ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ নিয়ে যারা লেখালেখি করেন তারা দুটি সমস্যা এক করে দেখার পক্ষে নন। সাম্প্রদায়িকতার অর্থ হলো, এক ধর্মের মানুষ বিশেষ বিশেষ কারণে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের ঘৃণা, বৈষম্য বা আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করা। পক্ষান্তরে ধর্মীয় মৌলবাদী বলতে তাদেরকে বোঝানো হয় যারা নিজেরা ধর্মের রীতিনীতি কঠোরভাবে পালনের পক্ষে। নিজেরা ব্যক্তি জীবনে পালন না করলেও অন্যদের উপর তা চাপিয়ে দেন।

বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম এবং তাদের সমচরিত্রের রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে গবেষকরা মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গত দুই দশক যাবৎ আমরা লক্ষ্য করছি বাংলাদেশকে একটি মনোলিথিক মুসলিম রাষ্ট্র বানাবার উদ্দেশ্যে মৌলবাদী দলগুলো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের উপর ধারাবাহিকভাবে হামলা করছে। ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার সিংহভাগের জন্য দায়ী ছিল জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনের পর জামায়াত-বিএনপির জোট ক্ষমতায় আসার পরও এই নির্যাতন অব্যাহত ছিল।

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াতের সন্ত্রাসী বাহিনী সারা দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। হামলার সময় তারা বলেছে হিন্দুদের সাক্ষীর কারণে নাকি সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। সত্য হচ্ছে, সাঈদীর মামলায় সরকার পক্ষে ২৮ জন সাক্ষীর ভেতর মাত্র ২ জন ছিলেন ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু এবং এদের জন্য সারা বাংলাদেশের হিন্দুদের দায়ী করা হয়েছে। হিন্দুদের উপর হামলার জন্য জামায়াত ও সমগোত্রীয়দের অজুহাতের অভাব হয় না।

মুসলিম মৌলবাদীরা যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে কিংবা করতে চায় তারা ভিন্নমত বা ভিন্ন ধর্মের কাউকেই রেহাই দেয় না। পাকিস্তানে মৌলবাদীরা ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন করেছে আল্লাহ, রসুল, কোরান, হাদিস যা ইসলাম ধর্মের সমালোচকদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের জন্য। এই আইন প্রণয়নের পর সবচেয়ে বেশি শাস্তি ভোগ করেছে পাকিস্তানের খ্রিস্টানরা। পাকিস্তানে এখন নামে মাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু আছে যাদের অধিকাংশ খ্রিস্টান। হিন্দুরা আগেই দেশত্যাগ করেছে।

২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার সিংহভাগের জন্য দায়ী ছিল জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনের পর জামায়াত-বিএনপির জোট ক্ষমতায় আসার পরও এই নির্যাতন অব্যাহত ছিল।

দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িক, বিদ্বেষ ও সহিংসতাকে রাজনৈতিক সামাজিক ও সংগঠিত রূপ দিয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা। তাদের ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি অনুযায়ী তারা ধর্মীয় বিভাজনকে বেছে নিয়েছিল তাদের শাসন-শোষণ নিরঙ্কুশ করার জন্য। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা ভারতবর্ষের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস লিখতে গিয়ে কালপর্বের নাম করেছে ধর্মের নামে। যেমন প্রাচীনকাল হিন্দু যুগ, মধ্য যুগ মুসলমানদের, কিন্তু ঔপনিবেশিক কাল খ্রিস্টানের নয়, সেটি আধুনিক যুগ। কলোনি-শাসন নির্বিঘ্ন করাই ছিল ইতিহাসের সাম্প্রদায়িকতার বৈশিষ্ট্য।

এই সাম্প্রদায়িকতার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ছিল ১৯৪৭-এর দেশভাগ। দু’শ বছর রাজত্ব করে, ভারতবর্ষের যাবতীয় সম্পদ লুণ্ঠন করে, উত্তরাধিকারী হিসেবে এক দঙ্গল ‘ব্রাউন সাহেব’ রেখে বিদায় নেয়ার আগে এই উপমহাদেশকে এমনভাবে তারা বিভক্ত করেছে যাতে ভবিষ্যতে বেশিরভাগ সময় দুই দেশের মানুষ যুদ্ধরত বা যুদ্ধাবস্থায় থাকে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেও প্রথম জীবনে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্ব বা রাজনৈতিক ইসলামে বিশ্বাসী ছিলেন না। ইংরেজরা প্রথমে স্যার সৈয়দ আহমেদকে উৎসাহিত করেছে মুসলিম জাতীয়তাবাদের কথা বলতে। ভারতবর্ষে মুসলমানরা যে একটি পৃথক জাতি এ কথা জিন্নাহ ও ইকবালের আগে স্যার সৈয়দ আহমদ বলেছিলেন পাকিস্তানের জন্মের প্রায় আট দশক আগে।

পাকিস্তানের ভারত বিদ্বেষের প্রধান কারণ যত না রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক তার চেয়ে বেশি আদর্শিক। ভারতের রাষ্ট্রনায়করা প্রধানত: বহু ধর্ম-ভাষা-জাতি-বর্ণভিত্তিক ভারতবর্ষের অখণ্ডতা রক্ষা প্রয়োজনে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যেহেতু ভারত ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে সেহেতু পাকিস্তানের কাছে এই নীতি, শুধু পাকিস্তানের মতাদর্শের বিরোধী নয়, ইসলামেরও বিরোধী। পাকিস্তান জন্মের পর থেকে নাগরিকদের এটি বোঝানো হয়েছে ভারত একটি হিন্দু রাষ্ট্র, হিন্দুরা কখনও মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না, পাকিস্তানের শত্রু রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তানে হিন্দুদের কোনও স্থান নেই। এ কারণেই পাকিস্তানের শাসকদের যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য, শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে যখনই কোন আন্দোলন হয়েছে তাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ভারত ও হিন্দুদের পাকিস্তান ও ইসলামবিরোধী চক্রান্ত হিসেবে। ১৯৪৮-৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির সকল গণতান্ত্রিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পাকিস্তানি শাসকরা ইসলাম ও পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিরোধী আখ্যা দিয়ে নির্মমভাবে দমন করতে চেয়েছে।

৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু এ কারণে হয় নি যে, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নির্বাচিত গণ প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে সামরিক অভিযান চালিয়ে গণহত্যার পথ অবলম্বন করেছিল। আপাত কারণ এটি হলেও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক পটভূমি নির্মাণ করেছে ধর্মের নামে অপশাসন, শোষণ, পীড়ন ও বৈষম্যকে বৈধতা প্রদান। জন্মের পর থেকে বাংলাদেশকে উপনিবেশ বিবেচনা করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তান জন্মের পর দুই যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে ধর্মের নামে যাবতীয় দুষ্কর্মকে বৈধতা প্রদানের কারণে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িক, বিদ্বেষ ও সহিংসতাকে রাজনৈতিক সামাজিক ও সংগঠিত রূপ দিয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা। তাদের ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি অনুযায়ী তারা ধর্মীয় বিভাজনকে বেছে নিয়েছিল তাদের শাসন-শোষণ নিরঙ্কুশ করার জন্য।

বাংলাদেশের মানুষ যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনের ক্ষেত্রে আগ্রহ থাকলেও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় ছাড়া সাধারণভাবে কখনও তারা পছন্দ করেনি। উনিশ শতকে ওহাবি আন্দোলন মুসলমানকে আরও বেশি মুসলমান বানাতে চেয়েছে বটে-এর আবেদন শহরের এলিটদের ভেতরই সীমাবদ্ধ ছিল। ওহাবিদের হাজারও বিরোধিতা সত্ত্বেও গ্রাম বাংলার মুসলমান মিলাদ পড়া, মাজার জিয়ারত, ওরস, গান বাজনা ইত্যাদি পরিত্যাগ করে নি। এমন কি সত্যপীর, ওলাই বিবি, বদরপীর, বনবিবি এসব লোকায়ত ধর্মীয় আচরণও বর্জন করে নি।

