করোনা মহামারির পর থেকে অধিকাংশ মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনায় বারবার লকডাউনে সীমিত আয়ের মানুষের একদিকে যেমন আয় কমেছে, অন্যদিকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে একটি বিশাল অংশের কর্মক্ষম মানুষ। এর মধ্যে নতুন উপসর্গ যুক্ত হয়েছে নিত্যপণ্যের বাজার।

দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের দু’মুঠো অন্ন জোগাড় করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে নিত্য খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। অথচ করোনা চলাকালীন সময়েও এভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়েনি। শুধু যে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, তা নয়। বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম।

ব্যবসায়ীরা নিত্যভোগ্য ও ব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধিকে অজুহাত দেখান। তবে ভোজ্যতেল ও চালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমতির দিকে হলেও আমাদের দেশে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ব্যবসায়ীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে।

আরও পড়ুন : আসুন মুড়ি খাই! 

সাম্প্রতিক বৈশ্বিক মন্দায় সাধারণ মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু যারা উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত, তারা ছাড়া সব মানুষই ভীষণ কষ্টে আছে। তবে অনেকে প্রকাশ করতে পারছে, আবার অনেকেই পারছে না। তবে বিশেষ করে যারা নির্দিষ্ট আয়ের (ফিক্সড ইনকাম গ্রুপ), অথবা সীমিত আয়ের মানুষ অথবা যারা অবসর জীবন যাপন করছেন, তারা ভয়াবহ সংকটে আছেন। পরিবারের খরচ মেটাতে ব্যয় কাটছাঁট করতে করতে অবস্থা অনেকটা এমন যে জামা কাটতে কাটতে দেখা যাবে আর অবশিষ্ট কিছুই থাকছে না।

নগরাঞ্চলের মানুষের আয়ের একটি বড় উৎস ঘরভাড়া। আবার চাকরিজীবী ও অবসরপ্রাপ্তদের আয়ের উৎস সঞ্চয়পত্রের মুনাফা। কিন্তু ভাড়া গ্রহণে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা যেমন কমছে, তেমনি ভাড়া দিতে সক্ষম লোকের সংখ্যাও কমেছে। আবার অনেকে করোনা পূর্বের হারে ভাড়া প্রদানেও সক্ষমতা হারাচ্ছেন।

সরকারের ব্যবসা, তা দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা, মানুষকে স্বস্তিতে ও শান্তিতে রাখার জন্য। যে উদ্দেশ্যে সরকার ব্যবসা করে, সেই উদ্দেশ্য থেকে তারা সম্পূর্ণরূপে সরে আসছে। তাদের ব্যবসা এখন মুনাফার জন্য।

অন্যদিকে সরকারও সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে এই সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল মানুষের ও আয় কমেছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন এই খাতের ওপর নির্ভরশীল শ্রেণি। জ্বালানি তেলের ওপর দেশের অর্থনীতির অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। আর এই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি বা কমানোর কারণে মূল্যস্ফীতি হারও অনেকটা উঠানামা করে থাকে।

আরও পড়ুন : প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার দায় 

সরকার ২০২২ সালের আগস্ট মাসে আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে গণপরিবহনসহ নিত্যপণ্যের পাশাপাশি সব ধরনের পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে গিয়েছে। আর ব্যবসায়ীরা করোনা মহামারি, ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ ও ডলারে মূল্যবৃদ্ধির পাশে আরও একটি নতুন অজুহাত পেল জ্বালানি তেলে মূল্যবৃদ্ধি করার।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সরকার জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির একচেটিয়া ব্যবসা করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকার জ্বালানি তেল অনেক ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করেছে।

দেশের ক্রেতা-ভোক্তাদের জাতীয় প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর পক্ষ থেকে বারবারই জ্বালানি তেলের দাম কমানো ও সমন্বয় করার দাবি উত্থাপন করা হচ্ছে। একই সাথে জ্বালানি তেলের মুনাফার টাকা দিয়ে মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য পৃথক তহবিল গঠনের দাবি করা হয়।

আরও পড়ুন : ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই’ 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কর্তাব্যক্তিদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, পাঁচ-ছয় বছরে বিপিসি ৪২ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। আর এই মুনাফা দিয়ে তারা কিছু উন্নয়ন প্রকল্পও গ্রহণ করেছে।

তবে সেই প্রকল্পগুলো কতটুকু প্রয়োজন ছিল, কতটুকু জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য সহায়ক কি না, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার।

ব্যবসায়ীদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, পুরো দেশটাই যেন দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতার হাট। এখানে সরকারি সেবা সংস্থা, বেসরকারি ও ব্যক্তিখাত সকলেই যেন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

এবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সময় ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসানের কথা বলা বলছে। আর এই লোকসান মেটানোর জন্য বিপিসির তিনটি স্থায়ী আমানত ভাঙা হয়েছে। এই টাকা কোথা থেকে এলো? এই আমানত তো মুনাফার টাকা।

রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জ্বালানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম মৌলিক রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সরকার ব্যবসা করে লাভ-লোকসান করার জন্য নয়। সরকারের ব্যবসা, তা দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা, মানুষকে স্বস্তিতে ও শান্তিতে রাখার জন্য। যে উদ্দেশ্যে সরকার ব্যবসা করে, সেই উদ্দেশ্য থেকে তারা সম্পূর্ণরূপে সরে আসছে। তাদের ব্যবসা এখন মুনাফার জন্য।

আরও পড়ুন : জ্বলছে জ্বালানি তেল 

মুনাফার জন্য ব্যবসা করার কথা নয় কোনোভাবেই একটি কল্যাণমুখী সরকারের করার কথা নয়। সরকারি উদ্যোগে ব্যবসার যে মূল দর্শন, সেটা যদি যথাযথভাবে অনুসরণ করা না হয়, তাহলেই দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে নানা রকমের সংকট এবং অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে।

ব্যবসায়ীদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, পুরো দেশটাই যেন দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতার হাট। এখানে সরকারি সেবা সংস্থা, বেসরকারি ও ব্যক্তিখাত সকলেই যেন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আর এর বলি হচ্ছেন দেশের প্রান্তিক, সীমিত আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত। যাদের কান্না শুনার কেউ আছে বলে সেটা প্রতীয়মান নয়।

আরও পড়ুন : তেলের গায়ে আগুন 

ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা অর্জন করতে চাইবেন, এটা তার চিরাচরিত চর্চা। তাই অর্থনীতির এই চলমান অস্থিরতা দূর করতে সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সত্যিকারের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বাজারে ন্যায্য ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

বাজার তদারকিতে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত বাজার তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। ভোক্তা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর নীতিনির্ধারণে ভোক্তাদের সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত  করে ভোক্তাদের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে।

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)