ছবি : সংগৃহীত

ডায়রিয়া বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে, অনেক দিনের রেকর্ড ভঙ্গ হচ্ছে; মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) হাসপাতালে উপচে পড়া ভিড়। হাসপাতালের তাবুতেও বেশুমার রোগী। বঙ্গদেশে ডায়রিয়া অতীব প্রাচীন এক জনস্বাস্থ্য সমস্যা; জনপদের পর জনপদ একসময় উজাড় হয়েছিল এই রোগে।

বছর ত্রিশেক আগেও বাৎসরিক পাঁচ লক্ষাধিক শিশু মৃত্যুর এক তৃতীয়াংশের দায় ছিল ডায়রিয়ার। দিন বদলেছে, ঘরে ঘরে নলকূপ, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা; ডায়রিয়া হলে নুন-গুড় সরবতের কারিশমায় ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু রোগতাত্ত্বিক তালিকার তলানিতে। সেই মঞ্চে আবারও ডায়রিয়া নাটক অভাবিতই বটে। তবে এই নাটক সাধারণ কোনো সমস্যা নয়, একটি বৃহৎ সমস্যার পুনরায় মঞ্চায়ন কোনো মতেই প্রত্যাশিত নয়। এবারের ডায়রিয়া প্রাদুর্ভাবকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়; শহরে বিশেষত, ঢাকায় ও গ্রামীণ।

ঢাকায় ডায়রিয়া সাংবাৎসরিক দুইবার হয়ে থাকে; বর্ষার আগে—মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে এবং বর্ষা উত্তর আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে। সুতরাং এটা ২০২২ সালের বর্ষা পূর্ব ডায়রিয়া। এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, রেকর্ড ভাঙা প্রকোপ কেন? আর ঢাকাইয়া প্রকোপের সাথে গাঁও গেরামের প্রকোপের যোগসূত্র কোথায়?

ডায়রিয়ার কার্যকারণ বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যেতে পারে। বড়দাগে ডায়রিয়া দুই প্রকার; সংক্রমণজনিত এবং অসংক্রামক নানা কারণে ও অসুস্থতা বা রোগশোকে। জনস্বাস্থ্যে আমাদের মাথা ব্যথা সংক্রামক ডায়রিয়া; কারণ আকস্মিক মৃত্যু ও ব্যাপক প্রকোপ।

ঢাকায় ডায়রিয়া সাংবাৎসরিক দুইবার হয়ে থাকে; বর্ষার আগে—মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে এবং বর্ষা উত্তর আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে। সুতরাং এটা ২০২২ সালের বর্ষা পূর্ব ডায়রিয়া। এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, রেকর্ড ভাঙা প্রকোপ কেন?

সংক্রামক ডায়রিয়া মোটাদাগে আবার দুই ধরনের; ওয়াটারি বা জলীয় ডায়রিয়া এবং নন-ওয়াটারি বা আমাশয়। জলীয় ডায়রিয়ার মহাঘাতক হচ্ছে কলেরা; এই পৃথিবীতে এবং বঙ্গদেশে কত শত সহস্র শিশু, যুবা, বৃদ্ধ আমজনতার জীবন অকালে কেড়ে নিয়েছে এই ঘাতক তার কোনো শুমারি নেই।

আমাদের অঞ্চলে স্বল্প আয়ুষ্কালের মূল কারণ ছিল সংক্রামক ব্যাধি এবং তাদের মধ্যে শিরোমনি ছিল কলেরা, ওলাওঠা, ভেদবমি, বিসূচিকা নামের মহাঘাতক। ভিবরিও কলেরি নামের এই জীবাণুর অসংখ্য জাত উপজাত নিঃসৃত টক্সিন বা বিষ হেমলক- আর্সেনিককে যেন হার মানায়।

উপজেলায় মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ১৯৮০-১৯৯০ দশকে এক দুইবারের ভেদবমিতে নিজেও দেখেছি নিস্তেজ রোগী, অবধারিত ত্বরিত জীবনাবসান। আমাদের শরীরে কোষের আশিভাগ যে জল, এক লহমায় তা শুষে নিংড়ে জীবন সংশয়ী জলশূন্য করে দেয়।

জলীয় ডায়রিয়ার আরেকটি বড় কারণ ইটেক [Enterotoxigenic Escherichia coli (ETEC)] নামে ই কলাই জীবাণু। এছাড়াও আরও কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস এমন ডায়রিয়া তৈরি করে।

ডায়রিয়ার আরেক রূপ আমাশয়; সাদা আমাশয় ও রক্ত আমাশয়। সাদা আমাশয় অ্যামিবা নামে একটি পরজীবী দ্বারা এবং রক্ত আমাশয় মূলত ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এবং কখনো কখনো রোটা ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। শিশু থেকে বয়স্ক নির্বিশেষে কলেরা দ্বারা এবং শিশুদের ক্ষেত্রে রোটা ভাইরাস দ্বারা ব্যাপক মৃত্যু হতে পারে।

ডায়রিয়ার ঘটক হচ্ছে দূষিত পানি ও খাবার। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, এইবার যে ব্যাপক আকারে ডায়রিয়া বা কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে তার ঘটকও পানি ও খাদ্যের দূষণ।

রাজধানীর শহরতলিতে বিশেষত, নিম্নবিত্ত এলাকাগুলোতে ওয়াসা সরবরাহকৃত পানির দূষণ হতেই ঢাকার এবং অন্যান্য শহরে পৌরসভা সরবরাহকৃত দূষিত পানি থেকে এই ডায়রিয়ার প্রকোপ।

বর্তমান ডায়রিয়া প্রাদুর্ভাব কমাতে হলে আমাদের আপদকালীন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন আবশ্যক। ঢাকা মহানগরী ও আশেপাশের হটস্পটগুলো শনাক্ত করে সেখানে কলেরা ও ডায়রিয়া বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি।

সাধারণত খরা, বন্যা বা দুর্ভিক্ষ হলে কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটে; এবারে মার্চ মাসে আমাদের দেশে অস্বাভাবিক গরম পড়েছে, পারদের মাত্রা বেড়েই চলেছে, অকালের বৃষ্টিও নেই। খালবিল নদী জলাশয়ের পানি কমতে কমতে তলানিতে নেমেছে এবং জলে বিরাজিত কলেরা বা অন্যান্য ডায়রিয়ার জীবাণুর ঘনত্ব বেড়ে যায়।

গরমের কারণে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পানি পানের সাথে তদস্থ ডায়রিয়া জীবাণু গলাধকরণ করায় বিপত্তি ঘটে অন্ত্রে। সুযোগশালী মানুষেরা অফুরন্ত গ্যাসে তুলনামূলক ভালো পানি ফুটাতে ফুটাতে তলানিতে নামায়, সুযোগহীন মানুষেরা জীবাণুযুক্ত পানি পিপাসাক্রান্ত হয়ে গল গল করে পান করতে গিয়ে কলেরার ফাঁদে পড়ছে। একটাই স্বস্তি যে, বিত্তহীন মানুষেরাও ডায়রিয়া হলে লবণজলের শরবত পান করে এবং আমাদের ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনা ও বিশ্বমানের বিধায় মৃত্যু তুলনামূলকভাবে কম।

বর্তমান ডায়রিয়া প্রাদুর্ভাব কমাতে হলে আমাদের আপদকালীন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন আবশ্যক। ঢাকা মহানগরী ও আশেপাশের হটস্পটগুলো শনাক্ত করে সেখানে কলেরা ও ডায়রিয়া বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি।

পানির দূষণ উৎস উদ্ঘাটন, বড় বড় পানির ট্যাংকে হটস্পটগুলোতে পানি সরবরাহ, জনস্বাস্থ্য দলের তত্ত্বাবধানে হটস্পটে আক্রান্ত পরিবারে একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।

আরও বড় প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে হটস্পটগুলোতে ওরাল কলেরা ভ্যাকসিন প্রদান, পানির দূষণ উৎস নির্মূল করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্য চিরকালীন নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা; শহরে সরবরাহকৃত পানিকে সর্বদা নিরাপদ রাখা, গ্রামাঞ্চলে অগভীর ও গভীর নলকূপের মাধ্যমে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা জরুরি।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক