ছবি : সংগৃহীত

মাত্র তিন দিন আগে ক্লাসভরা শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি শিক্ষক হতে চাও? ক্লাসের প্রায় সবাই মাথা নাড়ল। তার অর্থ হলো তারা কেউ শিক্ষক হতে চায় না। বললাম, কেন হতে চাও না? 

লাজুক ভঙ্গিতে তারা বলল, শিক্ষকদের ক্ষমতা নেই। দেশ জুড়ে ক্ষমতার পূজা চলছে। বললাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন তো অতো খারাপ না। না খেয়ে মরতে হয় না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা একই স্কেলে চাকরি শুরু করতে পারেন। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও একই বেতনে চাকরিতে ঢোকেন। তারা বলল, ক্ষমতাহীন পেশায় গিয়ে লাভ কী!

‘ক্ষমতা’ শব্দটির প্রয়োগ দেখে আমি বিস্মিত হইনি। কারণ, তারা সত্য বলেছে। ‘ক্ষমতা’ শব্দটির অনেক অনেক অর্থগত মাত্রা থাকলেও, ক্ষমতা বলতে তারা বুঝিয়েছে প্রশাসনিক ক্ষমতা, আইনি ক্ষমতা, বিচার ও শাসনের ক্ষমতা; যে ক্ষমতা প্রদর্শনযোগ্য, যে ক্ষমতা সামাজিক সম্মান, ভয় ও সমীহ উৎপাদন করে, তারা সেই ক্ষমতার কথা বলেছে।

এ ধরনের ক্ষমতা থাকলে লোকেরা বাড়ির সামনে ময়লা ফেলবে না, দোকান কিংবা বাজার বসাবে না, জমির সীমানায় ঢুকে পড়বে না অন্যের খুঁটি, বাড়ির মেয়েরা রাস্তায় হেনস্থার শিকার হবে না ইত্যাদি। তার মানে, বোঝা যাচ্ছে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে টিকে থাকার জন্য ‘ক্ষমতা’ অত্যন্ত জরুরি বিষয় হয়ে পড়েছে। 

শিক্ষকদেরও ‘ক্ষমতা’ আছে; তবে সেই ক্ষমতা জ্ঞান উৎপাদন ও বণ্টনের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ক্ষমতার এ অর্থকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না। তাহলে ধরে নেওয়া যাচ্ছে যে, শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষাদান সম্পর্কিত ধারণার আর্থ-তাৎপর্য, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ডিসকোর্সে বিরাট বদল ঘটে গেছে। তার সাম্প্রতিক প্রমাণ এই : 

এক. শিক্ষকদের ওপর ব্যক্তিক ও সংগঠিত আক্রমণ দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু আক্রমণ প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক শব্দ ও বাক্ভঙ্গি দ্বারা।

দুই. শিক্ষাদানের বিষয় ও পদ্ধতি প্রসঙ্গে শিক্ষাতত্ত্ব-বহির্ভূত/ ধারণাহীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ‘শিক্ষাতাত্ত্বিক’ ফর্মুলা ও উপদেশ পেশ করছে।

তিন. শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের ক্রম অবনতি ঘটেছে এবং জন্ম নিয়েছে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। ত্বরিৎ তৎপরতার মাধ্যমে সংগঠিত ও পরিকল্পিত আক্রমণগুলোকে প্রতিহত করা হয়নি। 

চার. শিক্ষকদের প্রতি সরকারি ভাষ্য, আচরণ ও বক্তব্যে নিহিত আছে উপেক্ষা। এমপিওভুক্তি, বেতন ও নিবন্ধন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষকেরা যত দাবি-দাওয়া পেশ করেছেন, ততোটাই উপেক্ষা এসেছে রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে। 

পাঁচ. শিক্ষক ও শিক্ষাদান সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গের আচরণিক ও মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর ঘটেছে। পেশাদারিত্বের প্রবল ঘাটতি দেখা দিয়েছে। 

নিশ্চয়ই এই পাঁচ প্রমাণের বাইরে আরও অনেক প্রমাণ ও বক্তব্য বিদ্যমান। মোটা দাগে এই পাঁচটি প্রসঙ্গ আমার মনে আঁচড় কেটেছে। সামগ্রিক যোগফল হিসেবে মনে হয়েছে, নানামাত্রিক পরিকল্পনা ও গবেষণা সত্ত্বেও বাংলাদেশে শিক্ষা অত্যন্ত অগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। শিক্ষক নিতান্ত হাস্যকর প্রাণী।

পেশা হিসেবে শিক্ষকতা অতি ‘নিম্ন মানে’র। সব চেয়ে দরকার হলো বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রাপ্ত চাকরি, চাকরি এবং চাকরি। যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখারও দরকার নেই বলে অনেক শিক্ষার্থী মনে করে।

