বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকটে চলমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যয় হ্রাস, জ্বালানি সাশ্রয়ে নানা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং সাধারণ মানুষের অতিপ্রয়োজনীয় নিত্য ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ১ কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রিসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

হঠাৎ করে ৫ আগস্ট ২০২২ মধ্য রাতে ডিজেল, কেরোসিন ও অকটেনের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণার সাথে সাথেই সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণার পর পর ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে পেট্রোল পাম্পগুলোতে তেল সংগ্রহের চেষ্টা করা হলেও মানুষের সেই চেষ্টা বিফল হয়।

৬ আগস্ট সকালে ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে চট্টগ্রাম আসার পথে ঘটে মজার কাহিনি। সিএনজিসহ অনেক গণপরিবহন গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সময় সবগুলো যেভাবে গ্যাস চালিত হয়ে গিয়েছিল। এবার দেখি সবগুলো ডিজেল চালিত হয়ে গেল।

আরও পড়ুন : অনিপরাদ সড়কে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন 

সকালে অধিকাংশ গণপরিবহন উধাও হয়ে গেল। রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। সবার বক্তব্য গাড়ী চালানো যাবে না। যথারীতি একই অবস্থা অন্যান্য সেক্টরগুলোতেও। ট্রেনে চিপস বিক্রেতা আগে ২০ টাকায় চিপস বিক্রি করতো।

এবার গলা ফাটিয়ে বলছে ‘আগের ২০ টাকার চিপস এখন ২৫ টাকা।’ তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম কারণ কি? বলল, ‘মালিক সকালে ফোন করে বলে দিয়েছে ডিজেল কেরোসিনের দাম বাড়ায় ৫ টাকা দাম বাড়াতে বলেছেন। কারণ তাদের রান্নায় ডিজেল-কেরোসিন দরকার।’

এভাবে একবার সয়াবিন তেলের দাম, একবার গমের দাম, একবার ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, একবার ডলারের দাম, আবার জ্বালানি তেলের বৃদ্ধির কারণে আমাদের সবগুলো খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। আর বাড়তি দাম কমানোর কোনো দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুন : হাফ ভাড়া, পরিবহন খাতে উচ্ছৃঙ্খলতা ও নৈরাজ্য

এমনকি বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমতির দিকে তখন উল্টো আমাদের দেশে বাড়ানো হলো। এক ব্যারেল ক্রুড অয়েলের দাম ১৪০ ডলারে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যা এখন ৯০ ডলারে নেমে এসেছে।

এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ করে একলাফে ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা মূল্য ডিজেল প্রতি লিটার ৮০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১১৪ টাকা, কেরোসিন ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা প্রতি লিটার ও পেট্রোল ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা প্রতি লিটার নির্ধারণ করা হয়।

একবার সয়াবিন তেলের দাম, একবার গমের দাম, একবার ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, একবার ডলারের দাম, আবার জ্বালানি তেলের বৃদ্ধির কারণে আমাদের সবগুলো খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়...

করোনা পরবর্তী সময় থেকে দেশে সকল নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চাল, চিনি, সবজির দামের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকায় নাভিশ্বাস। এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি।

গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মূল্যও দফায় দফায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। বেড়েছে ডলারের অস্বাভাবিক দামও। কয়েকদিন আগে সীমিত আয়ের মানুষের ভরসাস্থল টিসিবি ও মিল্কভিটার পণ্যের দামও বাড়ানো হলো। এই অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির তীব্র সমালোচনা করেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলমসহ অনেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন : পরিবহন নৈরাজ্য! 

ড. শামসুল আলম বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষকে মূলত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হলো। জ্বালানি তেলের এই পরিমাণ মূল্য বৃদ্ধি অন্যায্য, অগ্রহণযোগ্য। করোনার কষাঘাতে, মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। এই সময়ে এই দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। জ্বালানি তেলের এই দাম বৃদ্ধি বেআইনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন অনুযায়ী তেলের দাম বৃদ্ধি করবে কমিশন। কিন্তু কমিশনকে পাস কাটিয়ে এভাবে দাম বাড়ানো ফৌজদারি অপরাধের শামিল। বিপিসি যদি গণশুনানিতে আসতো তাহলে তাদের হিসেব দিতে হতো। এই পরিমাণ দাম বাড়াতে পারতো না। এটা জনগণের প্রতি জুলুম। হতদরিদ্র মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে যাবে।’ বিপিসির দুর্নীতি ও তেল চুরি বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।

অন্যান্য দেশ অনেক আগেই তাদের জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে আর বাংলাদেশ সরকার ভর্তুকি দিয়ে এসেছে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্যও অপেক্ষা করেছে। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই জ্বালানি তেলের মূল্য অ্যাডজাস্টমেন্টে যেতে বাধ্য হচ্ছে সরকার।

আরও পড়ুন : গণপরিবহন কি জনভোগান্তির অপর নাম?

জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধি ভোক্তা পর্যায়ে ‘মারাত্মক বিরূপ্রভাব’ ফেলবে। কেরোসিন এবং ডিজেলের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত পণ্যের বাজারে আগুন ধরবে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতকে নতুন করে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিটিা পণ্যের আরেক দফা দাম বাড়িয়ে দিবে।

দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষিতে সেচ খরচ বাড়বে, রপ্তানিমুখী শিল্পে ডিজেলের খরচ বাড়বে, পণ্য পরিবহন, গণপরিবহনে যাতায়াত খাতে ব্যয় বৃদ্ধি থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্য ও সেবার দাম ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়ে জনজীবনে মারাত্মক দুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারে। যা চলমান মূল্যস্ফীতির চাপকে আরও বেগবান করতে পারে।

সাধারণ মানুষের জন্য নিত্যপণ্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্যবৃদ্ধির অস্বাভাবিক যন্ত্রণা আরেক দফা বাড়বে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ঘোষণার সাথে সাথে বাজারে নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন লেগে যাবে, হু হু করে সকল খাদ্য-পণ্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়ে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে।

ড. শামসুল আলম বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষকে মূলত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হলো। জ্বালানি তেলের এই পরিমাণ মূল্য বৃদ্ধি অন্যায্য, অগ্রহণযোগ্য...

সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি হ্রাসের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে এর প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে যা খুবই ভয়াবহ হতে পারে। অন্যদিকে বিগত বেশ কিছুদিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রতিফলন ঘটেনি।

আরও পড়ুন : যত দুর্ভোগ, তত ক্ষমতা! 

তবে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের দাম কমতির দিকে ছিল। দাম যখন কম ছিল তখন সরকার বাংলাদেশে দাম সমন্বয় করেনি। দাম সমন্বয় না হওয়াতে এখন বাজারে বিরূপ প্রভাব দেখা দিবে।

সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে যদি নিয়মিত সমন্বয় করতো তাহলে সেটার একটা অবস্থা তৈরি হতো। এখন হঠাৎ করে দাম বৃদ্ধির সুযোগ নেবে ব্যবসায়ীরা। এই অবস্থায় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের গণশুনানি ব্যতিরেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা হতাশাজনক।

সরকার বিশ্বব্যাংক, এডিবিও আইএমএফ’র পরামর্শে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি হ্রাস ও ভারতে তেল পাচার হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি বাহানা তুলে দেশের জনগণের উপর বর্ধিত মূল্য চাপিয়ে দিলেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ জনগণের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হবে সেই বিষয়ে নজর না দিয়ে বহুজাতিক গোষ্ঠীর নিয়োগকৃত গুটি কয়েক বিশেষজ্ঞের পরামর্শে সরকারের একতরফা সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী যা সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ও সরকারের সাথে সাধারণ জনগণের দূরত্বকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।

আরও পড়ুন : তেলের গায়ে আগুন 

তাই এই ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসা উচিত। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি, সেবা সার্ভিসের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সাধারণ জনগোষ্ঠীর জনজীবন যাত্রার মূল্যবৃদ্ধিসহ জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়।

এছাড়াও সরকার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের অব্যবস্থাপনা, তেল চুরি, সীমাহীন দুনীর্তি ও অপচয় বন্ধ না করে এবং জ্বালানি তেলের ওপর শুল্ক না কমিয়ে সাধারণ জনগণের উপর অবৈধ চাপ প্রয়োগ করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে ব্যস্ত। এক্ষেত্রে বিইআরসি ঠুঁটো জগন্নাথ ছাড়া আর কিছু নয়।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম সংস্থা (বিপিসি) বিভিন্ন সময়ে ভর্তুকির অজুহাত তুলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালেও এর অন্তর্নিহিত কারণগুলো বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন (বিইআরসি)-র গণশুনানির মাধ্যমে বিষয়টি খোলামেলাভাবে জনগণকে জানানো উচিত।

এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি ও সেবা সার্ভিসের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে সেখানে নতুন করে তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির সুযোগ করে দিয়ে জনভোগান্তি আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে যা বাঞ্ছনীয় নয়। 

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)