বাঙালি মুসলমান প্রধানত: অর্থনৈতিক কারণে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল, কারণ বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ জমিদার, মহাজন, তালুকদার ছিলেন ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের। শোষণ-পীড়নের ধর্মীয় পরিচয় না থাকলেও পাকিস্তান আন্দোলনের নেতারা বাঙালি মুসলমানদের কিছু সময়ের জন্য বোঝাতে পেরেছিলেন হিন্দু জমিদাররা যেভাবে মুসলমান প্রজাদের শোষণ-পীড়ন করছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এর উল্টোটা হবে। উপমহাদেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থী রাজনীতির অনুসারীরা সাধারণ মানুষকে তখন এটা বোঝাতে পারেন নি যে, জমিদার হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক শোষণ-পীড়নের ক্ষেত্রে প্রজাদের ধর্ম বিবেচনা করে না। হিন্দু জমিদারের অত্যাচার থেকে হিন্দু প্রজা যেমন রেহাই পায় না, মুসলমান জমিদারের নির্যাতন থেকেও স্বধর্মী প্রজা রেহাই পায় না।

১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগের পর পাকিস্তান সম্পর্কে বাঙালি মুসলমানদের মোহভঙ্গের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি, যখন পাকিস্তানের আইনসভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই দাবিকে হিন্দু ও ভারতের পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেন। ৪৮-৫২’র ভাষা আন্দোলনের বিজয়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪-এর নির্বাচনে বাংলাদেশের মাটিতে মুসলিম লীগের রাজনীতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

দলীয় রাজনীতির শোচনীয় বিপর্যয়ের পর পাকিস্তানি শাসকদের অবলম্বন ছিল সশস্ত্র বাহিনী। পাকিস্তানে এখন রাজনৈতিক দল থাকলেও সরকার ও প্রশাসনের যাবতীয় নীতিনির্ধারণে মুখ্য ভূমিকায় থাকে সামরিক বাহিনী। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’কে বলা হয় সরকারের চেয়েও ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক সত্ত্বা নির্মাণে, জঙ্গি মৌলবাদী দর্শনের ভিত নির্মাণে ‘আইএসআই’ যে অঢেল অর্থ ব্যয় করে তার অভিঘাত থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়।

ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্র ও রাজনীতির মেলবন্ধনের পরিণতি কি ভয়ঙ্কর হতে পারে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে পাকিস্তান। গণতন্ত্রহীনতা, জাতিগত ও সাংস্কৃতিক নিপীড়ন, কলোনি সুলভ শোষণ ও বঞ্চনা এবং সর্বোপরি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে ৭১-এ বাংলাদেশে ত্রিশ লক্ষ নিরীহ মানুষ হত্যা, সোয়া চার লক্ষ নারীর উপর পাশবিক নির্যাতন, এক কোটি মানুষকে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়ন সবই বৈধকরণের অপচেষ্টা হয়েছে ইসলামের দোহাই দিয়ে। যে কারণে চরম মূল্যে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হয়েছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে।

বঙ্গবন্ধুর সময়ে বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানসূচি আরম্ভ হতো চার প্রধান ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের মাধ্যমে। ...বঙ্গবন্ধু সেকুলারিজমের বাংলা করেছিলেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। ...১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ মুছে ফেলে...

