ছবি : সংগৃহীত

গরম মাত্রা ছাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডল এপ্রিল ও মে—এই দুই মাস উত্তপ্ত থাকে। শীতের পর সূর্যের উত্তরায়ণ ঘটে। অর্থাৎ সূর্য কিরণ লম্বভাবে এ অঞ্চলে পড়ে।

এই সময় বাংলাদেশের উপর দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে যে সামান্য জলীয়বাষ্প আসে তা তাপমাত্রা কমিয়ে রাখে। কিন্তু এবার সেই দখিনা বাতাস খুবই কম এসেছে। ফলে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক কম। তাই তাপমাত্রা বেড়েছে। আগামী কয়েকদিন তাপপ্রবাহ থাকতে পারে এই অঞ্চলে। বৃষ্টি হলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ১০০ বছরে দেশের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। ২০২১ সালের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ৯টি জেলার তাপমাত্রা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশিদিন প্রচণ্ড গরম থাকে যশোরে।

এই জেলায় বছরে গড়ে ৭৫ দিন আবহাওয়া বেশি উষ্ণ ছিল, যা রাজশাহী (৬৭ দিন) ও ঈশ্বরদীর (৫৮ দিন) চেয়ে বেশি। গবেষণায় আরও উঠে আসে যে, ঢাকায় বছরে ৩৬ দিন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি গরম ছিল।

আরও পড়ুন : বিশ্ব পরিবেশ দিবস : আমাদের ব্যর্থতা ও করণীয়

বাংলাদেশে মহানগরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ জেলা ও উপজেলা শহর এবং গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশকে পরিকল্পিতভাবে ভূমির ব্যবহার করতে হবে, যেখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য জলাভূমি, বনাঞ্চল টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা থাকবে।

উল্লেখ্য, যশোরে বেশিদিন প্রচণ্ড গরম থাকার কারণ হিসেবে ভৈরব ও মুক্তেশ্বরী নদীর মৃতপ্রায় দশা ও সুন্দরবনের বিস্তৃতি কমে যাওয়াকে দায়ী করা হয়। সুন্দরবন একসময় যশোরের একটি অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

বিশ্বজুড়েই তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর উপায় খুঁজতে এখনো পিছিয়ে রয়েছে বিশ্ব। গবেষকদের বিশ্লেষণ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ২০৩৭ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা এখনকার তুলনায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। আর ২০৫১ সাল নাগাদ তা আরও ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশে মহানগরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ জেলা ও উপজেলা শহর এবং গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশকে পরিকল্পিতভাবে ভূমির ব্যবহার করতে হবে, যেখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য জলাভূমি, বনাঞ্চল টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা থাকবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদের মাত্রা এত দ্রুত বেড়ে চলেছে যে, প্রকৃতি ও মানুষের অভিযোজনের সক্ষমতাকে তা ছাপিয়ে যাবে এবং এমন একটি বাস্তবতার মুখোমুখি মানুষকে হতে হবে, যেখানে বন্যা, দাবানল আর খরায় লাখো জনতা উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে, হারিয়ে যাবে অনেক প্রজাতি এবং এই গ্রহের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই বৃষ্টিপাত, শিলাবৃষ্টির ধরন ও ঝড়ের মাত্রা বেড়ে গেছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে আর্দ্রতা। বাংলাদেশেও এমন হচ্ছে।

মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্যই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে—এটি এখন এক কঠিন সত্য। শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়ে বাতাসে মিশছে, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে প্রধান গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের বার্ষিক গড় দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪১০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), ১৮৬৬ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) ও ৩৩২ পিপিবি।

গবেষণা প্রতিবেদনে বিগত এক দশকে (২০১১-২০) ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০-এর চেয়ে ১.০৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষের কর্মকাণ্ডই পৃথিবীর জল, স্থল ও বায়ুমণ্ডলকে আশঙ্কাজনকভাবে উত্তপ্ত করে তুলছে।

২০৫০ সালের মধ্যে দেশগুলোর উচিত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা। বর্তমানে দেশগুলো যে গতিতে চলছে তাতে এই শতকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে।

অভিযোজনের জন্য মানবজাতি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করলে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে হুমকির মুখে থাকা উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার সামর্থ্য অনেক দেশেরই থাকবে না।

আরও পড়ুন : পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা

প্রাণিসম্পদ ও মাঠের কর্মীরা অতিরিক্ত গরমে কষ্ট পেতে পারেন, যার কারণে চাষাবাদও দিন দিন কঠিন হয়ে পড়বে। হিটস্ট্রোকে ধানে এবার চিটা বেশি, দাম কমে হতাশায় কৃষক।

প্রবাল প্রাচীর উপকূলীয় এলাকাকে ঝড়ের ও বন্যার কবল থেকে সুরক্ষা দেয়। সামুদ্রিক দাবদাহের কারণে তার ক্ষয় বেড়ে যেতে পারে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও দূষণে হুমকির মুখে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ। ২০৪৫ সালের মধ্যে কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রবাল শূন্য হওয়ার আশঙ্কা।

তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, সেক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে দাবানল এক-তৃতীয়াংশের বেশি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খরার কারণে বিশ্বের ৮০ থেকে ৩০০ কোটি মানুষ তীব্র পানি সঙ্কটে পড়তে পারে। আর বৈশ্বিক উষ্ণায়নে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে এই শতকের শেষ নাগাদ চরম আবহাওয়া দেখা দেওয়ার আশঙ্কা পাঁচগুণ বেড়ে যেতে পারে। বিশ্বজুড়ে ২৯ শতাংশ গাছ ও প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় শ্রমজীবী মানুষের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছে নেচার কমিউনিকেশনস। নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিন দিন বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে আর্দ্রতাও।

গরমের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ২২ হাজার ৮০০ কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এর আর্থিক মূল্য ২৮ থেকে ৩১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। মাথাপিছু শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ—৫ নম্বরে।

পরিবেশে একই সঙ্গে উষ্ণতা ও আর্দ্রতা বেশি থাকা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এমন গরম আবহাওয়ায় শরীরে ঘাম হয়। ঘাম শুকিয়ে শরীর দ্রুত শীতল হওয়ার সুযোগ কমে যায়।

অতি উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করা কৃষক ও শ্রমিকদের শরীরে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। তাদের উৎপাদনক্ষমতা কমে যায়। তারা বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা মৃত্যু ঝুঁকিও তৈরি করে। নিবন্ধে অতি উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে কর্মঘণ্টার ক্ষতির হিসাবও তুলে ধরা হয়।

গরমের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ২২ হাজার ৮০০ কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এর আর্থিক মূল্য ২৮ থেকে ৩১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। মাথাপিছু শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ—৫ নম্বরে। জানানো হয়, বাংলাদেশে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ কোটি শ্রমঘণ্টা।

মাথাপিছু হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫৪ শ্রমঘণ্টা। ক্ষতি বাড়ছে শ্রমিকের বিশেষ করে রিকশাচালক, কৃষি ও নির্মাণ খাতে ক্ষতি বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিতে পারলে আগামী দিনগুলোতে শ্রমঘণ্টার ক্ষতি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গবেষকেরা। (প্রথম আলো, ১৬ এপ্রিল ২০২২)

গরম-দূষণে অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গরমের সঙ্গে বেড়েছে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রেকর্ড রোগীর সংখ্যা। দেশের বিভিন্ন স্থানে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়লেও আক্রান্তের হার রাজধানী এবং এর আশেপাশের জেলাতেই বেশি।

আবহাওয়ার পরিবর্তন, অত্যধিক গরম, বায়ু দূষণ, অপরিচ্ছন্ন খোলা খাবার গ্রহণ এবং দূষিত পানীয় পান করায় হঠাৎ ডায়রিয়া বাড়ার অন্যতম কারণ মনে করছেন চিকিৎসকেরা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়ে যাবে।

আরও পড়ুন : নিমতলী, চুড়িহাট্টা, সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি : এর শেষ কোথায়? 

খুব ছোট শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, বাইরে দীর্ঘ সময় কাজ করেন—এমন ব্যক্তি বা স্থূলকায় ব্যক্তি, মানসিক রোগী এবং হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে আক্রান্ত মানুষেরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছেন। পরিবেশের তাপমাত্রা বেশি বাড়লে শরীরে পানিশূন্যতা, হিট ক্রাম্প, হিটস্ট্রোক, অবসাদ, ঘামাচি, হাম, গরমজনিত সর্দি-কাশি, প্রস্রাবে সংক্রমণ ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।

গরমে ঘামের মাধ্যমে প্রচুর লবণ ও পানি হারায় আমাদের ত্বক। এই পানির ঘাটতি পূরণ না করলে পানিশূন্যতা হতে পারে। এর লক্ষণ হিসেবে মাথা ঝিমঝিম করে, ক্লান্তি লাগে, মেজাজ খারাপ হয়, প্রস্রাবের রং গাঢ় হয়ে যায়।

এ রকম পরিস্থিতিতে —

• বারবার পানি, স্যালাইন পান করতে হবে।

• পানির সঙ্গে অন্যান্য তরল যেমন ফলের রস, শসা, লেবু-পানি, ডাব ইত্যাদি ফল বেশি বেশি খাওয়া উচিত।

• অ্যালকোহল, চা-কফি বরং এড়িয়ে যাওয়া ভালো। কেননা, এগুলো শরীরে পানিশূন্যতা বাড়ায়।

• ভাজা-পোড়া, অধিক তেল, মসলা জাতীয় খাবার একদমই এড়িয়ে যেতে হবে। সাধারণ খাবার যেমন ভাত, সবজি, মাছ ইত্যাদি খাওয়াই ভালো। খাবার যেন টাটকা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

• কড়া রোদ এড়িয়ে চলতে হবে।

হিটস্ট্রোক এটি একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি। এর ফলে দেহের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড অবধি উঠতে পারে। ত্বক ঘামে ভেজার বদলে বরং শুকনো খটখটে হয়ে যায়, রোগী আবোলতাবোল বকে, এমনকি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলতে পারে।

আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। তার আগে রোগীকে ঠাণ্ডা স্থানে নিয়ে গায়ের জামাকাপড় খুলে পাখা দিয়ে বাতাস করতে হবে, ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর স্পঞ্জ করলে এবং বগলে ও কুঁচকিতে আইসপ্যাক দিলে ভালো হয়। হিটস্ট্রোক থেকে মৃত্যুও হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।

ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
khasru73@juniv.edu