কর্পোরেট-শাসক নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছে ক্রিকেট! এই পৃথিবী সম্পূর্ণ অন্যরকম। এই সত্যটা অনেকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। অনেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না। যে কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। গণমাধ্যম-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একেক সময় এক একটা সংকটের কথা জনমানুষের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। বিব্রত হচ্ছে। কেউ নায়ক হয়ে যাচ্ছেন। কেউ খলনায়ক বনে যাচ্ছেন!

এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেটে বড় সংকট মনে হচ্ছে- সাকিব আল হাসান! কারণ, তিনি ছুটি নিয়েছেন। দেশের হয়ে শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্ট খেলবেন না। কিন্তু ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল) খেলবেন! আর এতে উসাইন বোল্টের গতিকে হার মানিয়ে দ্রুত উপসংহারে পৌঁছে যাচ্ছেন অনেকে; সাকিব আল হাসানের দেশপ্রেম বলে কিচ্ছু নাই! তিনি অর্থলোভী! অর্থের জন্য দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন!

দেশপ্রেমের অভাব শুধু একজন সাকিব আল হাসানের! বাকি আমাদের সবার দেশপ্রেম কানায় কানায় পূর্ণ! শুধু তিনি অর্থলোভী! আমরা বাকি সবাই সংসার বিবাগী। আমরা টাকা-পয়সার দিকে ফিরেও তাকাই না!

কোন সন্দেহ নেই; দুটো টেস্টে ম্যাচের চেয়ে আইপিএলের কাঞ্চনমূল্য অনেক বেশি। কিন্তু এটাও ঠিক একজন সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ার থেকে দুটো টেস্ট ম্যাচ হারিয়ে যাবে। তার চেয়ে বড় কথা সাকিবকে আইপিএল খেলার জন্য ছুটি দিলেন কারা? মোস্তাফিজকেই বা ছুটি দেয়া হলো কেন? যারা ছুটি দিয়েছেন, তারা কি জানতেন বাংলাদেশে টেস্ট খেলবে শ্রীলংকার বিপক্ষে? সাকিবের প্রয়োজন হবে দলে?

শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্টতো আগামীতে। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যে দুই টেস্টে হারালো বাংলাদেশ,তার ময়নাতদন্তে কী বেরিয়ে আসলো, তা কি জানা যাবে? নাকি সেই ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য সাকিবের আইপিএলে খেলাকে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ছুঁড়ে দেয়া হলো! বিসিবির একজন পরিচালক গণমাধমকে বলেছেন; দলের জন্য বিদেশি কোচ আনা হচ্ছে আইওয়াশ। লোক দেখানো! বোর্ডের ভিতরে থেকে, একাধিক কমিটির দায়িত্বে যিনি, তার কথাটাকে উড়িয়ে দেয়াও কঠিন! কিন্তু বিসিবির জরুরি সভায় কি তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, আসলে কোনটা আইওয়াশ?

দেশপ্রেমের অভাব শুধু একজন সাকিব আল হাসানের! বাকি আমাদের সবার দেশপ্রেম কানায় কানায় পূর্ণ! শুধু তিনি অর্থলোভী! আমরা বাকি সবাই সংসার বিবাগী। আমরা টাকা-পয়সার দিকে ফিরেও তাকাই না!

আইওয়াশ হোক আর যাই হোক, সাধারণ মানুষ দেখেছেন, সেই পরিচালক আবার প্রাক্তনদের ক্রিকেট ম্যাচে সবার সামনে এক সাবেক অধিনায়ককে কিভাবে লাঞ্ছিত করেছেন! একটা কথা সাফ বলা ভাল, কক্সবাজারে যা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই প্রাক্তনদের দ্বারা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভালো কোনো বিজ্ঞাপন হতে পারে না। এটা লজ্জার। জাতীয় দলে খেলা কোনো সাবেক ক্রিকেটারের এই আচরণ বোর্ড কোনো বাক্য খরচ ছাড়া মেনে নিলো কি না সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে সামনে চলে এসেছে। আগামীতে বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকতে হলে লিখতে হবে; কোন ক্রিকেটার কোন কোন ফরম্যাটে খেলবে না বা খেলতে চান। সেটা বিবেচনা করেই তাকে চুক্তিতে রাখা হবে। সেটাই হওয়া উচিৎ। পাশাপাশি বোর্ড পরিচালকদেরও একটা আচরণবিধি থাকা উচিৎ। পরিচালক পদে থাকতে হলে, আপনি ক্লাব কোচিং করাতে পারবেন কি না, ফ্রাঞ্চাইজি লীগে কোন দলের সঙ্গে জড়াতে পারবেন কি না! বোর্ড পরিচালক হয়ে আবার আপনি অন্য কোন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারবেন কি না, এই বিষয়গুলো পরিচালকদের আচরণবিধির মধ্যে থাকা জরুরি। অথবা ক্রিকেট বোর্ডের দরজায় টানিয়ে দেয়া উচিৎ- ‘এখানে স্বার্থ-সংঘাত’ বলে কোনো শব্দ নেই।

