ছবি : সংগৃহীত

ক্ষুব্ধ হয়ে হানিফ সংকেত লিখেছেন, ‘ফেসবুকে যারা গুজব ছড়ায় তারা কী বোঝে না আমাদের আত্মীয়স্বজন পরিবার আছে?’ নিশ্চিতভাবে উত্তর হচ্ছে, বোঝে। জেনে বুঝেই তারা কাজটি করে। তাদের দরকার লাইক, শেয়ার, কমেন্টস এবং আয়। সামাজিকভাবে কে হয়রানির শিকার হলেন, কে বিব্রত হলেন তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। এসব সামাজিক দায়বদ্ধতা তাদের কাছে অর্থহীন সন্দেহ নেই।

গুণী নির্মাতা হানিফ সংকেত সম্ভবত বর্তমান ফেসবুকের হাওয়া সম্পর্কে ততটা পরিচিত নন। যে কারণে তিনি বেশ খানিকটা মন খারাপই করেছেন। খুবই স্বাভাবিক। কারণ ২৪ মে তিনি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো জেনেছেন, তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।

কোথায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, কীভাবে ঘটেছে এসব কিছুরই উল্লেখ নেই। অথচ সেই গুজবের পোস্টে অহরহ লাইক পড়ছে, শেয়ার হচ্ছে, তার ভক্তরা আবেগাক্রান্ত হয়ে মন্তব্য করছেন। শেষ পর্যন্ত হানিফ সংকেত নিজেই তার ফেসবুকে পেইজে পোস্ট দিয়ে বলতে বাধ্য হলেন, ‘আমি সুস্থ আছি’

১০ এপ্রিল, শনিবার। দিবাগত রাত পৌনে একটায় হঠাৎই গুজব ছড়িয়ে পড়ে, চিত্রনায়ক ও সাংসদ আকবর হোসেন পাঠান ফারুক মারা গেছেন। এক বছরেরও বেশি সময় তিনি সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই পুরো সময় প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে বারবার তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।

অবশেষে তার স্ত্রী বিরক্ত হয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তিনি এখন অনেকটা সুস্থ। তবে যে মানুষটির চিকিৎসার জন্য তারা সারাক্ষণ উদ্বেগে আছেন, বারবার তার মৃত্যুর গুজব শুনে তারাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। এটা তাদের জন্যে মানসিক অত্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু গুজব যারা ছড়ায়, সেটা বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। তাদের দরকার লাইক আর শেয়ার।

যে মানুষটির চিকিৎসার জন্য তারা সারাক্ষণ উদ্বেগে আছেন, বারবার তার মৃত্যুর গুজব শুনে তারাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। এটা তাদের জন্যে মানসিক অত্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই মিথ্যাবাদীরাই আজ থেকে বছর তিনেক আগে ঢাকার সাবেক মেয়র এবং নামী টিভি উপস্থাপক আনিসুল হকের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছিল। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে শুরু হয় নানা ধরনের গুজব ছড়ানো। তার পরিবারও হাতজোড় করে অনুরোধ করেছিল, ‘প্লিজ গুজব ছড়াবেন না’। সেই মানবিক আবেদনেও কেউ সাড়া দেয়নি।

মৃত্যুর ১৫ দিন আগেও ‘তিনি আর নেই’ পোস্ট এসেছিল। তিনি মারা গেলে এই গুজব সৃষ্টিকারীদের কেউ কেউ দম্ভ করে লিখেছিলেন, ‘আমিই ঠিক লিখেছিলাম, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর কথা গোপন রেখেছিল।’

সুতরাং গুজব চলবেই। এই ধরনের প্রতারণায় প্রতারকদের কোনো পাপবোধ নেই। তারা এটা করেই যাবে। কারণ তারা নিশ্চিত এতে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। গুজব যে শুধু মানুষের মৃত্যু নিয়ে হয় তা নয়। এর নানামুখী ব্যবহার তারা খুঁজে বের করেছে। বের করছে নিত্য নতুন কৌশল। যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তার অসহায় হয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকছে না।

লেখার এই পর্যায়ে আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের কথা মনে পড়ছে। গল্পের চরিত্র কাদম্বিনীর জন্য খুব দুঃখ হচ্ছে। সেই সময় ফেসবুক ছিল না। ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।’ একটা পোস্ট দিলে হয়তো আমাদের মধ্যেই এতদিন বেঁচে থাকতেন। 

এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন রয়ে যায়। কাদম্বিনী কী হানিফ সংকেতের মতো জনপ্রিয় ছিলেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্যাণে তিনি হয়তো জনপ্রিয়। সেই বিবেচনায় তিনিও হয়তো একটা পাল্টা পোস্ট দিতে পারতেন। সেটা তখন মূলধারার গণমাধ্যমে খবর হিসেবে প্রচার হতো।

দুই একদিন পর হয়তো তার স্বজনেরা স্বস্তি পেতেন। কিন্তু আমরা যারা নিজে পরিচিত মানুষ নই কিংবা যাদের সাথে কবিগুরুর মতো পরিচিত মানুষের পরিচয় নেই তাদের কী হবে? তাদের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা কেউ টানা সাত দিন ফেসবুক অনুসরণ করলেই টের পাবেন।

এই ধরনের প্রতারণায় প্রতারকদের কোনো পাপবোধ নেই। তারা এটা করেই যাবে। কারণ তারা নিশ্চিত এতে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। গুজব যে শুধু মানুষের মৃত্যু নিয়ে হয় তা নয়। এর নানামুখী ব্যবহার তারা খুঁজে বের করেছে।

বলতে দ্বিধা নেই, প্রতিদিন হাজার মানুষ ফেসবুকে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। ফেসবুকে যিনি হয়রানির শিকার হন, তিনি যদি সাধারণ মানুষ হন এবং নিজের পক্ষে যদি কিছু বলেনও সেই কথা দ্রুত কারো চোখে পড়ে না। যতক্ষণে তার বক্তব্য মানুষের সামনে আসে ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়। বিষয়টা অনেকটা ছকে বাঁধা। তাই মিথ্যাবাদী মিথ্যা কথা বলে নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

তবে এই প্রতারকদের চেয়ে আমার বেশি ক্ষতিকারক মনে হয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে। কারণ তারা মানুষের কথা বলার অধিকার নিশ্চিতকরণ বিষয়ক সুন্দর সুন্দর কথা বলে একটা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ঝুলিয়ে রেখেছে তার প্রায় তিনশ কোটি ব্যবহারকারীর সামনে।

ফেসবুক ব্যবহারকারীরা অবশ্য এখন আর কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড মানছে না। এই কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড দেখিয়ে তারা কোটি কোটি ডলার আয় করে নিয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অভিযোগ শোনার মতো সুষ্ঠু ব্যবস্থাও তারা রাখেনি। বিচার আচার তো অনেক পরের ব্যাপার।

প্রতারকের দলের হাতে আরও একটি অস্ত্র তুলে দিয়েছে আমাদের স্থানীয় অভিভাবক তথা সরকার। ফেসবুকের কাছে কোথায় যেন তারা দুর্বল। মন্ত্রী, এমপি, উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা ভয়াবহ মিথ্যাচারের শিকার হচ্ছেন নিয়মিত। অথচ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। একটা জবাব বা বিবৃতি পর্যন্ত নেই।

আমার তো ইদানীং মনে হয় আমাদের রাষ্ট্রের চেয়ে গুজব সৃষ্টিকারীরা অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ খুব কাছ থেকে দেখে যেটা জানি সেটা সম্পর্কে যখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুল তথ্য প্রচার হচ্ছে এবং নিরপরাধ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তখন এরকম না ভেবে উপায় কী?  

ফেসবুক অপচর্চার ভয়ে হয়তো ব্যবহারকারীর তালিকা থেকে নিজের নাম নিজেই কেটে দিতাম। কিন্তু এটা গত ১৫ বছরে এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি করেছে। জীবনযাপনের নানা বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগের সবকটি মাধ্যম।

বহু মানুষের কাছে খাওয়া, টয়লেটে যাওয়া, ঘুমানোর মতো ফেসবুক চর্চাও একটা দৈনন্দিন কাজ। তাই চাইলেও দ্রুত এখান থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। তাই আমার মতো আমজনতার এই অপচর্চার বিরুদ্ধে কিছু করার নেই। আমরা এখন দেখবো, এরপরের গুজব কাকে নিয়ে। এরপর কে বিব্রত হবেন? 

পলাশ আহসান ।। যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন