ছবি : সংগৃহীত

ছোটবেলায় ‘আলীবাবা ও চল্লিশ চোর’র গল্প পড়তে গিয়ে ঐ জায়গাটা সত্যিই সেই শিশু বয়সেও মনে দোলা দিত। কোন জায়গাটি? একদিন আলীবাবা গুপ্তধনের সন্ধান পেলেন। আলীবাবার স্ত্রীর কাছ থেকে তার ধনাঢ্য ভাই কাশেমের স্ত্রী সখিনা কী এক কাজে দাঁড়িপাল্লা নিয়েছিলেন। দাঁড়িপাল্লা ফেরত দেওয়ার পর লক্ষ্য করেন যে, দাঁড়িপাল্লার নিচে মোহর আটকানো।

তখন তো সখিনা কপাল চাপড়ে কাঁদছে, সারা জীবন যে দাঁড়িপাল্লায় সবজি মাপলো আর আজ গরিব আলীবাবার বউ কি না দাঁড়িপাল্লায় মাপছে খোদ সোনার মোহর? সেই থ্রি-ফোরে পড়ার বয়সে কি সবজি আর সোনার মোহরের পার্থক্য বোঝার কথা একটি শিশুর? তবু বুঝেছি কিন্তু।

কল্পনা করেছি, দাঁড়িপাল্লার নিচে সোনার মোহর থাকলে সেটা কেমন। কারণ যত ছোটই হই, মাসের শেষ দিকে বাবার একটু চিন্তিত মুখ, সবজিওয়ালা থেকে শুরু করে সবার সাথেই মায়ের খানিকটা আনাড়ি দর-কষাকষি, বাবা-মা’র ভেতর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাস্তবতার ভেতরেই আমাদের সময়ের সাধারণ মধ্যবিত্ত শিশুরা বেড়ে উঠতো।

আমাদের মায়েদের মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত সংবাদপত্র, বিভূতি-রবীন্দ্র রচনাবলীর পাশে হিসাবের খাতায় জেট গুঁড়া সাবান থেকে পাউরুটি, আটা, চাল, ময়দা, সবজি, মিল্ক ভিটার প্যাকেটজাত দুধ, নুডলস, সুজি, সেমাই, চিনি, আদা-জিরা-মরিচ-ধনিয়াসহ যাবতীয় মশলার প্যাকেটের দাম লিখে রাখতে হতো।

সেই শৈশব থেকেই বাবা-মা’র জীবন সংগ্রাম দেখতে দেখতে মনে হতো, আহা- অমন গুপ্তধনের সন্ধান পেলে মা’কে তো সবজিওয়ালার সাথে দাম নিয়ে দর-কষাকষি করতে হবে না। অথবা ও হেনরির সেই বিখ্যাত প্রেমের গল্প ‘The Gift of the Magi’-এর শুরুর পঙ্‌ক্তিগুলোর কথাই ধরুন, One dollar and eighty-seven cents. That was all. And sixty cents of it was in pennies. Pennies saved one and two at a time by bulldozing the grocer and the vegetable man and the butcher until one's cheeks burned with the silent imputation of parsimony that such close dealing implied. Three times Della counted it. One dollar and eighty-seven cents. And the next day would be Christmas.

ডেলা নামের তরুণী গৃহবধূটি মুদি দোকানি, সবজিওয়ালা ও কসাইয়ের সাথে যে পরিমাণ দর-কষাকষি করলে অনুক্ত কৃপণ অপবাদে গাল লাল হয়ে যায়, তেমন দর-কষাকষির পরও ক্রিসমাসের আগের দিন ডেলা দেখছে যে, তার কাছে মাত্র এক ডলার ও সাতাশি সেন্ট আছে। তাহলে সে জিমের জন্য কীভাবে উপহার কিনবে?

মাসের শেষ দিকে বাবার একটু চিন্তিত মুখ, সবজিওয়ালা থেকে শুরু করে সবার সাথেই মায়ের খানিকটা আনাড়ি দর-কষাকষি, বাবা-মা’র ভেতর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাস্তবতার ভেতরেই আমাদের সময়ের সাধারণ মধ্যবিত্ত শিশুরা বেড়ে উঠতো।

তারপরের গল্পটুকু আমরা অনেকেই জানি। বাদামি জলপ্রপাতের মতো দীর্ঘ কেশরাশি কর্তন করে, নকল চুল বানানোর দোকানে জমা দিয়ে ডেলা জিমের জন্য উপহার কিনে ফিরেছিল স্কুল পালানো বালকের চেহারায়। আসলে ধনতান্ত্রিক সমাজে উন্নত পশ্চিম থেকে বাংলাদেশ সর্বত্রই সাধারণ মধ্যবিত্তের চেহারা যেন একই।

আমাদের শৈশব কৈশোর কেটেছে আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়নের শীতল যুদ্ধ ও যেকোনো সময় তৃতীয় মহাযুদ্ধ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা, স্বদেশে সামরিক শাসন, চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয়, ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষ, বাংলাদেশের ঘন ঘন বন্যার মতো সব ঘটনার ভেতর দিয়ে। বাজারে দ্রব্য-পণ্যের দাম ওঠা-নামা করতো।

প্রথম স্কুলে যাওয়ার খাতা সাদা কাগজের হলেও বোধকরি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সাশ্রয়ের কথা ভেবেই বাজারে অতি দ্রুত চলে এসেছিল নিউজপ্রিন্টের খাতা, বই-পত্র এসব। নিউজপ্রিন্টের খাতার সাথে সস্তার বলপেন। তারপর চোখের সামনে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় হয়েছে, পৃথিবীতে এককেন্দ্রিক বা ‘ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিশ শতক পার হয়ে একুশ শতক এসেছে। এবং ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার এত বছর পর আজ আবার ইউক্রেনকে উপলক্ষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া মুখোমুখি দ্বৈরথে। দুইবছর ব্যাপী দীর্ঘ অতিমারির পর এই যুদ্ধের অভিঘাতে বাংলাদেশের বাজারেও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য লাগামের বাইরে চলে যাচ্ছে।

আসুন, দেখি তো কেমন অবস্থা এখন আমাদের সাম্প্রতিকতম বাজারদরের? এক বছরের ব্যবধানে দেশের বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আটা, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি, মসলা, সাবান, সোডা, ওষুধ, শিক্ষা উপকরণ, জ্বালানি, কাপড়চোপড়, শিশুখাদ্যসহ নিত্যদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িত পণ্য ও সেবার দাম ৩ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কোনো কোনো পণ্যে দাম বাড়ার হার আরও বেশি। (সমকাল, ১৬/৫/২০২২)

বেশ আগে থেকেই চালের দাম নিয়ে মানুষ দুর্বিপাকে আছে। বোরোর ভরা মৌসুমেও ৪৫ টাকার নিচে প্রতি কেজি মোটা চাল মিলছে না। মাঝারি মানের চালের দাম ৫০ টাকার বেশি। বছরের ব্যবধানে ‘গরিবের আমিষ’ ডালের দামও কেজিতে ৩০ টাকা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত মার্চ শেষে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬.২২ শতাংশ। গত বছরের মার্চে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৪৭ শতাংশ। গত মার্চে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.৩৪ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫.৫১ শতাংশ। গ্রামীণ পর্যায়ে এই মূল্যস্ফীতি আরও বেশি।

মানুষের জীবনযাত্রার খরচ যেভাবে বেড়েছে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় বাড়েনি। বিবিএসের মজুরি সূচকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে সারাদেশে গড় মজুরি সূচক বেড়েছে ৬.১৫ শতাংশ। কৃষি খাতে তা আরও কম, ৬.১৩ শতাংশ।

মানুষের জীবনযাত্রার খরচ যেভাবে বেড়েছে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় বাড়েনি। অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই শুধু নয়, কিছু ব্যবসায়ীর চূড়ান্ত অসততার কারণে আজ এই অবস্থা...

শিল্প খাতে মজুরি বেড়েছে ৬.০৭ শতাংশ। তবে শিল্পের মধ্যে নির্মাণ খাতে মূল্যবৃদ্ধি সবচেয়ে কম। ব্যাপক শ্রম নির্ভর এ খাতে মাত্র ৪.৫৯ শতাংশ মজুরি বেড়েছে। তবে উৎপাদন খাতের মজুরি বেড়েছে ৮.৫৫ শতাংশ। আর সেবা খাতে মজুরি বেড়েছে ৬.৪১ শতাংশ। 

দেশের বাজারে আরেক দফা বাড়ল সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্টসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম, যা মানুষের সংসারের ব্যয় আরও বাড়াবে। (প্রথম আলো, ১৬/৫/২০২২)

বিশ্ববাজারে পাম ও সয়াবিন তেলের দাম এখনকার মতো কখনো হয়নি। দেশে এই দুই ধরনের তেলের চাহিদা পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে খরচ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। আগে কখনো ভোজ্যতেল আমদানিতে এত অর্থ খরচ করতে হয়নি। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় চাপ বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে পাম ও সয়াবিন তেল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২২৮ কোটি ডলার বা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছর (২০২০-২১) একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১৪৭ কোটি ডলার বা ১২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই দুটি তেল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ।

এক কথায় অতিমারি পার হওয়ার পর ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতায় খোদ বাংলাদেশের বাজারেও এসে লাগছে আগুনের হল্কা। অকাল প্রয়াত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের মজুতদারদের ব্যঙ্গ করে ‘খাদ্য সমস্যার সমাধান’ কবিতায় লিখেছিলেন—

‘মজুতদার:
এই নাও ভাই, চালকুমড়ো,
                 আমায় খাতির করো,
চালও পেলে কুমড়ো পেলে
                 লাভটা হল বড়।।’

অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই শুধু নয়, কিছু ব্যবসায়ীর চূড়ান্ত অসততার কারণে আজ ইতিমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে একটি কাচ্চি বিরিয়ানির দোকানে বিরিয়ানিতে কুকুরের মাংস দেওয়ার ভয়ানক খবর ভাইরাল হয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের এই পাগলা বৃদ্ধি বিষয়ে আমাদের আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা তাই অতি জরুরি।

অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক