ছবি : সংগৃহীত

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছায় রাজনীতিতে আসা এবং বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে রাজনৈতিক দীক্ষা পাওয়া শেখ ফজলুল হক মনি আজীবন রাজনৈতিক শিক্ষক মুজিবের দর্শন বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন। মুজিবের আদর্শে মুক্তির পথ দেখাতে গিয়ে তিনি অনেক ক্ষমতাধরদের বিরাগভাজনও হয়েছেন। রাজনীতিতে তিনি শাসক শ্রেণির সচেতনতা হিসেবে খ্যাতিমান।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা পেশ করলে তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল বুঝতে অনেক রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হন। আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এমনকি আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ছয় দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ২ জুন ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে।’

পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও জেনারেল আইয়ুব খান যেকোনো উপায়ে এই আন্দোলন দমন করতে উদ্যত হন। মে মাসের ৯ তারিখে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। আন্দোলন ঘনিয়ে আসলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদেরও গণহারে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩ জুন জেলে বসে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কি হবে বাইরে, কর্মীদের কি অবস্থা, অত্যাচার ও গ্রেফতার সমানে চলছে, আওয়ামী লীগ কর্মীদের উপর।’

এমন বাস্তবতায় ছয় দফা আন্দোলন সংগঠিত করতে সাহসী কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন শেখ ফজলুল হক মনি। বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর পর শেখ ফজলুল হক মনিই ছিলেন ছয় দফা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক ও প্রত্যক্ষ কাণ্ডারি।

ছয় দফার অন্যতম দাবি ছিল, পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের সম্মেলনের পূর্বদিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করলে সম্মেলনের উদ্যোক্তারা তা প্রত্যাখ্যান করে।

পরের দিন পশ্চিম পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকায় ছয় দফা সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিত্রিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ঐ সম্মেলন বর্জন করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়।

১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ৭ জুন দেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয়। জনমত আদায়ের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর লেখা নিয়ে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬ দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়।

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছয় দফা কর্মসূচিকে জনপ্রিয় করতে এবং আন্দোলনকে বেগবান করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শেখ ফজলুল হক মনি। শেখ মনির ‘ছেষট্টির সাত জুন: প্রস্তুতি পর্ব’ নিবন্ধ পাঠে জানা যায়, ‘বঙ্গবন্ধু জেলে থাকায় এবং মওলানা ভাসানীর ন্যাপসহ আরও কিছু সংগঠনের আপত্তি থাকায় ৬ দফার পক্ষে জনসমর্থন আদায় এবং হরতাল সফল করা ছিল অত্যন্ত কঠিন।’

৭ জুন ১৯৭২ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘মানিক মামার সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেন ইত্তেফাকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও তিনি পিছ পা হবেন না। শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য তিনি সবকিছু করবেন।’

‘...জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছেন হরতালের প্রস্তুতি কতদূর কি হলো সেটা সম্পর্কে। গভীর রাতে পেছনের দেওয়াল টপকিয়ে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গেলাম। মামিকে বিস্তারিতভাবে সবকিছু জানিয়ে বললাম, রাতের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নিকট খবর পৌঁছে দেবার জন্য। হরতাল হবেই।’

বাংলার বুদ্ধিভিত্তিক সমাজ ও সচেতন ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন ভাষা আন্দোলনের পর ছয় দফা আন্দোলনই ছিল পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালির প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলন, যে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন পূর্ববাংলার মেহনতি জনতা ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দ।

ছাত্রলীগ ও শ্রমিক সংগঠনে নেতৃত্বদানের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শেখ ফজলুল হক মনি এই আন্দোলন সফল করতে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও শ্রমিক নেতাকর্মীদের কাজে লাগান।

হরতালকে সামনে রেখে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের তিনি সংগঠিত করেন। ৭ জুনের হরতালে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ কমপক্ষে ১১ জন বাঙালি শহীদ হন।

জেলে বসে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘তবে হরতাল যে সাফল্যজনকভাবে পালন করা হয়েছে সে কথা সকলেই বলছে। এমন হরতাল নাকি কোনোদিন হয় নাই, এমনকি ২৯ সেপ্টেম্বরও না।’

ইতিহাসবিদদের মতে, ছয় দফার পক্ষে ৭ জুনের হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম পিছিয়ে যেত। ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার সংগ্রাম।’

ছয় দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকার কারণে শেখ মনির বিরুদ্ধে হুলিয়া জারিসহ আটটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ফলে ১৯৬৮ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হলেও শেখ মনিকে মুক্তি দেওয়া হয়নি।

কারগারের রোজনামচা গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৬ দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে। ...আমার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সকলের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।’

ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ঐ নির্বাচনের ইশতেহারে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনসহ বাঙালির অধিকার বাস্তবায়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন শেখ মনি।

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের অন্যতম কারিগরও বলা হয় তাকে। মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন মুজিববাহিনী।

যে বাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর দর্শনের আলোকে স্বাধীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও মূল্যবোধের বীজ রোপিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ছয় দফায়।

১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আগে ‘স্লোগান ছিল ৬ দফা, এখন ৪টা স্তম্ভ।’ বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে এই চার স্তম্ভ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রূপকার, বাঙালির মর্যাদা, মুক্তির প্রেরণা, মুজিবীয় আদর্শের মৌলিকতার প্রতীক এবং একাধারে লেখক, গল্পকার, তাত্ত্বিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনিকে নতুন প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা হলে, তাকে অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্যে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে জাতি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আরও বেশি শানিত, ‘সোনার বাংলা’ ও ‘সোনার মানুষ’ তৈরির পথ হবে সমৃদ্ধ। ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসে তাই কামনা।

ড. মুহম্মদ মনিরুল হক ।। উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