ছবি : সংগৃহীত

আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। শুরুর দিকে এটি সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিল। পরে ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হয়। আর এখন কুমিল্লা স্বাধীন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলা। ‘কুমিল্লা’ নামটি কেমন করে এলো? এই প্রশ্নের উত্তর একেকজন একেকভাবে দিয়েছেন। তবে, সবচেয়ে প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য উত্তরটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে চীনা পরিব্রাজক ওয়াং চুয়াং-এর নাম।

তিনি একসময় সমতট রাজ্য পরিভ্রমণ করেছিলেন। তার ভ্রমণকাহিনিতে ‘কিয়া-মল-ঙ্কিয়া’ নামের যে স্থানের বিবরণ রয়েছে, সেটি থেকে ‘কমলাঙ্ক’ নামের উৎপত্তি। কমলাঙ্ক মানে ‘পদ্মফুলের দীঘি’। আর কমলাঙ্কের অপভ্রংশ হচ্ছে ‘কুমিল্লা’।

আমার শৈশবের উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে কুমিল্লার ইসলামপুর নামের একটি অজপাড়াগাঁয়ে। ঠিক মনে আছে, আমরা শৈশবে পেয়ারাকে ডাকতাম ‘গম’ (কিন্তু wheat অর্থে গম-কে কী ডাকতাম মনে নেই)। আমার ছোটবেলার অল্প সময় চট্টগ্রামেও কেটেছে।

চট্টগ্রামের মানুষ ‘গম’ শব্দটি ব্যবহার করত ‘ভালো’ অর্থে। ‘আঁই গম আসি’ মানে ‘আমি ভালো আছি’। চট্টগ্রামের এক বন্ধু জানালেন, হুইট-কেও উনারা ‘গম’ই বলেন; আর পেয়েরাকে ডাকেন ‘গুয়াছি’ (ইংরেজিতে পেয়ারাকে বলে ‘গুয়াভা’; মিলমিশের গন্ধ পাওয়া যায় কি?)। এদিকে, চীনা ভাষায় পেয়ারা-কে বলে ‘ফান শিলিউ’। আর হুইট অর্থে গম বোঝাতে চীনা ভাষায় ব্যবহৃত হয় ‘সিয়াওমাই’ শব্দটি।

চীনে এখন এই সিয়াওমাই বা গম কাটার ধুম পড়েছে। এই দেশে গ্রীষ্মকালীন ফসলের ৯০ শতাংশই হচ্ছে গম। গত ২৮ মে থেকে দেশজুড়ে শুরু হয় যন্ত্রের সাহায্যে গম কেটে ঘরে তোলার কাজ। ৬ জুন পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ১১ লক্ষ হেক্টর জমির গম কাটা হয়; বাকি থাকে প্রায় ৪৫ শতাংশ জমির গম কাটার কাজ।

চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বাকি গম কাটা শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আসলে, চীনে বছরের এই সময়টায় গম পাকে এবং কৃষক তা ঘরে তোলে। গমের পাশাপাশি এসময় যব ও কৃষকের ঘরে ওঠে।

আবার এখনকার সময় অন্যান্য ফসল বোনারও উপযুক্ত সময়। সম্ভবত এই কারণেই এখন যে সৌরপদ চলছে, তার নাম ‘মাংচুং’, যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়াবে ‘ফসল বোনার সময়’।

অনেকেই জানেন, চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদ (solar terms)-এ। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত।

ইউনেসকোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই ২৪টি সৌরপদ বা সোলার টার্ম হচ্ছে—লি ছুন (বসন্তের শুরু), ইয়ুশুই (বৃষ্টির পানি), চিংচ্য (পোকামাকড়ের জাগরণ), ছুনফেন (বসন্ত বিষুব), ছিংমিং (তাজা সবুজ), কুইয়ু (শস্য-বৃষ্টি), লিসিয়া (গ্রীষ্মের শুরু), সিয়াওমান (ছোট পূর্ণতা), মাংচুং (ফসল বোনার সময়), সিয়াচি (উত্তরায়ণ), সিয়াওশু (কম গরম), তাশু (বেশি গরম), লিছিয়ু (শরতের শুরু), ছুশু (গরমের শেষ), পাইলু (শুভ্র শিশির), ছিউফ্যন (শারদীয় বিষুব), হানলু (ঠাণ্ডা শিশির), শুয়াংচিয়াং (প্রথম হিমেল হাওয়া), লিতুং (শীতের শুরু), সিয়াওসুয়ে (ছোট তুষার), তাসুয়ে (বড় তুষার), তুংচি (দক্ষিণায়ন), সিয়াওহান (ছোট শীত), তাহান (বড় শীত)।

