ছবি : সংগৃহীত

চোখের জলের কোনো রঙ হয় না। হোক তা যেকোনো প্রাণীর। গর্তে পড়ে থাকা হাতির শাবক তুলতে মা হাতির চোখের জল নেট দুনিয়ায় বহু মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। উদ্ধার কর্মীদের সহযোগিতায় মায়ের কাছে ফিরে আসে সেই বাচ্চা হাতি। তা নিয়ে কত অভিব্যক্তি আর মতামতে ভরে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়া। জেগে ওঠে মানবতা।

অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের গুজবে কত মানুষের ঘর ভাঙে। পুড়ে যায় মন্দির। নারী-পুরুষের চোখের জল পড়ে, কান্নায় বুক ভাসায় শিশুরা। এসব ছবি দেখে সবার কি মন ভিজে উঠে? কিছু মানুষের কষ্ট লাগে, তবে সবার নয়।

পশুর জন্য কান্না করে কত মানুষ, অথচ বাপ-দাদার ভিটেমাটি হারানো অসহায়দের জন্য ততটা কষ্ট লাগে না। কিন্তু কেন? তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু বলে? কেন আমরা বুক উঁচিয়ে নির্যাতনের শিকার মানুষকে রক্ষা করতে পারছি না?

কয়েক’শ উন্মত্ত জনতার কাছে কোটি মানুষ দাঁড়িয়ে দেখবে? আমরা একসাথে তাদের প্রতিহত করতে পারব না? এমন হাজারও প্রশ্ন? উত্তর মেলে না। কিন্তু আমাদের উত্তর খুঁজতেই হবে। তা না হলে যে দেশের স্বপ্ন নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা জীবন দিয়েছিলেন, মায়েরা সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন তা যে ভুলণ্ঠিত হবে।

একাত্তরে দেশ স্বাধীনের পর ধর্ম অবমাননা নিয়ে তেমন কিছুই হয়নি। অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। খুনিচক্র ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে। আবার কেউ সংবিধানে বিসমিল্লাহ যোগ করে, বাংলাদেশের নামকরণ করে ইসলামি রিপাবলিক বাংলাদেশ। তখন থেকে বাড়তে থাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন। তৎকালীন শাসন আমলে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয় ব্যাপক হারে

কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার দায়ে ইকবাল হোসেনকে আটক করে। প্রমাণিত হয় কোনো হিন্দু কোরআন অবমাননা করেনি।

১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর থেকে আবার শুরু হয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন। তাদের অপরাধ—তারা নৌকায় ভোট দেন। নির্যাতনের ভয়ে অনেকে দেশত্যাগ করেন। ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশেও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন হয়। মন্দির ও বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর ২০০১ সালের পরের পাঁচ বছর সংখ্যালঘুদের উপর সবচে বেশি নির্যাতন হয়েছে

২০০৯ সাল থেকে একনাগাড়ে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। এই সময়েও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-হয়রানি বন্ধ হয়নি। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, পাবনার সাঁথিয়া, দিনাজপুর, সাতক্ষীরার তালা, বাগেরহাটের মংলা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, রাজশাহীর মোহনপুর, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, যশোরের বেনাপোল, মাগুরার মহম্মদপুর, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা হয়েছে।

২০২১ সালের অক্টোবরে কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগে কুমিল্লার নানুয়া দীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে হামলা হয়। পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। শুধু মন্দির বা বাড়িই পুড়েনি প্রাণও গেছে অনেকের।

মন্দির ও হিন্দু বাড়িতে হামলার চিত্র প্রায়ই একই রকম। গণমাধ্যমে কাজ করার সুযোগে বেশ কয়েকবার খবর অনুসন্ধানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে ধর্মীয় অবমাননার ভুয়া অভিযোগে অর্ধশত হিন্দু বাড়ি ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

বনগ্রাম বাজারে স্থানীয় ব্যবসায়ী বাবলু সাহার ছেলে রাজীব সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ফেসবুকে ইসলামের কটূক্তি করে পোস্ট দেওয়ার। বনগ্রাম হাটের দিন শত শত লিফলেট বিলিয়ে সাধারণ জনগণকে উত্তেজিত করা হয়। কিন্তু পরে পুলিশের তদন্তে দেখা যায় রাজীব এরকম কোনো পোস্ট দেয়নি।

কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার অভিযোগে মন্দির ও হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়। ৭০টি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরে কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার দায়ে ইকবাল হোসেনকে আটক করে। প্রমাণিত হয় কোনো হিন্দু কোরআন অবমাননা করেনি।

একইভাবে মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল, নওগাঁ শিক্ষক আমোদিনী পাল কিংবা নড়াইলের শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস কোনো ধর্ম অবমাননা না করেও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দেশে যেকোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হয়, কিন্তু বিচার হয় না। তাই থামছে না নির্যাতন।

দেশে যেকোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হয়, কিন্তু বিচার হয় না। তাই থামছে না নির্যাতন।

কাজের মেয়ে নির্যাতনের দায়ে গৃহকর্তার সাজা হয়। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘু হত্যা-নির্যাতন ও দেশত্যাগে বাধ্য করার কোনো বিচারের উদাহরণ নেই। এতেই বেপরোয়া গতিতে মন্দির ও হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়।

আওয়ামী লীগের সরকারের সময় তবুও মামলা হয়, সাময়িকভাবে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিছু সুহৃদ প্রতিবাদ করে। ক্ষতিগ্রস্তরা টাকা পায়, নতুন ঘর—নতুন মন্দির পায়। কিন্তু অপরাধীর বিচার হয় না, কঠোর সাজা হয় না।

আপাতত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে বলে মনে হলেও ভবিষ্যতের জন্য মোটেও তা মঙ্গলজনক নয়। এই আগুনে পুড়তে হতে পারে সব বাঙালিকেই। তাই এখনই সময় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার।

বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়েছেন। আমাদের উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু থেমে নেই যড়যন্ত্রকারীরা। তাদের নিয়ে নীরব লক্ষ লক্ষ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। প্রতিবাদ তো দূরের কথা টুঁ শব্দ পর্যন্ত করে না। ঠিক যেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সকালের মতো।

ধানমন্ডি ভেসে যাচ্ছে জাতির পিতার রক্তস্রোতে। আর নীরব কোটি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। আমরা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু জাতির পিতা যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের নকশা এঁকেছিলেন তা বাস্তবায়ন আমাদেরই করতে হবে।

বিপ্লব কুমার পাল ।। গণমাধ্যমকর্মী
biplobkumarpaul@gmail.com