পূর্ব বাংলার বাঙালিদের ভোটেই মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। এটি এক ঐতিহাসিক সত্য। অবিভক্ত ভারত রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানের অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত হচ্ছিল না। আত্মমর্যাদা তো বহুত দুরস্ত। ভারত রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান বরাবরই নিজেদের অপর ভেবেছে; ভাবতে বাধ্য হয়েছে। ফলে পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠী খুব করে চেয়েছে একটা নতুন রাষ্ট্র, যে-রাষ্ট্রে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে; অর্থনৈতিক অধিকার ও আত্মমর্যাদা সমুন্নত থাকবে।

এদিক থেকে পাকিস্তান ছিল বাঙালি মুসলমানের স্বপ্নের রাষ্ট্র। একারণেই বোধ করি, অর্থনীতিবিদ আতিউর রহমান তার এক গবেষণায় মন্তব্য করেছেন, বাঙালি মুসলমানের মহোত্তম অর্জন দুটি; একটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, অন্যটি বাংলাদেশ।

যে স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বাঙালি মুসলমান শামিল হয়েছিল তা পাকিস্তান রাষ্ট্রে দিনদিন ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে। অর্থনৈতিক শোষণ চলেছে অবাধে; চক্ষুলজ্জাহীনভাবে।

গণতান্ত্রিক অধিকার ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন থেকেই নাই হতে শুরু করে। সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন ভোগও কঠিন হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে। ক্রমে আরেক ব্যাপার স্পষ্ট হতে থাকে যাকে ভদ্র ভাষায় বলা হয় জাতি বিদ্বেষ। এসবই ঘটেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষ থেকে। বাংলা হয়ে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনি।

১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বাঙালির পক্ষ থেকে দাবিদাওয়া ও প্রতিশ্রুতির দফাও কম ঘোষিত হয়নি। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি মূলত দেড়যুগ ধরে বাঙালি যা আকাঙ্ক্ষা করেছে তারই অত্যাশ্চর্য সংক্ষিপ্ত প্রকাশ।

এই নব্য ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা কথা বলেছে, রাজপথে নেমেছে। হাটে, মাঠে, ঘাটে, রাজপথে উত্তাপও ছড়িয়েছে। বিদ্যায়তনে একাডেমিক পরিসরে পণ্ডিতদের মধ্যেও ওইসব বঞ্চনা আর অমর্যাদা নিয়ে কম কথা হয়নি।

১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বাঙালির পক্ষ থেকে দাবিদাওয়া ও প্রতিশ্রুতির দফাও কম ঘোষিত হয়নি। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি মূলত দেড়যুগ ধরে বাঙালি যা আকাঙ্ক্ষা করেছে তারই অত্যাশ্চর্য সংক্ষিপ্ত প্রকাশ। শুধু দেড় যুগই-বা বলি কেন, অবিভক্ত ভারত রাষ্ট্রের মধ্যেও এর ইতিহাসের শেকড় প্রোথিত।

কোটি কথা, হাজারও শ্লোগান-মিছিল, অমেয় রক্ত, হাজারও রাজনৈতিক কবিতা-প্রবন্ধ-উপন্যাস-নাটক, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অযুত-নিযুত একাডেমিক শব্দাবলী ও তত্ত্ব নীরবে ধারণ করে আছে মাত্র এই ছয়টি দফা। ছয় দফা আসলে বাঙালির দীর্ঘকালের রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও আত্মমর্যাদা সম্পর্কিত ধারণার সংক্ষিপ্ত প্রকাশ।

একদিক থেকে ছয় দফা দাবি ছিল একটি রাজনৈতিক কবিতার মতো। একটি ভালো রাজনৈতিক কবিতার মধ্যে যেমন জাতির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা অজগরের মতো মোচড় দিয়ে ওঠে, এই দফাগুলোতে পূর্ব বাংলার বাঙালির আকাঙ্ক্ষা তরপায়ে উঠেছে।