স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক বছরের ভেতরই গৃহীত হয়েছিল এক অনন্য সাধারণ সংবিধান, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের পাশাপাশি ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল যা ইতিপূর্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির ও তুরস্ক ছাড়া বিশ্বের অন্য কোন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশেও করা সম্ভব হয়নি।

স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ধর্মপরায়ণ ছিলেন। পাকিস্তানের কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কিংবা তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের মতো ধর্মনিরপেক্ষ বা নাস্তিক ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। কামাল আতাতুর্কের সেকুলারিজমের বোধের ভেতর ধর্মের কোন স্থান ছিল না, যেমনটি নেই পশ্চিমে। বঙ্গবন্ধুর সেকুলারিজমের বোধের ভেতর ধর্মের জায়গা ছিল। তিনি মদ্যপান, রেস বা জুয়াখেলা নিষিদ্ধ করেছিলেন ইসলাম বিরোধী বলে। তাঁর সময়ে বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানসূচি আরম্ভ হতো চার প্রধান ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার এই ধারণাকে তখন বাম বুদ্ধিজীবীরা সমালোচনা করেছেন। বঙ্গবন্ধু সেকুলারিজমের বাংলা করেছিলেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। তখন এর সমালোচনা হয়েছে- সেকুলারিজমের প্রকৃত বাংলা ‘ইহজাগতিকতা’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা নয়’। বঙ্গবন্ধু জেনে বুঝেই সেকুলারিজমের বাংলা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ করেছিলেন। কারণ তিনি কামাল আতাতুর্কের মতো ধর্মকে নির্বাসনে পাঠাতে চাননি।

১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ মুছে ফেলে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির যে ‘পাকিস্তানিকরণ’ ও ‘ইসলামীকরণ’ প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছিলেন তার মাশুল এখনও দিতে হচ্ছে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগেরও অনেক নেতা এখন ‘বিসমিল্লাহ...’ বলে বক্তৃতা শুরু করেন। তারপরও ২০০৮ সালে তিন চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছে। তবে পাকিস্তানপন্থী দুই জেনারেল জিয়া ও এরশাদের ভণ্ডামির কিছু অংশ সংবিধানে এখনও রেখে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা হলেও এখনও সংবিধানের মাথায় ‘বিসমিল্লাহ...’ এবং ভেতরে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ অক্ষুণ্ণ আছে।

মৌলবাদীদের তুষ্ট করবার জন্য সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ রেখেও আওয়ামী লীগ তাদের অপপ্রচারের বিষাক্ত ছোবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছত্রছায়ায় গজিয়ে ওঠা ‘হেফাজতে ইসলাম’-এর নেতারা প্রকাশ্য জনসভায় বলেছেন শেখ হাসিনা ও তার সরকার হচ্ছে নাস্তিকদের সরকার, ইসলামের দুশমন এবং এই জালেম ও দুশমন সরকারকে গদি থেকে হটাতে হবে।

২০১৩-এর ৫ মে বিএনপি ও জামায়াতের সহযোগিতায় হেফাজতে ইসলাম শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেছিল, যা শেষ মুহূর্তে ভেস্তে গেছে বটে কিন্তু তথাকথিত নাস্তিকদের বিরুদ্ধে তাদের জিহাদ অব্যাহত রয়েছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার উৎখাতের আন্দোলন করতে গিয়ে প্রতিদিন জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। একটানা হরতাল অবরোধ দিয়ে অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চেয়েছে। হেফাজত-খেলাফত ইত্যাদি দল নিজেদের জামায়াত বিরোধী বলে সরকারের প্রিয়পাত্র হতে চাইছে বটে, অন্তিমে এরা সবাই মওদুদিবাদী, ওহাবিবাদী রাজনৈতিক ইসলামের ধ্বজাধারী জিহাদি।

বর্তমানে মুসলমান প্রধান ৫৭টি দেশের প্রায় সর্বত্র ইসলামী দল কিংবা তাদের সমমনারা ক্ষমতায় আছে। একমাত্র বাংলাদেশেই এখন পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী দল ক্ষমতায় আছে, যে দেশে বিচার বিভাগ এখনও ধর্মনিরপেক্ষ, এখনও শরিয়া আইন এ দেশে চালু হয়নি। তবে ৭২-এর সংবিধানের মতো ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে এখনও বাংলাদেশের গায়ে ধর্মনিরপেক্ষতার যতটুকু ছাপ আছে ভবিষ্যতে তা থাকবে কি না বলা মুশকিল।

শাহরিয়ার কবির ।। কার্যকরী সভাপতি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি