ছবি : সংগৃহীত

জনগণের স্বাস্থ্য বহুমুখী প্রতিকূলতায় জর্জরিত। ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’র মতো স্বাস্থ্য প্রতিকূলতা আমাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তুলছে। যেখানে শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ সেখানে একটি শিশুর জন্মদান অনিরাপদ করে তুলছে মানহীন অবৈধ ক্লিনিক, হাসপাতাল।

ভুয়া সার্জনের হাতে অপ্রয়োজনীয় সিজার করতে গিয়ে শুধু গর্ভস্থ সুস্থ শিশুই নয়, সুস্থ প্রসূতিরও জীবনাবসান হচ্ছে। এগুলো একটি দেশের জন্য অমার্জনীয় অপরাধ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেশের মানুষের জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে পদে পদে মানুষকে হয়রানি, শোষণ, প্রতারণা এমনকি জীবনের ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা, অপারেশন ও ওষুধপত্র কিনতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে, অনেক চেষ্টায় উঠে আসা প্রান্তিক মানুষেরা স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে আরও দরিদ্র পীড়িত হয়ে পড়ছে।

আরও পড়ুন : অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক সিলগালা : বেটার লেট দ্যান নেভার 

একি সেই বাংলাদেশের চেতনা, যার জন্য জীবন বাজি রেখেছে দেশের আপামর জনসাধারণ? একি সেই সোনার বাংলা যার জন্য জাতির জনক সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন, একটি দেশের সৃজন করেছেন, আমৃত্যু আপামর মানুষের কথা ভেবে পরিকল্পনা করেছেন?

শহুরে স্বাস্থ্যসেবা গ্রামে নিয়ে গেছেন, থানায় থানায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স করেছেন, প্রয়োজনীয় ওষুধ, চিকিৎসকের ব্যবস্থা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেবামুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেই যে বাণিজ্যমুখী হলো, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা জনবিমুখ হতে শুরু করল, আমরা এখন তার চূড়ান্ত শিকার।

এরপর যেকোনো সরকার, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা বাণিজ্যমুখী করতে হেন চেষ্টা নেই যা করছে না। ফলশ্রুতিতে সরকারি হাসপাতালে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা ৮০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেবামুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেই যে বাণিজ্যমুখী হলো, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা জনবিমুখ হতে শুরু করল, আমরা এখন তার চূড়ান্ত শিকার...

বাংলাদেশে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা এখন স্বাস্থ্য বাণিজ্য। ওষুধের দোকান, প্যাথলজি সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতাল গিজ গিজ করছে শহর বন্দর গাঁও গেরামে।

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?

চারদিক থেকে শ্বাস চেপে মেরে ফেলা হচ্ছে সরকারি হাসপাতালগুলো। হাসপাতালের গেট থেকেই শুরু ওষুধের দোকান, প্যাথলজি সেন্টার, ক্লিনিক, অ্যাম্বুলেন্সের বহর, দালাল ধান্দাবাজ।

বিদেশ থেকে উপার্জন করে কিছু টাকা হাতে এসেছে, ব্যবসা করার ইচ্ছে, বয়স্কদের উপদেশ ওষুধের দোকান দাও। আরেকটু বেশি টাকার মালিক হলে ক্লিনিক দাও, হাসপাতাল দাও।

দেশের সব বড় ব্যবসায়ী পাঁচ তারকা হাসপাতাল চালু করেছে। ফলে দেশে এখন হাজার হাজার ওষুধের দোকান, প্যাথলজি সেন্টার, ক্লিনিক, ছোট মাঝারি বড় হাসপাতাল।

চল্লিশের আগে আমরা যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বা নবীন চিকিৎসক তখন সারা দেশে কয়েকশ বা হাজার খানেক প্রাইভেট প্যাথলজি সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতাল ছিল। তাদের বেশিরভাগের মালিক ছিলেন দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক; তারা নিজেরাই সেগুলোর মান নিয়ন্ত্রণে সক্ষম ছিলেন ও সচেষ্ট ছিলেন।

তখন সীমিত জনবল নিয়ে হাসপাতাল পরিচালক দেশের গুটিকতক সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও প্রাইভেট প্যাথলজি সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতাল মোটামুটি সামাল দিতে পারতেন। কিন্তু প্রায় একই জনবল দিয়ে ক্যান্সারের ন্যায় বৃদ্ধি পাওয়া সরকারি ও প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা কি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? আদৌ সম্ভব যে নয়, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি।

আরও পড়ুন : সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন কেন জরুরি

অসংখ্য অবৈধ প্যাথলজি সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতালের চিত্র একই। এগুলোর ভেতরকার অবস্থা যে কতটা ভয়াবহ, তা কোনো কোনো হতভাগ্য মানুষ নিজের মূল্যবান জীবন হারিয়ে, প্রিয়জনকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে প্রমাণ করে যাচ্ছেন। তারপরও আমাদের টনক নড়ছে না। হয়তো নড়বার কথাও নয়, ডিজেল, পেট্রোলের মতো দামি তো নয় আমাদের জীবন।  

বাংলাদেশে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা এখন স্বাস্থ্য বাণিজ্য। ওষুধের দোকান, প্যাথলজি সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতাল গিজ গিজ করছে শহর বন্দর গাঁও গেরামে।

এখন কথা হলো সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলা, জীবন নিয়ে ব্যবসা, আমাদের দেশ আর কতদিন মেনে নেবে? কতদিন দেশের আপামর জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে অবর্ণনীয় প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, শোষণ, নির্যাতনের শিকার হতে হবে।

স্বাস্থ্য বিভাগ তীরবিদ্ধ হয়ে কখনো কখনো অসংখ্য অবৈধ প্যাথলজি সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতালের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নিচ্ছে। তাও কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে না এবং এই ক্যান্সার নিরাময়ে স্বাস্থ্য বিভাগ যে অসহায় তা প্রকাশিত হওয়ায় দুঃশ্চিন্তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্যের অব্যবস্থাপনা, দায়দায়িত্ব কার?

কে রুধিবে এই ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন অপ-স্বাস্থ্যসেবা? এই ক্যান্সারের মেটাস্ট্যাসিস ঘটছে, সামান্য কেমোথেরাপিতে এটা যে সারবে না, তা শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ নয় আমাদের সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে।

বড়সড় অপারেশনের পরিকল্পনা করতে হবে। দপ্তরকে অধিদপ্তরে উন্নীত করতে হবে, যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন করে এই অপরাধী চক্রকে দীর্ঘ বা আজীবন কারান্তরাল নিশ্চিত করতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সময়, শৃঙ্খল, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা যদি মান সম্পন্ন মানবিক স্বাস্থ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটাতে না পারি, তা হলে দেশের উন্নয়ন ‘দূর অস্ত’।