একটি ভালো যোগাযোগক্ষম কবিতার জন্য যেমন স্পষ্টতা দরকার হয় ছয় দফা তেমন একটি স্পষ্ট দাবিদাওয়ার সমষ্টি। আবার ভালো কবিতার যেমন ছোট জায়গার মধ্যে ঠাস করে বড় কথা বলার একটা দায় থাকে তেমনি ছয় দফা ছোট জায়গার মধ্যে একটা সামগ্রিক দাবি মিটিয়েছে। ভাষার প্রাঞ্জলতার কথা বাদই দিলাম।

বড় কবি তার জনগোষ্ঠীর অব্যক্ত কথাকে রূপ দেন অথবা তার কথাটা আসলে তার জনগোষ্ঠীর কথা হয়ে ওঠে। ফলে বড় কবির কবিতা যখন তার জনগোষ্ঠীর মুখে ওঠে তখন সে মনে করে এ তো তারই কথার প্রতিধ্বনি। আদতে কবিতা তো কবির একার সৃষ্টি নয়। কবিতা একটি সমবায়ী সৃষ্টি। একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে একটি কবিতা রচিত হতে থাকে। কোনো এক কবি সেটাকে কোনো এক দিব্য মুহূর্তে ভাষার খাপে গ্রেফতার করেন।

ছয় দফা শেখ মুজিবুর রহমানের ওইরকম এক রাজনৈতিক দাবিনামা। তিনি তার জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষাকে, দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা দাবিকে একটি সংক্ষিপ্ত পরিসরে ধরে ফেলেছেন। বড় নেতা তো কবির মতোই। তিনি তো তার জনগোষ্ঠীর অব্যক্ত কথাকে ব্যক্ত করেন। তিনি স্বপ্ন দেখান, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চান। তিনি কবির মতোই সম্মোহিত করেন।

ছয় দফা কে লিখেছিলেন, কে বা কারা খসড়া করেছিলেন, কে ভাষা ঠিক করে দিয়েছিলেন তা ইতিহাসের প্রামাণিক গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। কিন্তু মুজিব এটিকে নিয়ে সামনে এগিয়েছিলেন, জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন, মানুষকে—এমনকি তার দলের নেতাকর্মীদের-—বুঝিয়েছিলেন ছয় দফার প্রয়োজনীয়তা। রাজনৈতিকভাবে তাই এটি শেখ মুজিবের এবং আওয়ামী লীগেরই প্যাটেন্টে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এটি আওয়ামী লীগের বা শেখ মুজিবের হলো কীভাবে!

ছয় দফা শেখ মুজিবুর রহমানের ওইরকম এক রাজনৈতিক দাবিনামা। তিনি তার জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষাকে, দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা দাবিকে একটি সংক্ষিপ্ত পরিসরে ধরে ফেলেছেন। বড় নেতা তো কবির মতোই।

১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর এক জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে পাকিস্তানের উভয় অংশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য করণীয় ঠিক করতে মিলিত হন।

আসলে তা ছিল আইয়ুব বিরোধী একটি সম্মেলন। সেই সম্মেলনে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। ওই কনভেনশনের সাবজেক্ট কমিটির বিবেচনার জন্য তিনি ছয় দফা পেশ করেন। ছয় দফার দাবি সংবলিত কিছু প্রচারপত্রও বিলি করেন।

ওই কনভেনশনে ছয় দফা তীব্র সমালোচনার ঝড় তোলে। প্রায় সব দলের নেতৃবৃন্দ ছয় দফাকে পাকিস্তানের অখণ্ডতার জন্য হুমকি মনে করেন। অনেকে মনে করেন, এটি মুজিবের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা। কিন্তু মুজিব ওই কনভেনশনে তার বক্তব্যে বলেন, আমার এই ৬-দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি নয়, গোটা পাকিস্তানেরই বাঁচার দাবি।’ ওই কনভেনশন মুজিবের ছয় দফাকে প্রায় ছুড়ে ফেলেন। ফলে মুজিব ওই সম্মেলনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কনভেনশন শেষ হওয়ার আগেই পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন।

