২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে। এই পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যের গতিপথ নিয়ে আলোচনার শুরুতে একটু পেছন ফিরে দেখতে চাই। কারণ ভাবনার রূপান্তর সাহিত্যের সময়ের প্রতিকৃতি। এই সময়ের নানা উপাদান সাহিত্যে ধারণ করে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছে। অন্যদিকে আঙ্গিকের বিচারে নানা লেখকের নানা ভাবনা সামনে এসেছে।

সাতচল্লিশ পরবর্তী সময় থেকে পূর্ববঙ্গের সেই সময়ের লেখকেরা ব্যতিক্রমী ধারার সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোত থেকে ভিন্ন খাতে ছিল সেই ধারা। পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা তাদের নিজস্ব রচনা নিজেদের বয়ানে লিখেছেন। পূর্ববঙ্গের লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আবুল ফজল, আবু জাফর শামসুদ্দীন, মুনীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমানসহ আরও অনেকে পঞ্চাশের দশকে নিজেদের সাহিত্যের ভূমি তৈরি করেছিলেন আধুনিকতার যাত্রায়।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে কয়েকটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদনার সূত্রে এসব গল্প আমাকে পড়তে হয়েছে। মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর জীবন বিভিন্ন লেখকের চিন্তায় নানাভাবে উঠে এসেছে।

তারা ভাষা আন্দোলন দেখেছেন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন দেখেছেন, পাকিস্তান সরকার থেকে বঞ্চনার জায়গা দেখেছেন, পঁয়ষট্টির যুদ্ধ, চৌষট্টির দাঙ্গা ইত্যাদি তাদের সাহিত্যের নতুন উপাদান ছিল। এই জীবনপ্রবাহ নির্মাণ করেছিল সাহিত্যের ভুবন। তারপর আসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালি যে জীবনবোধের সংযোজন ঘটিয়েছে বাংলাদেশের সাহিত্যে তা তাদের জীবন বৈচিত্র্যের নানামাত্রার আলেখ্য। পাশাপাশি তারা গণ মানুষের নানাদিকের ছবি যেমন তুলে ধরেছেন যৌবন, প্রেম, বিরহ, বেদনা, আনন্দের সংযোজন ঘটিয়েছেন নানাভাবে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মনস্তাত্ত্বিক দিকও উঠে এসেছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের চর্চা করেছেন লেখকরা। নবীন লেখক যারা যুদ্ধকালে শৈশব কাটিয়েছে, আবার যারা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণ করেছে তারাও মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য ঘটনা নানাভাবে সংগ্রহ করে গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটক লিখেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও গল্প-উপন্যাস রচিত হয়েছে।

২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে কয়েকটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এটিও বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাবনার নতুন পরিসর। বাংলা একাডেমীসহ বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে যেসব সংকলন প্রকাশিত হয়েছে তাতে একশ’র বেশি গল্প লেখা হয়েছে। সম্পাদনার সূত্রে এসব গল্প আমাকে পড়তে হয়েছে। মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর জীবন বিভিন্ন লেখকের চিন্তায় নানাভাবে উঠে এসেছে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের চিন্তার পুনরাবৃত্তি নেই।

করোনার দুর্যোগ বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনকে ঘায়েল করেছে। বাংলাদেশের এই দুর্যোগ উঠে এসেছে সাহিত্যে। এই সময়কে খুবই অল্প সময়ে ধারণ করার ধারণ করেছে গল্প-কবিতায় লেখকরা। এভাবে সাহিত্যের ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে।

সময়ের ভাবনার পরিবর্তন সাহিত্যের জন্য একটি বড় পরিসর। পঞ্চাশ দশকে রচিত সাহিত্য একবিংশ শতাব্দীর লেখকরা নিঃসন্দেহে একই বিষয়ে এবং একই চিন্তার পুনরাবৃত্তি করবে না। কারণ সময়ের অগ্রগতিতে জীবনের নানা দিকে পরিবর্তন আনে। রূপান্তরিত হয় মানুষের জীবনের ধারাবাহিকতা। তাই ভাবনার পরিবর্তন সাহিত্যের জন্য এক অনিবার্য বিষয়। নতুন সময়ের নতুন দিক উঠে আসে সাহিত্যে। বাংলাদেশের সাহিত্যেও ভাবনার পরিবর্তন পূর্ণমাত্রা লাভ করে।

২০২০ সালে করোনার দুর্যোগ বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনকে ঘায়েল করেছে। বাংলাদেশের এই দুর্যোগ উঠে এসেছে সাহিত্যে। এটি ভাবনায় সংযোগ। জীবনের গল্পের পূর্ণ মাত্রা। পাশাপাশি আছে অর্থনৈতিক দুর্যোগ মানুষের জীবন প্রবাহের ভিন্ন মাত্রা। এই সময়কে খুবই অল্প সময়ে ধারণ করার ধারণ করেছে গল্প-কবিতায় লেখকরা। এভাবে সাহিত্যের ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে।

বাংলাদেশের সাহিত্যে গত পঞ্চাশ বছরে উঠে এসেছে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংযুক্ত উপাদানের নানাদিক। এজন্য বলতে হবে পঞ্চাশ বছরের সাহিত্য আমাদের সাহিত্যকে বেগবান রেখেছে। লেখকরা চলমান জীবনের ধারাবাহিকতার সঙ্গে যুক্ত করেছে সময়ের বিস্তৃত পরিসর থেকে পাওয়া নানা দিক। কোনোভাবেই বাংলাদেশের সাহিত্য সময়কে না ধরে পিছুটানে থেমে নেই। নবীন লেখকরা নিজেদের সময়কে ধারণ করছে নিজেদের দক্ষতার শৈল্পিক বিন্যাসে।

সেলিনা হোসেন ।। কথাসাহিত্যিক