ছবি : সংগৃহীত

ইমরান আহমদ খান নিয়াজি পাকিস্তানের প্রস্থানের পথের প্রধানমন্ত্রী। তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে চায়নায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিক উদ্বোধনে ছিলেন। তিনি বয়কট করেছিলেন বাইডেনের গণতান্ত্রিক সম্মেলন। অন্যদিকে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সব ধরনের আলোচনায় বসাকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। আবার আমেরিকার অনুরোধকে উপেক্ষা করে তিনি রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন শুরুর সময়েই রাশিয়া সফরে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। 

ইমরান আহমদ খান নিয়াজি বলতে পারেন, একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার এ অধিকার অবশ্যই আছে; তিনি কী করবেন আর করবেন না। তার দেশের ফরেন পলিসি তিনি নিজেই নির্ধারণ করবেন। কারো কথা মতো নয়। 

পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন শুনতে ভালো লাগে। যে কেউই বলবেন, এ তো তার ন্যায্য অধিকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান নামক দেশটিতে দাঁড়িয়ে বা তার ক্ষমতায় বসে কি একথা বলা যায়? 

পাকিস্তান নামক দেশটি সৃষ্টি হয়েছিল আল্লাহর নামে। পাকিস্তানের জাতির জনক কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার এক জীবনীকারের কাছে অনেকটা দম্ভ করে বলেছিলেন, তিনি ও তার স্টেনোগ্রাফার ‘আল্লাহ’র নামে মুসলমানদের জন্যে এই দেশ তৈরি করেন।

আর এও সত্য যে, ওই দেশ ১৯৪৭ সালে তৈরি হওয়ার আগে, পাকিস্তান নামক দেশটি তৈরি করতে কেবলমাত্র ১৯৪৬ এর দাঙ্গায় ছাড়া- ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বা সংগ্রামে পাকিস্তানের এই স্রষ্টার কোনো কর্মীর রক্ত দিতে হয়নি। পাকিস্তান যে সময় সৃষ্টি হয় তখন তার দুটি ডানা হয়েছিল। আজকে আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশও তার একটি ডানা ছিল।

পাকিস্তান নামক ওই অদ্ভুত রাষ্ট্র থেকে বের হয়ে আসার জন্যে যখন আমরা সংগ্রাম করি, সে সময়ে তারা মহান আল্লাহ তায়ালার নাম ব্যবহার করে এক সাগর রক্ত ঝরিয়েছিল বাঙালির। তাই দেশের রাজনীতিতে সুযোগে ও বিপদে সবসময়ই মহান আল্লাহ তায়ালার নাম ব্যবহার করে পাকিস্তানের রাজনীতিকরা বা ক্ষমতাসীন সামরিক বাহিনী। 

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেখানে বিভিন্ন রকম ব্যবসা বাণিজ্যতে জড়িত। এমনকি, তাদের নিজস্ব টেলিভিশন চ্যানেলও আছে। যদিও তারা সবসময়ই বলে তারা কখনোই রাজনীতিতে নাক গলায় না।

তবে বাস্তবতা হলো, রাজনীতিক কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই দেশ সৃষ্টি করলেও তিনি বা তার রাজনৈতিক দল বেশিদিন এ দেশের ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। দেশটির ক্ষমতায় বেশিরভাগ সময় থেকেছে আর্মি বা সেনাবাহিনীর লোকেরা। বাস্তবে পৃথিবীর ছয় নম্বর শক্তিশালী আর্মির এ দেশটি নিউক্লিয়ার পাওয়ারসহ সাড়ে ছয় লক্ষ সেনাবাহিনীর দেশ। এবং এটা ওপেন সিক্রেট পাকিস্তানের সেনাবাহিনী মূলত ‘রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র’। এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীই সেখানে সবসময়ই ক্ষমতার পূর্ণ অংশীদার না হলে দিক নির্দেশক থাকে।

তার ওপরে ভারতের সঙ্গে কাশ্মীর ও সীমান্ত নিয়ে সমস্যা, আফগানিস্তান সমস্যা প্রভৃতি মিলিয়ে আর্মির ভূমিকা সেখানে অনেক বেশি সামনে চলে আসে বা দৃশ্যমান। তাছাড়া পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেখানে বিভিন্ন রকম ব্যবসা বাণিজ্যতে জড়িত। এমনকি, তাদের নিজস্ব টেলিভিশন চ্যানেলও আছে। যদিও তারা সবসময়ই বলে তারা কখনোই রাজনীতিতে নাক গলায় না। 

অন্যদিকে কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ু যুদ্ধের সময় থেকে, বলা যেতে পারে সেই ১৯৫০ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে টিকে থাকাসহ নানান কাজে আমেরিকা এই দেশটিকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

আশির দশকে সোভিয়েত রেড আর্মির সঙ্গে যখন তথাকথিত আফগানদের যুদ্ধ হয় সে সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকেই আমেরিকা ওই প্রক্সি ওয়ারে কাজে লাগায়। এবং এখনো অবধি আমেরিকা তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তার সব থেকে বিশ্বস্ত পার্টনার। 

তাই স্বাভাবিকভাবেই বলা হয়, পাকিস্তানে কে ক্ষমতায় যাবেন এবং কে কখন জনপ্রিয় রাজনীতিক হবেন সবকিছুই নির্ভর করে মহান আল্লাহতলার নাম ব্যবহার এবং সেনাবাহিনী ও আমেরিকার ইচ্ছার ওপর।

আল্লাহ, আর্মি এবং আমেরিকা এই তিনটি শব্দ’র শুরু ইংরেজি বর্ণ ‘এ’ দিয়ে। এ কারণে, পাকিস্তানকে অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক কান্ট্রি অব থ্রি ‘এ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। 

পৃথিবীখ্যাত প্রাক্তন ক্রিকেটার যার মূল নাম ইমরান আহমদ খান নিয়াজি, বাস্তবে ইমরান খান নামে পরিচিত তিনিও এই তিন ‘এ’র সহযোগিতায় ক্ষমতায় এসেছিলেন। তা না হলে বাস্তবে এখনো তার দলের এমন কোনো ভিত নেই পাকিস্তানের মাটিতে যে ভোটের রাজনীতিতে তিনি নেওয়াজের মুসলিম লীগ বা ভূট্টো পরিবার নিয়ন্ত্রিত পিপলস পার্টিকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসতে পারবেন। তিনি কীভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন তা সকলেরই জানা। 

বাস্তবে ইমরান দেশ চালাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। দেশের অর্থনীতি একেবারে তলানিতে এসে গিয়েছিল; এ সময়ে বিরোধীদের আন্দোলন সহ্য করার ক্ষমতা আর তার ছিল না। তাই সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বলে, হয়তো আমেরিকারও এর পক্ষে সমর্থন আছে।

কিন্তু এ মুহূর্তে সব থেকে বড় প্রশ্ন ইমরান খান কেন এই থ্রি ‘এ’র দুটি ‘এ’ থেকে সরে গেলেন। তিনি যে পাকিস্তান আর্মি থেকে সরে গেছেন তা বোঝা যায় সে দেশের সেনা প্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া, যিনি আমেরিকা ও কানাডার সামরিক গ্রাজুয়েট এবং পিস কিপিং এ অভিজ্ঞ, তার বক্তব্য থেকে।

ইমরান খান ২ এপ্রিল বলেছেন, বিদেশি একটি রাষ্ট্র তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা করছে। অথচ ১ এপ্রিল সেদেশে অনুষ্ঠিত সিকিউরিটি ডায়ালগে আমেরিকার নাম উল্লেখ না করেও জাভেদ বাজওয়া তার বক্তব্যে বলেন, পাকিস্তান তার দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী বিশেষ দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবে।

১ এপ্রিল সেনাবাহিনীর প্রধানের মুখ থেকে এ বক্তব্য পাওয়ার পরেও ২ এপ্রিল আমেরিকার নাম উল্লেখ না করে তাকে দোষারোপ করেন ইমরান খান। অন্যদিকে ৫ এপ্রিল রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা পাকিস্তান নিয়ে একটি দীর্ঘ বিবৃতি দেন। যার সারাংশ হলো, আমেরিকার কথা না শুনে রাশিয়া সফর করাতে আমেরিকা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছে। অর্থাৎ ইমরান যে বিদেশ বলতে আমেরিকাকেই দোষারোপ করেছিল-সেটা রাশিয়া নিশ্চিত করে দিলো। 

কিন্তু কেন, ইমরান হঠাৎ এমন বিপ্লবী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে গেলেন? এ বিষয়ে পাকিস্তানের বেশিভাগ রাজনীতিক বিশ্লেষকের মত হলো, বাস্তবে ইমরান দেশ চালাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। দেশের অর্থনীতি একেবারে তলানিতে এসে গিয়েছিল; এ সময়ে বিরোধীদের আন্দোলন সহ্য করার ক্ষমতা আর তার ছিল না। তাই সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বলে, হয়তো আমেরিকারও এর পক্ষে সমর্থন আছে। ইমরান খানও ‘এ. আর. ওয়াই’ নিউজের কাছে স্বীকার করেছেন, স্টাবলিশমেন্টের পক্ষ থেকে তাকে সরে যাওয়ার জন্যে তিনটি পথ বলে দেওয়া হয়েছিল।

বাস্তবে যে তিনটি পথ বলা হয়েছিল সে পথে গেলে ইমরানের অন্তত দেশদ্রোহিতা বা দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো না। কিন্তু তিনি অনাস্থা ভোটের আগেরদিনই বলেন, তিনি শেষ বল অবধি খেলবেন। তাই এখন কি ইমরান বুঝতে পারছেন রাজনীতি আর ক্রিকেট এক নয়। আর কান্ট্রি অফ থ্রি ‘এ’-তে কোনো একটি ‘এ’-কে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।  

স্বদেশ রায় ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব