মোটরসাইকেল জনপ্রিয় বাহন এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তা নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা লেগেই আছে। ঈদুল আজহায় দেশের মহাসড়কে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মোটরসাইকেলের চলাচল সীমিত করা হয়েছিল, এছাড়াও পদ্মা সেতু ও এর এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেলের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

অনেক দেশেই এক্সপ্রেসওয়ে রোডে মোটরসাইকেলের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে সড়ক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে যেমন পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, সাউথ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভেনিজুয়েলা ইত্যাদি দেশে সব ধরনের এক্সপ্রেস রোডে মোটরসাইকেলের চলাচল নিষিদ্ধ, চায়নাতে ৭০ কিমি/ঘণ্টা-এর কমে এক্সপ্রেস রোডে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ, তাইওয়ানে এক্সপ্রেস রোডে ৫৫০ সিসি-এর কম ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যেসব দেশ এক্সপ্রেস রোডে মোটরসাইকেলের চলাচল নিষিদ্ধ করেছে তাদের কিন্তু রাস্তার পরিমাণ অনেক এবং বিকল্প রাস্তা ও বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা এতটাই উন্নত যে তারা চাইলেই সহজেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারে।

আরও পড়ুন : মোটরসাইকেল কেন এত জনপ্রিয়?

আমাদের দেশে যেহেতু সড়কের পরিমাণ একদিকে কম অন্যদিকে বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, সেহেতু মোটরসাইকেলের উপর দীর্ঘমেয়াদি নিষেধাজ্ঞা জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

মনে রাখতে হবে, একটি ওষুধ রোগীর জন্য যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন যদি এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বেশি হয় তাহলে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার ঐ ওষুধ প্রয়োগের আগে কিছুদিন সময় নিয়ে আগে রোগীকে স্থিতিশীল করেন।

আমরা যদি একইভাবে মোটরসাইকেলকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই তাহলে এটা হবে পুলিশের জন্য আরেকটি বড় মাথা ব্যথার কারণ আর এই সুযোগে অনেক অব্যবস্থাপনা বা হয়রানির ঘটনাও ঘটতে পারে।

মোটরসাইকেল অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ একটি বাহন বলে প্রমাণিত কিন্তু আমরা দুই দিনের সিদ্ধান্তে একে মহাসড়কে চলাচল দীর্ঘমেয়াদে নিষিদ্ধ করতে গেলে তা হিতে বিপরীত হবে এবং সব চাপ এসে পড়বে প্রশাসন বা পুলিশের ওপর।

উদাহরণস্বরূপ নসিমন, করিমন, থ্রি হুইলারকে মহাসড়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গিয়ে আমরা পুরো চাপ দিয়ে দিলাম পুলিশের কাঁধে।

আরও পড়ুন : যত দুর্ভোগ, তত ক্ষমতা! 

এই সিদ্ধান্ত টেকসইভাবে বাস্তবায়নের জন্য আমাদের প্রয়োজন ছিল সার্ভিস রোডের এবং স্বল্প দূরত্বে চলাচলের জন্য ছোট কোস্টার বাস বা পিক-আপের। কিন্তু এসব প্রস্তুতি ছাড়াই যখন আমরা এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলাম দেখা গেল পুলিশ যখন এদের আটক করে তখন জনগণ থেকে শুরু করে অনেক রাজনৈতিক চাপ এসে পড়ে তাদের ওপর।

এখন আমরা যদি একইভাবে মোটরসাইকেলকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই তাহলে এটা হবে পুলিশের জন্য আরেকটি বড় মাথা ব্যথার কারণ আর এই সুযোগে অনেক অব্যবস্থাপনা বা হয়রানির ঘটনাও ঘটতে পারে।

মনে রাখতে হবে, মানুষের আচরণ পরিবর্তন হুট করে হয় না, সময় দিতে হয় এবং এর জন্য কৌশলী হতে হয়। বনের রাজা সিংহকে আপনি-আমি ভয় পেয়ে খাঁচায় রেখে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখি সেই সিংহকেই কিন্তু কেউ না কেউ পোষ মানায়, প্রশিক্ষণ দিয়ে খেলা দেখায়।

যিনি এই সিংহকে দিয়ে আজ সার্কাসে খেলা দেখাচ্ছেন তিনি কিন্তু এই কাজ দুই দিনেই করার চেষ্টা করেননি, বরং তিনি ধীরে ধীরে সিংহের আচরণ পরিবর্তন করেছেন।

আরও পড়ুন : মতিন সাহেবের মোটরসাইকেল 

যে প্রাণীর ভাষা আমরা জানি না, যে প্রাণী আদতে হিংস্র, যে কি না থাকে বনের মধ্যে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল যখন আমাদের জানা, তখন যারা মোটরসাইকেল চালিয়ে আমাদের যানজট এড়িয়ে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে দিচ্ছেন, তারা আমার পাশেই থাকেন, যার ভাষা আমরা জানি, যিনি ২০২২ সালের রোজার ঈদে আমাদের বাসের বাড়তি ভাড়া দেওয়া থেকে রক্ষা করলেন তাকে কি আমরা তার ভালোর জন্য, তার নিরাপত্তার জন্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না?