জাতীয় দলের জন্য স্পিন কোচ হিসেবে ড্যানিয়েলে ভেট্টরিকে আনা লোক দেখানো! কোনো সাংবাদিক বা জাতীয় দলের কোনো ক্রিকেটার যদি কথাটা বলতেন, তাহলে জীবনভর বোর্ডের বয়কট প্রকল্পে পড়ে যেতেন তিনি। কিন্তু এক্ষেত্রে বোর্ড সভাপতি যিনি সব বিষয়ে অনেক বেশি কথা বলেন, তিনিও রহস্যজনকভাবে নীরব! অবশ্য সাংবাদিকের মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলার জন্য অন্যরকম একটা ভাবমূর্তি যার, সেই বোর্ড সভাপতি নৈঃশব্দ্যের মধ্য দিয়ে তার এক পরিচালককে হাস্যকর করে দিলেন, তা ভাবারও কোনো কারণ নেই।

তবে বিসিবির ভেতর কিছু কিছু হাস্যকর ব্যাপার ঘটছে। যেখানে পরিষ্কার, পরিকল্পনার অনেক ঘাটতি নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ ক্রিকেট। সাকিব আল হাসান টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চান না! এতদিন পরে এসে বোর্ড সভাপতি কেন গণমাধ্যমে জানাবেন? আসলে ক্রিকেট বোর্ড কি বাংলাদেশকে শক্তিশালী টেস্ট প্লেয়িং দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়? তাহলে তারা কেন লম্বা পরিসরের ক্রিকেটকে প্রাধান্য দিচ্ছেন না! বোর্ড পরিচালকরা কেন বলে বেড়াচ্ছেন, ক্রিকেটাররা চারদিনের ম্যাচ খেলতে চায় না? কী হলে চায়, সেই ব্যবস্থাটা কি আপনার নিয়েছেন? আপনাদের চাহিদাপত্রে টেস্ট ক্রিকেট কোথায় আছে সেটাও প্রকাশ করা উচিৎ। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার একুশ বছরেও যে দেশ তার ক্রিকেট অবকাঠামো এবং পরিকাঠামো উন্নয়নে কোনো পরিকল্পনা হাতে নেয়নি, তাদের কাছে টেস্ট ক্রিকেট খুব একটা গুরুত্ব পায় বলে মনে হয় না।

 

টেস্ট প্লেয়িং দেশগুলোর আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা আছে। আর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এত বছরেও একটা আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থাকে দাঁড় করাতে পারলো না। আসলে পারার চেষ্টা করলেন না। কারণ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে তাদের মনোভাবে কম। এক একটা দেশের ক্রিকেট শক্তির উৎস এক একরকম।

টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার একুশ বছরেও যে দেশ তার ক্রিকেট অবকাঠামো এবং পরিকাঠামো উন্নয়নে কোনো পরিকল্পনা হাতে নেয়নি, তাদের কাছে টেস্ট ক্রিকেট খুব একটা গুরুত্ব পায় বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রাণশক্তি ঢাকা লীগ। সেই লীগ দিনে দিনে গুরুত্ব হারাচ্ছে। ফ্রাঞ্চাইজির দৌরাত্ম্য ক্লাব সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার পথে। বোর্ড কর্তারাই যখন ফ্রাঞ্চাইজি সংস্কৃতিতে আস্থা রাখছেন, তখন সাকিব আল হাসানরা ফ্রাঞ্চাইজি লীগ খেলতে এক গোলার্ধ থেকে আরেক গোলার্ধে ছুটবেন না কেন?

এতো বছর ধরে এদেশের মানুষ এক ধরনের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। হয়তো সেটা খুব বেশি সমৃদ্ধ নয়। তারপরও সেই ক্লাব সংস্কৃতি যখন কর্পোরেট হাউজগুলোর হাতে চলে গেল, তখন ক্রিকেট জীবনের শেষ দিকে এসে সাকিব আল হাসানরা ফ্রাঞ্চাইজি সংস্কৃতির দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লে তাদের দোষ দেয়া যায় না। গোটা পৃথিবীতে পেশাদার বির্বতন হয়তো এভাবে হয়েছে। ক্রিকেট ব্যতিক্রমী ভাবে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবে?

তবে সাকিব আল হাসানদের জন্যও একটা কথা লিখতে হচ্ছে; ক্রিকেটের নতুন সভ্যতার সঙ্গে আপনারা খুব দ্রুত মানিয়ে নিয়েছেন। আয়-রোজগারও যা হয়েছে তাতে আপনাদের বা আপনাদের পরর্বতী প্রজন্মকে আর পেছনে না ফিরলেও চলবে। তবে কোনো একদিন আক্ষেপ হতে পারে, হারিয়ে যাওয়া পুরনো দিনের কথা মনে করে। কারণ, এখনও অনেক ক্রিকেট দার্শনিক মনে করেন; ম্যান অফ দ্য ম্যাচের ট্রফি, চেক হাতে নেয়া এটা কোন মুহূর্ত নয়। আসল সুখ হচ্ছে, এক একটা সেঞ্চুরি পূর্ণ করার মুহূর্ত। টেস্ট ক্রিকেটে আপনি বা আপনারা কি সেরকম কোনো মুহূর্ত মিস করবেন? প্রশ্নটা আপনাদের কাছে।

অঘোর মন্ডল ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক

aghoremondal@gmail.com