ছবি : সংগৃহীত

সর্বশেষ ২০১৭ সালে যখন হাওর ডুবির ঘটনা ঘটল সেইসময় বাঁধ নির্মাণের কাজ না হওয়া, সামান্য মাটি আর বালু দিয়ে কোনো রকম বাঁধের কাজ করা, কাজ পেয়ে কয়েক হাতবদলসহ নানা অভিযোগ আলোচনায় আসে। অনেক অভিযোগের তদন্তে সত্যতাও পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিকার মেলেনি। 

এবারও হাওর অধ্যুষিত সাতটি জেলার ফসল হুমকির মুখে। আগাম পাহাড়ি ঢলে একের পর এক সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন জেলায় হাওর তলিয়ে যাওয়ার খবর আসছে। অকাল বন্যায় অন্ধকার দেখছে কৃষক। চোখের সামনে ভাঙছে বাঁধ। ডুবছে আশার ফসল। তাই হাওর পাড়ের মানুষের মন ভালো নেই। চোখে জল। অনেকেই নিরুপায় হয়ে কাঁচা ধান কাটছেন। অথচ মাত্র ক’দিন পরেই ফসল ঘরে তোলার কথা ছিল। উৎসব হওয়ার কথা ছিল দেশের গোটা পূর্বাঞ্চলে। 

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ গোটা পৃথিবীজুড়ে সংকটের মাত্রা বাড়িয়েছেবেড়েছে পণ্যের দাম, জীবন যাত্রার ব্যয়। এরমধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট। অভাবে রীতিমতো হাহাকার চলছে। যুদ্ধের প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও পড়েছে। চালের দাম বাড়ার পাশাপাশি অন্যান্য নিত্যপণ্যের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সমালোচনা চলছে বহুদিন। এরমধ্যে এবারও যদি গোটা হাওরের ফসল পানিতে নষ্ট হয়, তবে দেশজুড়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই সুযোগে চালের দাম আবারও বাড়াবে সিন্ডিকেট চক্র। এটাই চিন্তার বিষয়। 

সুনামগঞ্জসহ গোটা হাওরাঞ্চলে ফসল ডুবে যাওয়ার ঘটনা তো নতুন নয়। ভাটি এলাকার প্রথা অনুযায়ী, প্রতি তিন বছর পর একবার ফসল ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এই হিসাবে স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত কমপক্ষে বিশবার কৃষকের সোনালি ফসল খেয়েছে সর্বনাশা পানি, অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অথচ ফসল রক্ষায় এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। 

যেসব বাঁধের কথা শোনা যায় সেগুলো তো পানির প্রথম চাপই প্রতিরোধ করতে পারে না! কথা হলো বিকল্প কি কোনো ব্যবস্থা নেই? ব্লক দিয়ে শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা তো করা যায়। তাহলেও ফসল কিছুটা হলেও রক্ষা করা যেতে পারে। কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পারে কৃষক ও হাওর পাড়ের মানুষ। 

অকাল বন্যায় অন্ধকার দেখছে কৃষক। চোখের সামনে ভাঙছে বাঁধ। ডুবছে আশার ফসল। তাই হাওর পাড়ের মানুষের মন ভালো নেই। চোখে জল।

লক্ষণীয় হলো, যতবারই ফসল ডুবে যায়, ততবারই এর কারণ হিসেবে দেখা যায়, নির্মাণ ত্রুটি কিংবা সময়মতো বাঁধ সংস্কার না করা। দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে বদলি করা হয়। এই সাজাকে অনেক সময় সাজাপ্রাপ্তরা সাজা নয় বরং পুরস্কার হিসেবে উপভোগ করেন। এর বাইরেও ফসল ডুবে যাওয়ার আরও কিছু কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কঠিন। কিন্তু যতটুকু রক্ষা সম্ভব তাও তো হচ্ছে না।

প্রতি বছর বর্ষা শেষে বোরো ফসল রক্ষায় একই বাঁধ বারবার পুনরায় নির্মাণ করা হচ্ছে। অথবা বিকল্প বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে নতুন নতুন বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ ও অর্থ বরাদ্দ দেখা যায়। এতসব উদ্যোগ নেওয়ার সুফল কতটা মিলেছে? একদমই না। অর্থাৎ আগাম বন্যার হাত থেকে ‘বাঁধ’ হাওর রক্ষা করেছে এমন নজির নেই। পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধ ভেঙে যায়। অথচ ব্লক দিয়ে শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হলে হয়তো পানি উপচে হাওর তলিয়ে যাবে, তবুও কিছুটা সময় পাবে কৃষক। 

৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জের শাল্লার ‘কৈয়ার’ হাওরের বাঁধ পানির স্রোতে ভাঙতে দেখা যায়। আগের দিন থেকেই এলাকার নদীর পানি বাড়ছিল। শোনা যাচ্ছিল, বিপদগ্রস্ত কৃষকদের আহাজারি। শেষ পর্যন্ত দুর্বল বাঁধ ২৪ ঘণ্টাও পানির চাপ সামলাতে পারেনি। যে অংশটি ভেঙেছে সেখানে দেখা গেছে, কোনো রকম মাটি ফেলে রাখা হয়েছে। মাটি বসানো পর্যন্ত হয়নি। এমন দায়সারা বাঁধে তো প্রতি বছর টাকাই ব্যয় হবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের কোনো কাজে আসবে না। 

অনেক হাওর রক্ষায় গ্রামবাসীসহ স্থানীয় প্রশাসন রাতদিন কাজ করছে। তবুও মাটি ফুরিয়ে পানি নামছে নিচু জমিতে! এভাবেই হাওর এলাকায় একের পর এক দুঃসংবাদ ভাসছে আকাশে বাতাসে। বাড়ছে মানুষের কান্না আর আহাজারি। সেই সঙ্গে আগামী দিন কীভাবে চলবে সেই দুশ্চিন্তার রেখাও এই অঞ্চলের মানুষের কপালে। 

অভিযোগ আছে, সুনামগঞ্জের ফসল রক্ষা বাঁধ গত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্মাণের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। বাঁধ নির্মাণে কোনো ধরনের অনিয়ম হলে কাঠোর হস্তে দমন করার কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল বোর্ডের পক্ষ থেকে। কে শোনে কার কথা? বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশে ‘কজওয়ে’ নির্মাণের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। হয়নি সময়মতো বাঁধ, হয়নি কজওয়ে।

হাওর এলাকায় একের পর এক দুঃসংবাদ ভাসছে আকাশে বাতাসে। বাড়ছে মানুষের কান্না আর আহাজারি। সেই সঙ্গে আগামী দিন কীভাবে চলবে সেই দুশ্চিন্তার রেখাও এই অঞ্চলের মানুষের কপালে।

এবছর ৭২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ৫৩২ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭২৪ কোটি টাকা। যাদের অবহেলায় সময়মতো কাজ হয়নি তারা কি এবারও বিচারের আওতায় আসবে? নাকি রাজনৈতিক তদবিরে যেভাবে কাজ পাওয়া গেছে সেভাবেই সবাই সুরক্ষার আওতায় আসবে? কে দায় নেবে এই ভয়াবহ সর্বনাশের? 

গত দুই মার্চ সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ধীরগতির পাশাপাশি ৫৮ ভাগ ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনে অনিয়ম হয়েছে বলে উঠে এসেছে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার জরিপে। রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণশুনানি ছাড়াই পিআইসি গঠনেরও অভিযোগ রয়েছে।

জরিপে বলা হয়েছে, সরকার নির্ধারিত সময়ে মাত্র ৮ ভাগ ফসল রক্ষা বাঁধে শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাকি ৯২ ভাগ বাঁধের আংশিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সবমিলিয়ে বাঁধে মাটি ভরাট, ঘাস লাগানোসহ সার্বিকভাবে গড়ে ৬২ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৭২২টি বাঁধের মধ্যে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে ১০৮টি বাঁধের উপর তারা এই জরিপ পরিচালনা করেন। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, মাত্র ৮ ভাগ বাঁধে মাটির কাজ সম্পন্ন হয়। ঘাস লাগানো হয়েছে ৩ ভাগ বাঁধে।

সংশোধিত কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালা অনুযায়ী ৫০ মিটার দূর থেকে বাঁধের মাটি আনার কথা থাকলেও ৩৫ ভাগ বাঁধে এই নিয়ম মানা হয়নি। অনিয়মের মাধ্যমে বাঁধের কাছ থেকে মাটি দেওয়া হয়েছে। যেসব বাঁধে মাটির কাজ সম্পন্ন করা হয়নি, এসব বাঁধে দুরমুজ (কম্পেকশন) ও ঢাল বজায় রাখার কাজও অসম্পূর্ণ। 

নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ার পেছনে প্রকল্প প্রাক্কলন ও পিআইসি গঠনে বিলম্ব, অর্থ ছাড়ে বিলম্ব, হাওর থেকে দেরিতে পানি নামা ও ড্রেজার মেশিনের স্বল্পতা রয়েছে। এছাড়া বাঁধের মাটির দুষ্প্রাপ্যতা ও প্রকল্প গঠনে অনিয়মের সমস্যা পুরনো। হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের বিকল্প হিসেবে উজান ও ভাটিতে নদী খনন জরুরি। নির্মাণ করতে হবে স্থায়ী বাঁধ, খনন করতে হবে নদী।

রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ পাওয়া বন্ধ, কাজের হাত বদল ঠেকানো জরুরি। বিচারের আওতায় আনতে হবে অপরাধীদের। অন্যথায় হাওরের সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না। নষ্ট হবে ভাটির মূল্যবান সোনালি ফসল।

রাজন ভট্টাচার্য ।। সাংবাদিক ও কলাম লেখক