোক, সব মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা, মানে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা করা তো সরকারেরই দায়িত্ব।

বর্তমান সরকার অবশ্য দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর নানামুখী চেষ্টা করছে। ভূমিহীনদের জন্য ঘর, দরিদ্রদের কাছে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পণ্য পৌঁছে দেওয়াসহ সামাজিক নিরাপত্তার নানা উদ্যোগ রয়েছে। সরকারের নানা চেষ্টায় ‘মঙ্গা’ শব্দটি এখন আর ব্যবহৃত হয় না।

এত যে লাইন, এত যে ধাক্কাধাক্কি, এত আলোচনা, এত খবর; সেই টিসিবিও তো বিনা পয়সায় পণ্য দেয় না; ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি করে। কিন্তু ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতেও তো টাকা লাগে।

দারিদ্র্যের হারও কমে এসেছিল। কিন্তু করোনার ধাক্কায় দারিদ্র্যের হার আবার বেড়ে গেছে। করোনার ধাক্কায় অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসায় ধস নেমেছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে অনেকে নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন হয়ে গেছেন। সাথে যুক্ত হয়েছে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য। তাদের জীবন এখন হাঁসফাঁস।

নিম্নবিত্তের পাশাপাশি নিম্ন মধ্যবিত্তরাও এখন টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। এ নিয়ে তোলপাড় গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু এর বাইরে কিছু মানুষ আছে, যারা দারিদ্র্যসীমার একদম প্রান্তে বাস করে। তাদের আসলে টিসিবির লাইনে দাঁড়ানোর সামর্থ্যও নেই। কারণ এত যে লাইন, এত যে ধাক্কাধাক্কি, এত আলোচনা, এত খবর; সেই টিসিবিও তো বিনা পয়সায় পণ্য দেয় না; ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি করে। কিন্তু ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতেও তো টাকা লাগে।

বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের ছাতংপাড়ার বাসিন্দা পাসিং ম্রো’র পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০। এই পরিবারের মাসিক আয় ছয় হাজার টাকা। কোনো অর্থমন্ত্রী, কোনো জাদুকর কি আছেন ছয় হাজার টাকায় ১০ জনের সংসারের হিসাব মিলিয়ে দেবেন?

টিসিবির এক প্যাকেজ পণ্য কেনার টাকা কখনো একসাথে থাকে না পাসিং ম্রো’র কাছে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, টিসিবি যে পণ্য বিক্রি করে, সবগুলো তার কাছে প্রয়োজনীয় নয়। রান্না করতে তাদের তেল-পেঁয়াজ লাগে না। তারা খান শুটকি আর কচু-ঘেচু। ছোলা বা খেজুর তো তার কাছে বিলাসী পণ্য। দেশে এমন কত পাসিং ম্রো’রা বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন, তার খবর কি আমরা রাখি?

পাসিং ম্রো’র ১০ সদস্যের পরিবারের মাসিক আয় ছয় হাজার টাকা। আবার কারো কারো এক বিকেলের চায়ের আড্ডায় বিল হয় এরচেয়ে অনেক বেশি। পাসিং ম্রো’র মাসিক আয় যেমন আঙুলে গোনা যায়, আবার কারো কারো মাসিক আয় তো ক্যালকুলেটরেও আটে না।

সমাজে বৈষম্য ছিল, আছে এবং থাকবেও। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, সেই বৈষম্য কমিয়ে আনা, একটা সহনীয় সীমার মধ্যে রাখা। কিন্তু বৈষম্য যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন বুঝতে হয় সার্বিক উন্নয়ন ভাবনায় ভয়ংকর গলদ আছে।

বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয়ের হিসাব তাই কারো কারো জন্য প্রহসন, শুভঙ্করের ফাঁকি। গড় আয়ে পাসিং ম্রো’র আয় যেমন আছে, বসুন্ধরার মালিকের আয়ও তো আছে। গড় আয় হলো সব মানুষের আয় যোগ করে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করা। তাই ২৬০০ ডলার শুনে এখন আর পুলকিত হই না। করোনার সময়ও বাংলাদেশে কোটিপতি বেড়েছে। আবার বেড়েছে গরিব মানুষের সংখ্যাও।

আগেই বলেছি, সমাজে বৈষম্য ছিল, আছে এবং থাকবেও। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, সেই বৈষম্য কমিয়ে আনা, একটা সহনীয় সীমার মধ্যে রাখা। কিন্তু বৈষম্য যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন বুঝতে হয় সার্বিক উন্নয়ন ভাবনায় ভয়ংকর গলদ আছে। সব সম্পদ সমান সমান ভাগ করে দিতে হবে, এমন আকাঙ্ক্ষা অবাস্তব। কিন্তু বণ্টনটা সুষম ও ন্যায্য হতে হবে।

গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শহুরে মধ্যবিত্তের দখলে। সেখানে তাদের হইচই বেশি শোনা যায়। তাদের সমস্যা নিয়েই সবার ভাবনা। মাসিক ৫০ হাজার টাকা আয়েও চারজনের মধ্যবিত্ত সংসার চলে না, এমন সংবাদ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক মানুষগুলোর কথা আমাদের ভাবনায় খুব একটা থাকে না।

বিলাসিতার কথা ভাবাও যাদের জন্য পাপ, তাদের কথা আমাদের ভাবনায় থাকে না। ভোজ্যতেলই তাদের জন্য বিলাসিতা। আপনি তাদের বিনা পয়সায় দিলেও ভোজ্যতেল তারা নেবে না। কারণ তেল দিয়ে রান্না করার মতো মাছ-মাংস তারা চোখেও দেখে না। সেই মানুষগুলোর ভাবনা শুধু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকাটাই তাদের দায়।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, সব মানুষের ঘরেই উন্নয়নের কিছু না কিছু সুফল পৌঁছে দেওয়া। বৈষম্য কমিয়ে আনা। প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাদের দু’বেলা পেট পুরে খাওয়া নিশ্চিত করা। তখন উন্নয়ন ন্যায্য হয়, যৌক্তিক হয়, টেকসই হই, স্বস্তি এবং আনন্দদায়ক হয়।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