সত্তর আশির দশকের সামাজিক আলাপে শিক্ষা ছিল ‘জ্ঞান’, শিক্ষক ছিলেন ‘বিবেক’ ও শিক্ষকতা ছিল ‘সেবা ও পেশা’। সাংস্কৃতিক কারখানায়, অর্থাৎ টিভি নাটক ও সিনেমায় স্কুল শিক্ষক মানেই ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের লোক; তার একটি ভাঙা সাইকেল ও একটি ভাঙা ছাতা থাকবে, তিনি হবেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, তার ছেলে চাকরি না পেয়ে সন্ত্রাসী হয়ে উঠবে অথবা বারে গিয়ে মদ পান করবে।

কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের অর্থ ছিল, তিনি মোটামুটি মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করবেন, তার থাকবে ফ্যাকাশে ফোমওয়ালা সোফা কিংবা বেতের চেয়ারওয়ালা ড্রইংরুম, বুকশেলফে কিছু বই থাকবে ইত্যাদি। তার ছেলেটি আদর্শ-আদর্শ বলে চেঁচাবে, আর সন্ত্রাসীদের হাতে মার খাবে। 

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি নিজেই টের পেতাম শিক্ষকেরা মূলত দরিদ্র। বাজারে মাছ কিনতে গিয়ে দশ বার দামাদামি করতেন। মাংসের দোকানের সামনে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমার মুখোমুখি পড়ে লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছেন অনেক শিক্ষক। লজ্জা ঢাকতে আমি দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম।

শ্রেণিকক্ষের বাইরে তাদের অনেক কাজ ছিল। তারা আদমশুমারির লোক গণনা করতেন, গম বিতরণ করতেন, সরকারি বিভিন্ন জরিপের কাজ করতেন। বলা যায়, তারা গর্দভতুল্য শ্রম দিতেন। কিন্তু তাদের জন্য সামাজিক সম্মানের জায়গাটা খোলা ছিল।

সামাজিক মূল্যবোধের প্রশ্নে শিক্ষকের প্রয়োজন পড়ত। পারিবারিক, ব্যক্তিক, সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনে লোকেরা শিক্ষকের পরামর্শ গ্রহণ করত। চোখের সামনে দেখতে পেলাম, শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষকতার ক্রম অধঃপতন। 

পড়াতে গিয়ে ইদানিং বিপন্ন বোধ করি। মাঝে মাঝে কথার ওপর কাঁচি চালাই। কখনও কখনও আল্লাহ-খোদার নাম নিয়ে দরকারি কথা মনে যা আসে বলে ফেলি। ব্যাখ্যার প্রয়োজনেই বলি। দুঃখ হলো, শিক্ষককে আজ দাঁড় করানো হয়েছে প্রতিপক্ষের কাঠগড়ায়।

সমাজের কেউ কেউ নির্ধারণ করে দিতে চাইছে, তিনি কী বলবেন, কতটুকু বলবেন, কী পড়াবেন! স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকদের অনেকেই অভিভাবকদের দ্বারা রীতিমতো আক্রান্ত হন, শিক্ষার্থী কেন নাম্বার কম পেল! শিক্ষকের সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ব্যাপকভাবে বিপর্যয়ের শিকার। 

মজার ব্যাপার হলো, কেউই সংঘটিতভাবে কোনো দুর্নীতিবাজ, কালোবাজারি, ধর্ষক ও নিপীড়ক কিংবা টেন্ডারবাজকে সাঁড়াশি আক্রমণ করছে না। দয়া করে ভাববেন না যে, আমি আইন হাতে তুলে নিয়ে দুর্নীতিবাজদের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে বলছি। তুলনা করছি মাত্র। দুর্নীতিবাজ, কালোবাজারি, ধর্ষক ও নিপীড়ক, টেন্ডারবাজদের অপরাধ নিজেই আসলে ‘ক্ষমতা’ সমার্থক। অতএব সমীহযোগ্য।

সমাজ ধরেই নিয়েছে শিক্ষক নামের ‘নিরীহ প্রাণীটি’  আক্রমণের শিকার হলে শামুকের মতো কুচকে যাবে; কারণ তার ‘কিছুই করার নেই’। তার সম্বল হলো মানববন্ধন, প্রতিবাদলিপি ও সমবেদনামাখা কলাম প্রকাশ।

এই বাস্তবতা অত্যন্ত কৌতুককর ও হতাশাজনক। যদিও আমরা জানি, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শিক্ষা। ইডিওলজিক্যাল স্টেইট অ্যাপারেটাস হিসেবে শিক্ষা ও শিক্ষক সব সময়ই জোরদার ভূমিকা পালন করে এসেছে। শিক্ষককে কখনো কখনো যেতে হয়েছে কাউন্টার ইডিওলজিক্যাল স্টেইট অ্যাপারেটাসের ভূমিকায়।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলে আমরা শিক্ষকদের এই ভূমিকা দেখেছি। অর্থাৎ শিক্ষককে যেতে হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিরোধের ময়দানেও। কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশীদার হিসেবে তারা যুক্ত হয়েছিল সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে। সমস্যা হলো, এই রাজনীতিই আজ শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষকতাকে অধঃপতিত করেছে।

প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা ও শিক্ষককে টেনে নামানো হয়েছে ময়লার খাদে। শিক্ষকের কাঁধে দড়ি বেঁধে, মুখে স্কচ টেপ দিয়ে বলা হয়েছে, এবার চড়ে ফিরে খা। আর তাই অব্যর্থভাবে শিক্ষকের গলায় উঠেছে জুতার মালা, ‘কল্পিত’ রোষ গিয়ে পড়েছে সমাজের নিরীহ প্রাণীটির ওপর। রাষ্ট্র ও সমাজ প্রবেশ করেছে অনিশ্চিত অন্ধকার গন্তব্যে। জুতার মালা আসলে শিক্ষকের গলায় নয়, পরানো হয়েছে শিক্ষার গলায়।

শিক্ষা ও শিক্ষকের সমাজ-পরিবর্তনকামী ভূমিকাকে সরকার স্বাগত জানায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেহাল দশার কথা সবার জানা। অপরাজনীতির প্রবল প্রতাপের ফল সর্বত্র ফলতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিককালে প্রতিষ্ঠিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দশা আরও করুণ। রাজনৈতিক দলগুলো সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে পাঠ্যবই পর্যন্ত রাজনৈতিক আদর্শের বীজ বুনে দিতে চায়।

ভবিষ্যতে তাতে যে কী ফল ধরবে সে সম্পর্কে কোনো ভাবনা থাকে বলে মনে হয় না। সেটি যদি বুঝতেন, তাহলে অন্তত তারা দরদ দিয়ে ধর্ম, সম্প্রদায় ও রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে শিক্ষার কাঠামো ও ব্যবস্থাকে গড়তে চাইতেন। প্রশ্ন জাগে, শিক্ষাজীবনের সূচনা থেকে পরবর্তী কয়েক স্তর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ক পাঠ্যবস্তু থাকা সত্ত্বেও তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালিত্ব, বাংলাদেশ, ধর্ম বিষয়ে অসহিষ্ণুতা কেন? কেন নতুন মোড়কে পরিবেশিত হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা

আজকের বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষক বলেন, ক্লাসরুমে কথা বলা মুশকিল; ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি আর ইতিহাসই হোক না কেন! মনে হয়, কেউ ওঁত পেতে আছে, কেউ নজরদারি করছে, কেউ ষড়যন্ত্র করছে। বাংলাদেশে ধর্ম, বিজ্ঞান ও সাম্প্রদায়িকতা আজ একাকার হয়ে গেছে। গত একশো বছরের বাংলাদেশে কি এরকম অনুভূতি নিয়ে শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেছেন?

সবাই হয়তো বলবেন, তাহলে করণীয় কী? গোবেচারা মাস্টার হিসেবে করণীয় নির্ধারণের সাধ্য আমার নেই। আমি শুধু বলতে পারি, শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতিমুক্ত করা হোক। বাংলাদেশে রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষার বিষয় ও শিক্ষাদান পদ্ধতি বদলাবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। ধর্ম, রাষ্ট্র ও শিক্ষার সম্পর্ক বিষয়ে রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা প্রদান করা হোক।

আমাদের মনে রাখা দরকার, ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের সাংবিধানিক ওয়াদা। গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশও আমাদের ওয়াদার প্রধান ধাপ। আর তাই, শুধু শিক্ষককে নয়, সবাইকে বলতে দেওয়া হোক, লিখতে দেওয়া হোক। গণতন্ত্র উপভোগ্য হোক। স্বয়ং-সেন্সরশিপ মনের মধ্যে অসহিষ্ণুতা জমিয়ে তোলে, তার প্রকাশ কখনোই শুভ হয় না। 

আমি বিশ্বাস করি, কোনো পেশাই মহৎ নয়, যতক্ষণ না সে পেশা মহৎ কোনো কাজ করে। শিক্ষা/ জ্ঞান সব পেশার প্রাথমিক ভিত্তি, মানি। কিন্তু এ কথা মেনে নিয়েই বলতে চাই, ‘শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা’ -- এই অতি-ব্যবহৃত ক্লিশে ভাবনা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা দরকার। কারণ আধুনিক রাষ্ট্র তখনই এগিয়ে যেতে পারে যখন তার সঙ্গে যুক্ত থাকে নানা পেশাজীবী মানুষের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ।

সকল নাগরিকের অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ ছাড়া রাষ্ট্র নিশ্চল একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র। নাগরিকের বৈচিত্র্যকে ঐক্যবিন্দুতে নিয়ে আসা দরকার। শিক্ষা ও শিক্ষককে যদি বিভক্তি, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার খড়্গের নিচে দাঁড় করানো হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নিশ্চিতভাবেই ডুবে যাবে গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারে।

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়