প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। চীনে হাজার হাজার বছর আগে এই সৌরপদ-ব্যবস্থার উৎপত্তি। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে।

বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। এখন চলছে চীনের নবম সৌরপদ। এর ব্যাপ্তিকাল ৬ জুন থেকে ২০ জুন পর্যন্ত।

মাংচুং সৌরপদে আগের আটটি সৌরপদের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হয়। বিশেষ করে ইয়াংজি নদীর মধ্য ও নিম্ন অববাহিকায় ‘বরই বৃষ্টি’র (Plum Rains) মৌসুম শুরুর সময় এটি। ‘বরই বৃষ্টি’ সাধারণত জুন ও জুলাই মাস স্থায়ী হয়।

তখন এই অঞ্চলে অধিকাংশ সময় আকাশ মেঘলা থাকে এবং টানা বৃষ্টিপাত হয়, অনেকটা আমাদের দেশের বর্ষাকালের মতো। এই মৌসুমে বরই পাকে। ধান, শাক-সবজি ও ফলমূল উৎপাদনের জন্যও সময়টা বেশ উপযুক্ত।  

চীনের আনহুই প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ‘আন মিয়াও’ নামের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা প্রচলিত আছে। ‘আন মিয়াও’ মানে ‘চারা সুরক্ষা’। মিং রাজবংশ আমলের (১৩৬৮-১৬৪৪) শুরুর দিকেই এই প্রথার উদ্ভব; টিকে আছে আজও।

প্রতিবছর মাংচুং সৌরপদে আনহুইয়ের কৃষকেরা বিশেষ পূজার আয়োজন করে। এসময় তারা শরৎকালে ভালো ফলনের জন্য প্রার্থনা করে। প্রথার অংশ হিসেবে স্থানীয় বাসিন্দারা গমের আটা বা ময়দা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের রুটি তৈরি করে এবং সেগুলোকে বিভিন্ন সবজির রস দিয়ে রাঙায়। এই রঙিন রুটিগুলোই সংশ্লিষ্ট দেবতাকে খুশি করতে নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়।

প্রাচীন চীনে ফুলের দেবীর পূজার চল ছিল। চান্দ্রপঞ্জিকার দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় দিনে তারা ফুলের দেবীকে স্বাগত জানাতো নানান আয়োজনের মাধ্যমে। আর মাংচুং সৌরপদে সেই দেবীকে জানানো হতো বিদায়। তখন দেবীকে খুশি করতে ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে লোকেরা নৈবেদ্য দিত।

আজকাল চীনের অনেক অঞ্চলেই এই প্রথার অস্তিত্ব নেই। তবে, প্রাচীন চীনে এই প্রথার যে জৌলুশ ছিল, ছিল চাকচিক্য, তা আজও রয়ে গেছে চীনের একটি ধ্রুপদি উপন্যাসের ২৭তম অধ্যায়ে। উপন্যাসটির নাম ‘আ ড্রিম অব রেড ম্যানশানস’ (A Dream of Red Mensions); লেখক ছাও সুয়েছিন (Cao Xueqin)।

‘বরই বৃষ্টি’র কথা আগে উল্লেখ করেছি। দক্ষিণ চীনে মে ও জুন হচ্ছে বরই পাকার সময়। বলা হয়, চীনের ‘তিন রাজ্য’ (Three Kingdoms) সময়কালের (২২০-২৮০) দুই বিখ্যাত ব্যক্তি ছাও ছাও এবং লিউ পেই মাংচুং সৌরপদে সবুজ বরই সেদ্ধ করার সময় অতীতের বীরদের নিয়ে গল্প করতেন।

