ছবি : সংগৃহীত

ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে আসামের বরাক উপত্যকা। এই উপত্যকার তিন জেলা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি বন্যার পানিতে প্লাবিত। সেখানেও রেল ও সড়ক যোগাযোগ একইসঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ভোগান্তিতে পড়েছে ত্রিপুরা রাজ্যও।

২০১৬ সালে আসামের লামডিং থেকে বদরপুর পর্যন্ত শতাব্দী প্রাচীন মিটার গেজ রেললাইন ব্রডগেজে পরিবর্তন করা হয়। এই নিউ হাফলংয়ে এবার এত ব্যাপকভাবে ধস নেমেছে যে স্টেশনটি রীতিমত ধ্বংসস্তূপের আকার ধারণ করেছে। উপড়ে গেছে রেললাইন।

ট্র্যাকে থাকা ট্রেনও গড়িয়ে পড়েছে। একইভাবে মেঘালয়ের রাতাছড়াসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ধস পড়ার ফলে গুয়াহাটি বা শিলং যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যাক্রান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আক্রান্তরা বিভিন্ন আশ্রয় স্থলে ছুটছেন।

ভারতের মণিপুর পাহাড়ে মাও সংসাং হতেই ‘বরাক’ নদীর উৎপত্তি। আসামের নাগা মণিপুর অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে নদীটি দুই শাখায় বিভক্ত হয়। আজমেরিগঞ্জের কাছে উত্তর সিলেটের সুরমা, আর দক্ষিণের শাখা সিলেটের কুশিয়ারা নদী। এরপর হবিগঞ্জে সিলেটের কালনী নদী একসঙ্গে মিলিত হয়েছে। সুরমা ও কুশিয়ারার মিলিত প্রবাহ কালনী নামে দক্ষিণে কিছুদূর প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে।

আসামে বন্যা পরিস্থিতির পুরোপুরি বিরূপ প্রভাব এখন দেশের পূর্বাঞ্চল খ্যাত সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায়। কারণ ভারত থেকে নেমে আসা সব নদী সিলেট-সুনামগঞ্জ ঘিরে রেখেছে। তাই আসামসহ আশপাশের অঞ্চলগুলো যেমন বানের পানিতে ভাসতে শুরু করেছে তেমনি মহাবিপর্যয় শুরু হয়েছে ভাটি অঞ্চলের দুই জেলাতেও।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফসল ডুবির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এবার নতুন করে বানের পানির ভোগান্তিতে মানুষ। হু হু করে উজানের পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে। অব্যাহত বৃষ্টি আর ঢলে সব নদ-নদী টইটম্বুর। ভরে গেছে হাওর। বিচ্ছিন্ন হচ্ছে জেলা সদর থেকে বিভিন্ন উপজেলার সড়ক যোগাযোগও। আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটছেন বানভাসি অসহায় মানুষ।

প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার অভ্যাস হাওরের বাসিন্দাদের, তা নতুন কিছু নয়। সন্ধ্যায় খাবার খেয়ে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ঘরের পাশে থই থই পানির দৃশ্য যুগ যুগ ধরে দেখে আসছেন সবাই। পানির তোড়ে ভেসে যায় গ্রাম, জনপদ বিলীন হওয়া, ফসল ডুবিতে হাহাকার আর কান্না রোল এলাকার পুরনো চিত্র।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফসল ডুবির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এবার নতুন করে বানের পানির ভোগান্তিতে মানুষ। হু হু করে উজানের পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে।

তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উত্তাল হাওর আর ঢেউ পাড়ি দিতে না পারায় অসুস্থ রোগীর চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর ঘটনা, গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যুর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা প্রায় সব গ্রামের মানুষের কমবেশি রয়েছে। বর্ষার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, বাল্য বিবাহ, শিক্ষা থেকে ঝড়ে পরা শিশু, শিশু শ্রম এসব বিষয় হাওরের মানুষের জন্য অনেক পুরোনো, আদি অভিজ্ঞতা।

স্থানীয়দের দাবি, ১৯৮৬ সালের পর এমন বন্যা দেখেননি মানুষ। এবার সেই রেকর্ডও ছাড়িয়ে যেতে বসেছে। ভাটি অঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, জাদুকাটাসহ প্রধান সবকটি নদ-নদীর পানি অব্যাহত বাড়ছে। কেউ বলছেন, ২০০৪ সালের পর এবারই বন্যার চোখ রাঙানি সবচেয়ে বেশি।

ভারতের পাহাড়ি একাধিক রাজ্য বেষ্টিত সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা। উজানে প্রতি বছরই আগাম বৃষ্টিপাত হয় এবং তুলনামূলক বেশি হয়। ভাটি অঞ্চল ঘিরে থাকা প্রধান সবকটি নদ-নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। এসব নদী বাংলাদেশ সীমানায় বিভিন্ন নামে প্রবাহিত। উঁচু অংশে বৃষ্টি বেশি হলে দ্রুত এর বিরূপ প্রভাব শুরু হয় নিম্নাঞ্চলগুলোতে। নদী ভরাট হয়ে পানি হাওরসহ বসতিতে প্রবেশ করতে থাকে। বন্যায় বাড়ে দুর্ভোগ। কোথাও দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।

মানছি, প্রকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাধ্য কারো নেই। বন্যা ফেরানো যাবে না। প্রকৃতির থাবা থেকে ফসল রক্ষা করা যাবে না। তাহলে কি ভাটির মানুষের দুঃখ যাবে না? সদিচ্ছা থাকলে দুর্ভোগ তো কমানো যায়। নাকি তাও সম্ভব নয়? 

সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার চারপাশ ঘিরে আছে সুরমা-কুশিয়ারাসহ একাধিক নদী। সেখানে পানি বাড়লেই দুই জেলা শহরও প্লাবিত হয়। এসব শহরের অভিজাত এলাকাগুলোও এখন পানিতে মগ্ন। শহরের ড্রেনেজ সিস্টেম নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে নগরবাসীর। অর্থাৎ ড্রেন দিয়ে যেন দ্রুত বৃষ্টির পানি নামতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনে ড্রেন আরও বেশি প্রশস্ত করা। জানি না সিলেট ও সুনামগঞ্জের নগর পিতারা কবে নাগাদ এই ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রকল্প হাতে নিবেন।

আরেকটি বড় কাজ হলো, জেলা সবকটি নদ-নদী খনন করা। শুনেছি, সুরমা-কুশিয়ারাসহ সিলেটের ৭৮টি ছোট-বড় নদ-নদী ও খাল খনন করার উদ্যোগ নিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সুপারিশের ভিত্তিতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুনামগঞ্জেও মোট ২৬টি ছোট বড় নদ-নদী রয়েছে।

দিন দিন পলিতে ভাটি এলাকার নদীগুলোর নাব্যতা কমছে। তেমনি উজাড় হচ্ছে নদী কেন্দ্রিক ছোট ছোট খাল, ছড়া ও নালাগুলোও। তাই পানি উন্নয়ন বোর্ড বা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই সংক্রান্ত প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। খননের মধ্য দিয়ে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়বে। উজানের ঢলে নদী উপচে সহজেই ফসল বা লোকালয় প্লাবিত হবে না। বন্যায় জনদুর্ভোগ কমবে। অন্যান্য স্থায়ী সমস্যারও কিছু উন্নতি হবে।

তাছাড়া বছর জুড়ে নদীতে পানি থাকবে। এতে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থাও সচল রাখা যাবে। কৃষকেরা বোরো মৌসুমে নদীর পানি যেমন ব্যবহার করতে পারবেন, তেমন মিঠা পানির মাছও সংরক্ষণ হবে। আরেকটি বিষয় হলো, ভাটির নদীও দখলের থাবামুক্ত নয়।

প্রকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাধ্য কারো নেই। বন্যা ফেরানো যাবে না। প্রকৃতির থাবা থেকে ফসল রক্ষা করা যাবে না। তাহলে কি ভাটির মানুষের দুঃখ যাবে না?

প্রতিটি ঘাট ও বাজার এলাকায় দেখা যায় নদীর জমি কীভাবে নিজের মতো করে দখল করেছে ভূমিদস্যুরা। দখলের কারণে অনেক এলাকায় নদীর গতিপথও বদলে গেছে। পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে যেসব এলাকা কখনো প্লাবিত হয় না, তাও হচ্ছে। দখলমুক্ত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা প্রয়োজন। 

বন্যা কবলিত মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভাটি এলাকায় বাড়াতে হবে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যাও। যেন বিপর্যয় শুরুর পর পরই মানুষ নিরাপদ স্থানে যেতে পারেন। তেমনি আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে গবাদি পশুর জন্য আলাদা জায়গা রাখাও প্রয়োজন। কারণ নিম্নাঞ্চলের প্রায় সব পরিবার কৃষিনির্ভর। বেশিরভাগ বাড়িতেই চাষাবাদের জন্য গবাদিপশু রয়েছে। কেউ কৃষিকাজে ব্যবহার করেন, কেউবা বাণিজ্যিকভাবে লালনপালন করেন। কেউবা গুরুর দুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

বন্যার কারণে নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যেমন কঠিন, তেমনি গবাদিপশু বাঁচাতে হাওরবাসীকে মহা সংগ্রাম করতে হয়। বিশেষ করে গৃহপালিত পশুর খাদ্য সংকট বেশি দেখা দেয়। তাই মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করলেই হবে না, গবাদিপশুর সুরক্ষাও সমানতালে নিশ্চিত করা জরুরি। তাহলে তারা বন্যার ধকল কাটিয়ে চলার পথে তেমন ধাক্কা অনুভব করবেন না।

পাশাপাশি বন্যার্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য সহযোগিতা তো নিশ্চিত করার অপেক্ষা রাখে না। ১২ মে থেকে ঘূর্ণিঝড় 'অশনি'র প্রভাবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং ভারতের মেঘালয় ও আসাম প্রদেশে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

সিলেট ও সুনামগঞ্জ দুই জেলার অন্তত ১৮টি উপজেলা প্লাবিত এখন প্লাবিত। সব নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরসঙ্গে বৃহত্তর সিলেট ও নেত্রকোনাতেও পানি অব্যাহত বাড়ছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে ভাটি বাংলার মানুষের বন্যা নিরাপত্তার জন্য করণীয় ঠিক করে তা দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। 

রাজন ভট্টাচার্য।। সাংবাদিক ও কলাম লেখক