২০ ফেব্রুয়ারি তিনি তার ধানমণ্ডির বাসভবনে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক বর্ধিত সভা আহ্বান করেন। দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টাব্যাপী হয়েছিল সেই সভা। সেখানে তিনি নেতৃবৃন্দকে ছয় দফা নিয়ে এগোনোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। আর ওই সভাতেই সিদ্ধান্ত হয় ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠানের। মার্চের ওই অনুষ্ঠানেই আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয় ছয় দফা এবং শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ। 

বর্ধিত সভা আর কাউন্সিল অধিবেশনের মাঝের সময় মুজিব বসে থাকেননি। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দান থেকে শুরু করে নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ দেশের বিচিত্র জায়গায় চষে বেড়ান ছয় দফার প্রয়োজনীয়তার কথা মানুষকে বোঝাতে। এমনকি মার্চের ওই কাউন্সিল অধিবেশনের বাইরের পরিবেশটি ছয় দফাভিত্তিক ব্যানার ফেস্টুনে ভরিয়ে তোলা হয়।

২০ মার্চ থেকেই আবার শুরু হয় ছয় দফাকেন্দ্রিক গণসংযোগ। দ্বিতীয় দফার এই গণসংযোগ শুরু হয় ঢাকার পল্টন ময়দান থেকে। এরপর মুজিব ছয় দফা নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। ছয় দফা নিয়ে তার ছোটাছুটির একটা ছোট তালিকা দেখা যেতে পারে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ‘২৬ মার্চ সন্দীপ, ২৭ মার্চ সাতকানিয়া, ৭ এপ্রিল পাবনার নগরবাড়ি ও পাবনা, ৮ এপ্রিল বগুড়া, ৯ এপ্রিল রংপুর, ১০ এপ্রিল দিনাজপুর, ১১ এপ্রিল রাজশাহী, ১৩ এপ্রিল ফরিদপুর, ১৫ এপ্রিল যশোর, ১৬ এপ্রিল কুষ্টিয়া, ১৭ এপ্রিল খুলনা, ২৯ এপ্রিল কুমিল্লায় জনসভায় ভাষণ দেন।’ এসব সভায় ব্যাপক লোকসমাগম ঘটত। এবং এসব সভা সন্ধ্যা গড়িয়ে প্রায়ই রাত পর্যন্ত গড়াত বলে ইতিহাস সূত্রে জানা যায়। এভাবেই ছয় দফা যৌথ রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হওয়া সত্ত্বেও এটি মুজিবের ছয় দফা হয়ে উঠেছে।

আসলে ছয় দফা পেশ করেই শেখ মুজিব প্রথম জাতীয় নেতায় পরিণত হন। জাতি প্রস্তুত হয় তার হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়ার জন্য। তিনি ব্যাপক আস্থা অর্জন করেন। একারণে শুধু ৭ জুন তারিখে ছয় দফার পক্ষে আন্দোলন করতে গিয়ে মারা যান ১১ জন।

পাকিস্তান আমলে ছয় দফা আন্দোলনের আগ পর্যন্ত একদিনে একক ঘটনায় যত বাঙালি প্রাণ হারিয়েছেন এটাই বোধ করি সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। সরকার সেই যাত্রায় ছয় দফা আন্দোলন বন্ধ করতে পারে। কিন্তু ছয় দফাকে কেন্দ্র করে মুজিব হয়ে উঠলেন সেই নেতা যিনি জেলে থেকে হুকুম দিলেও মানুষ রাষ্ট্রের বন্দুক উপেক্ষা করে রাস্তায় নামে।

ছয় দফা শেখ মুজিবের এবং আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা কী পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছিল তা বোঝা যায় ৭ জুন হরতালের পরে ন্যাপের প্রচারপত্র থেকে। ন্যাপের প্রচারপত্রে হরতালের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে—‘পাকিস্তানের জীবন ইতিহাসে এমন হরতাল আর দেখা যায় নাই। পিকেটিংয়ের প্রয়োজন হয় নাই, স্বেচ্ছাসেবকের কথা কেউ চিন্তাও করে নাই-তবুও ৭ জুন ভোরবেলা দেখা গেল লক্ষ জনতা নিজেরই স্বেচ্ছাসেবক, চোখেমুখে তাদের দৃপ্ত শপথ, আত্মশক্তিতে গভীর আস্থা- কোনও ভ্রুকুটি, কোনও চণ্ডনীতিই তাহাদিগকে টলাইতে পারিবে না।’ কিন্তু আইয়ুব সরকার হত্যা, গণ-গ্রেফতার, জেলজুলুমের মাধ্যমে ছয় দফা আন্দোলনকে থামিয়ে দেয়। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া এবং মুজিবের গ্রহণযোগ্যতা বোঝা যায় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে।

কাউন্সিল অধিবেশনের মাঝের সময় মুজিব বসে থাকেননি। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দান থেকে শুরু করে নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ দেশের বিচিত্র জায়গায় চষে বেড়ান ছয় দফার প্রয়োজনীয়তার কথা মানুষকে বোঝাতে।

উনসত্তরের রাজপথের সমস্ত আলো গিয়ে পড়ে অন্ধকার জেলের প্রকোষ্ঠে মুজিবের ওপর; সিনেমায় যেমন অনেক মানুষের মধ্যে নায়কের মুখের ওপর একটু বেশিই আলো পড়ে। আসলে ছয় দফা আন্দোলন ছিল উনসত্তরের একটা বড় রিহার্সাল।

ছয় দফা আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল মূল বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রাম; ন্যায্য হিস্যার আন্দোলন। পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে ছয় দফা আন্দোলনসহ এর আগের সব আন্দোলন-সংগ্রাম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম বলে কীর্তি হওয়ায় ছয় দফাকেও বলা হয় পাকিস্তানের শেকল কেঁটে বের হয়ে আসার আন্দোলন।

কথাটা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকই আছে। কিন্তু ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব বাংলার বাঙালির পাকিস্তান-ব্যাকুলতা প্রমাণ করে এই আন্দোলন ছিল মূলত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যেই ছয় দফার দাবিগুলো তোলা হয়েছিল।

এই দাবির মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার বাঙালি অবিভক্ত ভারত রাষ্ট্রের মধ্যেকার যে-অমর্যাদা, অনধিকার আর অপরবোধ পাকিস্তান রাষ্ট্রের আওতার মধ্যে আবার চেপে বসেছিল ছয় দফা দাবির মধ্য দিয়ে বাঙালি তা ঘোচাতে চেয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের খাসলতে একটা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। এজন্য ছয় দফা দাবি যখন তোলা হয় তখন অনেকে একে পাকিস্তান ভাঙার পায়তারা বলে সাব্যস্ত করে একে সমর্থন দেয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দল তো নয়ই। এমনকি ভাসানীর দলও ছয় দফার সমালোচনা করেছিল। এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যে থেকেও অনেকে আকার-প্রকারে এর বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান তখন স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে, ছয় দফা দাবি পাকিস্তান ভাঙার জন্য নয় পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য তোলা হয়েছে।

বাঙালি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যে-স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিল ছয় দফা তারই প্রতিফলন। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। আইয়ুব সরকার বাঙালিকে অধিকার দেওয়ার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বরং ছয় দফাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী’, ধ্বংসাত্মক’ বলে অভিহিত করা হয়। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ‘এক নম্বর দুশমন’ বলে সাব্যস্ত করা হয়।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আছে এমন যেকোনো রাজনৈতিক দল এবং এর নেতাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুধাবন করা। শুধু অনুধাবন করলেই হয় না, জনচৈতন্যের আকাঙ্ক্ষাকে দলের কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রতিফলিত করাও একটা বড় কাজ। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও এর নেতাদের এই দায়িত্ব থাকে আরও একটু বেশি। কারণ যেকোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম দানা বেঁধে ওঠে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ছিল এমন একটি রাজনৈতিক দাবি যা পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষাকে সবচেয়ে গভীরভাবে অনুবাদ করতে পেরেছিল। ছয় দফা দাবি আর এই দাবিকেন্দ্রিক আন্দোলনের এটাই কি সবচেয়ে বড় তাৎপর্য নয়!

ড. কুদরত-ই-হুদা ।। প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক
kudratehuda@gmail.com