ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারির রেশ না কাটতেই নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে মাঙ্কিপক্স। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুধু আফ্রিকায় সীমাবদ্ধ ছিল মাঙ্কিপক্স। কিন্তু ২০২২ সালের মে মাসের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ইউরোপের বেশকিছু দেশে মাঙ্কিপক্সের রোগী শনাক্ত হচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস শনাক্ত হয়নি।

৭ মে লন্ডনে প্রথম এক ব্যক্তির শরীরে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল, যিনি ইতিপূর্বে নাইজেরিয়ায় গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানেই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০ মে ফ্রান্সে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস সংক্রমিত প্রথম রোগী পাওয়া গেছে।

কানাডার মন্ট্রিয়লে ১৩ জন আক্রান্তের সত্যতা মিলেছে। ১৩ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত আফ্রিকার বাইরে মোট ১৮টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে মাঙ্কিপক্স, যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৯৪ জন। ২২ মে ইসরায়েল ও সুইজারল্যান্ড তাদের দেশে একজন করে মাঙ্কিপক্স রোগী শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

এখন এই ভাইরাসজনিত রোগটি আরও দ্রুত ছড়াচ্ছে। ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (who) সতর্কবার্তা, আফ্রিকা থেকে ইউরোপ এবং আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে। তাই এখনই এই ভাইরাসের বিষয়ে বিশেষ সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তা, আফ্রিকা থেকে ইউরোপ এবং আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে।

কারণ, মহামারি ঘোষণা হয়নি এমন দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে মাঙ্কিপক্স। তবে আশার কথা, এই রোগে সংক্রমিত রোগী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেরে ওঠে, তাই এই রোগ খুব বেশি ভয়ংকর নয়। এ রোগে বিরল কিছু ক্ষেত্রেই কেবল মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। 

মাঙ্কিপক্স কী: 
মাঙ্কিপক্স হলো একধরনের ভাইরাস, যা পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে বিশেষ ধরনের বসন্ত রোগ সৃষ্টি করে। ১৯৫৮ সালে প্রথম বানরের শরীরে এই ভাইরাস ধরা পড়ে, সেই সূত্র ধরেই রোগটির এই নামকরণ। প্রাণীদেহের মাধ্যমে বিশেষ করে, ইঁদুরের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। 

১৯৭০ সালে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে মানবদেহে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস প্রথম শনাক্ত করা হয়। সেখানে ৯ বছর বয়সী এক শিশুর দেহে এই রোগ শনাক্ত হয়। এর দুই বছর আগেই দেশটি থেকে গুটিবসন্ত বিদায় নিয়েছিল। আফ্রিকায় দড়ি কাঠবিড়ালি, গাছ কাঠবিড়ালি, ডর্মিসের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির বানর এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মাঙ্কিপক্স পাওয়া গেছে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০ সালের পর থেকে আফ্রিকার ১১টি দেশে মাঙ্কিপক্স ছড়িয়ে পড়ে। দেশগুলো হচ্ছে বেনিন, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, গ্যাবন, আইভরি কোস্ট, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন ও দক্ষিণ সুদান। ২০০৩ সালে আফ্রিকার বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এই রোগ শনাক্ত হয়।

লক্ষণসমূহ: 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটালেও তা সীমিত আকারে হয়ে থাকে। এই রোগের লক্ষণগুলো গুটিবসন্তের মতোই। আক্রান্ত হওয়ার ৫ থেকে ২১ দিন পর প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পায়। জ্বর, মাথা পেশি ও পিঠ ব্যথা, কাঁপুনি, ক্লান্তি, গ্ল্যান্ড ফোলা, গায়ে জল ভরা ফোসকার মতো র‍্যাশকে আপাতত মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

মাঙ্কিপক্স হলো একধরনের ভাইরাস, যা পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে বিশেষ ধরনের বসন্ত রোগ সৃষ্টি করে। ১৯৫৮ সালে প্রথম বানরের শরীরে এই ভাইরাস ধরা পড়ে, সেই সূত্র ধরেই রোগটির এই নামকরণ।

গুটি বা জলবসন্তের সঙ্গে মাঙ্কিপক্সের উপসর্গের দিক থেকে সাদৃশ্য থাকায় অনেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগকে বসন্ত বা চিকেনপক্স বলে ভুল করছেন। এই রোগে প্রাণহানির সংখ্যা খুবই কম। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মধ্যে সহজে মাঙ্কিপক্স ছড়ায় না। এটি করোনাভাইরাসের মতো দ্রুত সংক্রামকও নয়। কিন্তু তবু সব দেশকে সাবধান হতে বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চিকেন পক্সের মতো রোগের প্রতিকার থাকলেও এই বিরল রোগ নিরাময়ের এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি নেই বলেই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

কীভাবে সংক্রমিত হয়: 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এই রোগ মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগের লক্ষণ আছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেই রোগটি ছড়াচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছেন যে, সংক্রমিত ব্যক্তির রক্ত, শ্বাসনালী, শরীরে তৈরি হওয়া কোনো ক্ষত, নাক কিংবা চোখের মাধ্যমে কিংবা সংক্রমিত প্রাণীর শ্লেষ্মার সরাসরি সংস্পর্শে এলে অন্যের শরীরের প্রবেশ করতে পারে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস। রোগীর ড্রপলেট থেকেও এই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে বলে স্বাস্থ্যকর্মী ও আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও ঝুঁকিতে থাকেন। 

সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গম করলেও অপরের শরীরে হানা দিতে পারে এই ভাইরাস। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এটা যৌনবাহিত রোগের মতোই সংক্রমিত হচ্ছে, যা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব শহরেই বেশি দেখা যাচ্ছে। সমকামী অথবা উভকামী পুরুষেরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। 

গুটিবসন্তের তুলনায় মাঙ্কিপক্স মৃদু উপসর্গ যুক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্স এক বিশেষ ধরনের বসন্ত। এটি গুটিবসন্তের জন্য দায়ী ভাইরাসের পরিবারভুক্ত। জলবসন্ত বা গুটিবসন্ত তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিচিত। তাই প্রতিকারও অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু এই মাঙ্কিপক্স ভাইরাস এতই বিরল যে এখনো এই ভাইরাসে আক্রান্তদের সুস্থ করতে নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি চিকিৎসকদের জানা নেই।

মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে সাধারণভাবে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। দুই থেকে চার সপ্তাহেই রোগী সেরে ওঠে। কিন্তু সংখ্যাগত দিক থেকে কম হলেও মাঙ্কিপক্স প্রাণঘাতী হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, মধ্য আফ্রিকায়, যেখানে কোনো চিকিৎসা সেবা নেই, সেখানে ১০ জন আক্রান্তের মধ্যে এক জনের মৃত্যু হয়। তবে এমনিতে এই রোগ থেকে মৃত্যুর সম্ভাবনা খুব কম। গুরুতর অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়তে পারে। 

এই রোগের ভয়াবহতা নির্ভর করে ভাইরাস ছড়ানোর মাত্রাসহ রোগীর শারীরিক জটিলতার ওপর। যুক্তরাজ্যের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সিমন ক্লার্ক বলেন, পশ্চিম আফ্রিকার একটি ধরনে মৃত্যুহার ১ শতাংশ। এটি যুক্তরাজ্যে ছড়িয়েছে। কঙ্গো অঞ্চলের অন্য একটি ধরনের মৃত্যুহার ১০ শতাংশ।

মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে সাধারণভাবে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। দুই থেকে চার সপ্তাহেই রোগী সেরে ওঠে। কিন্তু সংখ্যাগত দিক থেকে কম হলেও মাঙ্কিপক্স প্রাণঘাতী হতে পারে।

২০১৮ সালে যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল ও সিঙ্গাপুরে মাঙ্কিপক্সের রোগী শনাক্ত হয়েছিল। ওই সময় ইউরোপে করা এ ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স (জীবন রহস্য উন্মোচন) করে যে ধরন পাওয়া গেছে, সেটির সঙ্গে বর্তমানে পাওয়া ধরনের মিল আছে।

টিকা: 
গুটিবসন্তের টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর। তবে গুটিবসন্ত বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রায় নির্মূল হওয়ায় এর টিকা পাওয়া এখন কঠিন। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এরিক ফিগেল ডিং বলেন, গুটিবসন্তের টিকা মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে কার্যকর এটা ভালো সংবাদ। তবে খারাপ সংবাদ হচ্ছে, ৪৫ বছরের নিচে অনেকেরই এই টিকা দেওয়া নেই। 

মাঙ্কিপক্স যখন উদ্বেগের নতুন কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে, তখন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় চলমান ৭৫তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশে ভবিষ্যতের যেকোনো মহামারি মোকাবিলায় বিশ্ববাসীকে এক সঙ্গে কাজ করার উপর জোর দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে মহামারি এলে যেন সবার ন্যায়সঙ্গত অংশগ্রহণে তা মোকাবিলা করা যায়, সেজন্য অবশ্যই মহামারি চুক্তি সম্পাদন সম্পন্ন করতে হবে।’ 

যদিও এই পক্সে আক্রান্ত কারও মৃত্যুর কোনো খবর মেলেনি। বিশ্বের সব দেশকে সাবধান হতে বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির আশঙ্কা, বিশ্বজুড়ে রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে। ইতিমধ্যে ইউরোপ-আমেরিকায় ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে মাঙ্কিপক্স। এই অবস্থায় প্রতিদিনই নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। 

এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে রোগের প্রাদুর্ভাবের বিশেষ কোনো প্রবণতা, কারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন, সংক্রমণের উৎস, মাঙ্কিপক্সে কোন টিকা কার্যকর হবে—এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করা জরুরি। 

এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের মধ্যে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ খুবই কম হলেও আমরা মনে করি, রোগ নিয়ে মানুষের সতর্ক হওয়া উচিত। মাঙ্কিপক্স যেহেতু শারীরিক সংস্পর্শে আসার কারণে ছড়ায় তাই স্বেচ্ছা আইসোলেশন কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানার মাধ্যমে এর বিস্তার সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। 

ফুসকুড়ি বা জ্বরের মতো লক্ষণ দেখে যারা ভাবছেন সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের উচিত অন্যদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। টিকা থাকলেও সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা এটিই যে, আপনি চাইলেই নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারেন।

ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
khasru73@juniv.edu