আজও চীনের অনেক জায়গায় মাংচুং সৌরপদে অনেকে সবুজ বরই সেদ্ধ করে খেয়ে থাকেন। সবুজ বরইয়ে বিভিন্ন ধরনের অর্গানিক এসিড ও খনিজ পদার্থ থাকে, যা শরীরের জন্য ভালো।

সবুজ বরইয়ের এসব উপাদান রক্ত পরিষ্কার করে, রক্তের লিপিড কমায়, ক্লান্তি দূর করে এবং চেহারা করে সুন্দর। তবে, সবুজ বরই এমনিতে খেতে টক, ফলে সেদ্ধ করে খেতে হয়।

চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাবিদ্যা অনুসারে, মাংচুং সৌরপদে চর্বিযুক্ত ও কড়া স্বাদযুক্ত খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ। সহস্রাধিক বছর আগে, থাং রাজবংশ আমলের (৬১৮-৯০৭) চীনা ফার্মাসিউটিক্যাল বিশেষজ্ঞ সান সিমিআও এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে গেছেন।

তিনি বলেছেন, মাংচুং সৌরপদে হালকা খাবার খেতে হবে, বিশেষ করে সবজি জাতীয় খাবার ও মোটা দানার শস্য। এগুলো রক্তচাপ ও রক্তে চর্বির পরিমাণ কমাতে সহায়ক। এসময় যারা সবসময় তৃষ্ণার্ত থাকেন ও ক্লান্তিতে ভোগেন, তাদেরকে ভেড়ার মাংস, ঝাল মরিচ, পেঁয়াজ, আদা, ইত্যাদি খুব কম খেতে পরামর্শ দিয়ে গেছেন তিনি। 

মাংচুং সৌরপদে আবহাওয়া গরম থাকে। এসময় বেশি বেশি শাক-সবজি ও ফলমূল খায় চীনারা। আমাদের এক চীনা বন্ধু আছেন, যাকে আমরা ‘লিউ আপা’ বলে ডাকি। বয়স প্রায় ৭৫। অনর্গল বাংলা বলেন। একসময় বাংলার শিক্ষিকা ছিলেন। তো, লিউ আপা প্রায়ই বলেন, গরমে বেশি বেশি নাশপাতি খেতে হবে। বিশেষ করে মাংচুং সৌরপদে। নাশপাতিতে প্রচুর প্রাকৃতিক ও পুষ্টিকর তরল থাকে।

যারা উচ্চ রক্তচাপের রোগী বা যাদের রক্তে সুগারের পরিমাণ বেশি, তারা নাশপাতি খেলে উপকার পাবেন। আমার দুটোর একটিও নেই। তারপরও লিউ আপার পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করি।

মাংচুং সৌরপদে টমেটো, শশা, বেগুন, সেলারি, অ্যাসপ্যারাগাস, তরমুজ, স্ট্রবেরি খেতেও পরামর্শ দেন চীনা চিকিৎসকেরা। ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাবিদ্যা অনুসারে, এসব ফলমূল হচ্ছে ঠাণ্ডা-প্রকৃতির; এগুলো শরীর ঠাণ্ডা রাখে ও হজমে সহায়ক।

আগেই বলেছি, মাংচুং সৌরপদে আগের আটটি সৌরপদের তুলনায় বৃষ্টিপাত বেশি হয়। বৃষ্টিপাত মানেই গ্রামাঞ্চলে কাদার ছড়াছড়ি। শৈশবে কাদামাটিতে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলার স্মৃতি এখনো অমলিন।

মাংচুং সৌরপদে চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কুইচৌ প্রদেশের তুং জাতির তরুণ-তরুণীরাও নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি খেলে থাকে। বিশেষ করে, নতুন বিয়ে হয়েছে এমন দম্পতি বন্ধুবান্ধব নিয়ে ধান গাছের চারা রোপনের সময় নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি খেলে।

খেলা শেষ হলে দেখা হয় কার শরীরে সবচেয়ে বেশি কাদা লেগেছে; তাকে গণ্য করা হয় সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে। অর্থাৎ, ‘কাদা ছোড়াছুড়ি’ করা সব ক্ষেত্রে খারাপ নয়।

আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)