অবশ্যই পারব, আর এজন্য আমাদের প্রয়োজন হবে মোটরসাইকেল আরোহীদের নিরাপদ করা এবং একই সাথে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছু মধ্যপন্থা ব্যবহার করা। ঝুঁকিপূর্ণ মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এবং এর আরোহীদের নিরাপদ করতে হলে কী কী কারণে সাধারণত দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটে তা জানা দরকার।

দুর্ঘটনার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনা রিসার্চ ইন্সটিটিউট বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে। যেমন হেলমেট ব্যবহার না করা বা মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করা, গতিসীমার চাইতে বেশি গতিতে চালানো, নেশা বা অ্যালকোহলের প্রভাব, চালকের বয়স ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি, বেপরোয়া বা এলোমেলোভাবে চালানো, ভুলভাবে ব্রেক প্রয়োগ করা ইত্যাদি।

আরও পড়ুন : অনিপরাদ সড়কে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন

শুধুমাত্র চালকের কারণেই যে দুর্ঘটনা ঘটে তা কিন্তু নয়, অনেক সময় রাস্তার কারণেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে যেমন, একই রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন গতির যান চলাচল, রাস্তার খারাপ অবস্থা, রাস্তার নির্মাণ ত্রুটি, রাস্তার পার্শ্ববর্তী পরিবেশ, আচমকা ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা ইত্যাদি।

শুধুমাত্র চালকের কারণেই যে দুর্ঘটনা ঘটে তা কিন্তু নয়, অনেক সময় রাস্তার কারণেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে যেমন, একই রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন গতির যান চলাচল...

আমরা একদিকে যেমন মোটরসাইকেলের সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করব অন্যদিকে এর আরোহীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার শর্তে সড়ক মহাসড়কে চলতেও দিব। এক্ষেত্রে যেসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটে সেইসব কারণকে আমরা সিস্টেম থেকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি।

যেমন হেলমেটের স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করে কঠোরভাবে সেই মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, মহাসড়কে মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা গতিসীমা দেওয়া যেতে পারে এবং কেউ যদি তা অমান্য করে তাহলে সর্বোচ্চ ফাইন ও ঐ চালকের লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত বা ঐ মোটরসাইকেলের মহাসড়কে চলাচল সাময়িক নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন : মোটরসাইকেল কীভাবে দূরপাল্লার পরিবহন হয় 

মহাসড়কে চলাচলের জন্য ন্যূনতম বয়সসীমা দেওয়া যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ‘Powered Two-Three Wheeler Safety-A Road Safety Manual for Decision Maker and Practitioners’ অনুসারে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মানুষের মোটরসাইকেলের মৃত্যুহার বেশি যেখানে উন্নত দেশে তা গড়ে ৫৫ বছর।

এই বিশ্লেষণ বিবেচনায় একটি নিরাপদ বয়সসীমা আমরা নির্ধারণ করতে পারি মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে, এছাড়াও অন্যান্য সড়কে একজন যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে পারলেও মহাসড়কে চালক ব্যতীত অন্য কোনো যাত্রী পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে, মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনের সিসি নির্ধারণ করা যেতে পারে।

পৃথিবীর অনেক দেশেই মহাসড়কে চলাচলের জন্য একটা নির্দিষ্ট সিসি সীমা রয়েছে, এক্ষেত্রে ন্যূনতম ১৫০ সিসি মোটরসাইকেল মহাসড়কে চলাচলে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে, মহাসড়কে চলাচলের জন্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তা উপকরণ যেমন নি গার্ড, রেট্র-রিফ্লেক্টিভ ভেস্ট ইত্যাদি বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন : পরিবহন নৈরাজ্য! 

এর পাশাপাশি সড়কে যেন কোনো প্রকার গর্ত, পিচ্ছিল উপকরণ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা, ভাঙাচোরা ইত্যাদি না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং পর্যাপ্ত সাইন ও মার্ক থাকতে হবে।

যেসব কোম্পানি রাইড শেয়ারিং করছে তারা যেন বাধ্যতামূলক তাদের চালককে সড়ক নিরাপত্তার প্রশিক্ষণ প্রদান করে তা নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আমরা একদিকে যেমন মোটরসাইকেলের চলাচল সীমাবদ্ধ করতে পারব তেমনিভাবে এর ব্যবহারকারীদের নিরাপদ রাখতে পারব।

বর্তমানে একটি মিনিবাস (নাগরিক যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বাহন)-এর বিপরীতে মোটরসাইকেল আছে প্রায় ১৩৫টি। এভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে যেকোনো বাহনের তুলনায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেশি।

আরও পড়ুন : গণপরিবহন কি জনভোগান্তির অপর নাম? 

আমি নীতিনির্ধারকদের কাছে জানতে চাই, তারা কি ১৩৫ জন মোটরসাইকেল চালককে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাদের মেধা, শ্রম ও সম্পদ বিনিয়োগ করবেন নাকি তার বিপরীতে মাত্র ৩ জন বাস চালককে নিয়ন্ত্রণ করার কথা চিন্তা করবেন।

আশা করি, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন আর একই সাথে ধীরে ধীরে সঠিক কৌশলে বিদ্যমান মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। আমি এটাও আশা করছি যে, মোটরসাইকেলের এই পরীক্ষায় আমরা সঠিক প্রশ্ন নির্বাচন করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভালো নম্বর অর্জন করব।

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট