কলম্বাসের এই গল্পটি কয়েক মাস আগে একটি লেখায় বলেছিলাম। প্রাসঙ্গিক হওয়ায়, এখানেও বলছি।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস সবে আমেরিকা আবিষ্কার করে (এবং আমেরিকান আদিবাসীদের ১২টা বাজিয়ে) স্পেনে ফিরেছেন (তিনি ইতালির লোক হলেও, আমেরিকা আবিষ্কার করেন স্পেনের অর্থায়নে)। চারিদিকে তার জয়-জয়কার। কিন্তু স্প্যানিশ সমাজের উপরতলার একশ্রেণির হিংসুটে মানুষের সহ্য হচ্ছিল না। কলম্বাসের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজের টেবিলেই তাদের সেই হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো।

খাবার টেবিলে একজন বলে বসলেন, ‘মিস্টার ক্রিস্টোফার, আপনি যদি আমেরিকা আবিষ্কার না-ও করতেন, আমাদের মহান স্পেনের কোনো-না-কোনো মহান ব্যক্তি তা ঠিকই আবিষ্কার করতেন; এটা আসলে কোনো কঠিন কাজ নয়।’ কলম্বাস উত্তরে কিছু বললেন না, শুধু একটি কাঁচা ডিম চেয়ে আনালেন। ডিম দেখে উপস্থিত উপরতলার লোকজন তো অবাক! ডিম দিয়ে কী হবে? কলম্বাস কী করতে চান? কলম্বাস বললেন, ‘উপস্থিত সুধী, আপনারা কি ডিমটি এই মসৃণ টেবিলের উপর, অন্য কোনোকিছুর সাহায্য না-নিয়ে, দাঁড় করাতে পারবেন? প্রশ্ন শুনে একজন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, বললেন, ‘এ আর এমন কী কাজ! আমাকে দিন, আমি করে দেখাচ্ছি।’

ডিমটি তার কাছে দেওয়া হলো। তিনি অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ডিমটি দাঁড় করাতে পারলেন না। তারপর একে একে উপস্থিত সবাই চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। তাদের সবার হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত ডিম এলো কলম্বাসের হাতে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়া ভদ্রলোকের মুখে তখন মৃদু হাসিও নেই। তিনি অনেকটা চ্যালেঞ্জের সুরে বললেন, ‘খুব তো মজা নিলেন, আপনি পারবেন ডিম দাঁড় করাতে?

কলম্বাস বললেন, ‘পারব।’ বলেই তিনি ডিমটি লম্বালম্বিভাবে ধরলেন এবং শক্ত টেবিলে আলতো করে ঠুকে দিলেন। এতে ডিমের একটি মাথা সামান্য থ্যাতলে গেল। কলম্বাস তখন দিব্যি ডিমটি মসৃণ টেবিলে দাঁড় করিয়ে দিলেন!

গোটা কক্ষজুড়ে তখন গুঞ্জন শুরু হলো। একজন বললেন, ‘এ তো দেখছি খুবই সহজ কাজ!’ কলম্বাস বললেন, ‘এতক্ষণ আপনারা সবাই কাজটা করার চেষ্টা করেছেন এবং ব্যর্থ হয়েছেন। যখন আপনারা একের পর এক ব্যর্থ হচ্ছিলেন, তখন কাজটাকে কি আপনাদের কাছে কঠিন বা অসম্ভব মনে হয়নি? আপনারা ব্যর্থ হয়েছেন, কারণ আপনাদের মাথায় আইডিয়া ছিল না; কীভাবে কাজটা করা যায়, সেই কৌশল আপনাদের জানা ছিল না। আমার মাথায় আইডিয়া ছিল, আমি কৌশল আবিষ্কার করেছি। এখন আপনাদের কাছে কাজটা সহজ মনে হচ্ছে।’

উপস্থিত সবাই তখন বুঝতে পারলেন, কলম্বাস কী বলতে চান। যারা, তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করছিলেন, তাদের মাথা নত হলো।

গল্পটা আমি আমার নিজের মতো করে বললাম। মূল কাহিনির উল্লেখ আছে ইতালির মিলানের বণিক ও পরিব্রাজক জিরোলামো বেনজোনির (Girolamo Benzoni) গ্রন্থ হিস্টোরি অব দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড-এ (History of the New World)। বইটি প্রকাশিত হয় ১৫৬৫ সালে।

ইংরেজ আঁকিয়ে উইলিয়াম হোগার্থ (William Hogarth) কলম্বাস ব্রেকিং দ্য এগ’ শীর্ষক একটি ছবিও এঁকেছিলেন। আর আপনাদের কেউ যদি স্পেনের ইবিসা (Ibiza)-র সান আন্তোনিও (San Antonio) বেড়াতে যান, তবে সেখানে দেখতে পাবেন ডিম্বাকৃতির একটি মনুমেন্ট, যা নির্মিত হয়েছে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের স্মৃতি রক্ষার্থে।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস কাঁচা ডিম দাঁড় করিয়েছিলেন ডিমের এক প্রান্ত থ্যাতলে দিয়ে, তাও মাত্র কয়েক শ বছর আগে (তিনি জন্ম নিয়েছিলেন ১৪৫১ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১৫০৬ সালের ২০ মে)। অথচ চীনে অক্ষত রেখেই ডিম দাঁড় করানোর খেলা চলে আসছে বিগত ৪ হাজার বছর ধরে।

এমনকি, চীনের অনেক শিশুও কাজটি করতে পারে! আসলে, প্রাচীন আমল থেকেই চীনারা বসন্তের আগমন উপলক্ষে একবার এবং শরতের আগমন উপলক্ষে আরেকবার—বছরে দু’বার আনুষ্ঠানিকভাবে কাঁচা ডিম দাঁড় করানোর খেলা খেলে আসছে। চীনারা বিশ্বাস করে, কেউ যদি কাঁচা ডিম কোনো মসৃণ তলে দাঁড় করাতে পারে, তবে ভবিষ্যতে সৌভাগ্য তার সাথী হবে।

কেউ কেউ মনে করেন, ডিম দাঁড় করানোর জন্য সবচেয়ে উত্তম সময় হচ্ছে ‘ছুনফেন’ (চীনা চান্দ্রপঞ্জিকার চতুর্থ সৌরপদ) ও ‘ছিউফেন’ (চীনা চান্দ্রপঞ্জিকার ষোড়শ সৌরপদ)।

প্রথমটির বাংলা করলে দাঁড়াবে ‘বসন্ত বিষুব’, যাকে ইংরেজিতে ডাকা যেতে পারে স্প্রিং ইকুয়েনক্স (Spring Equinox) এবং দ্বিতীয়টির বাংলা ‘শারদীয় বিষুব’, যাকে ইংরেজিতে বলে অটাম ইকুয়েনক্স (Autumn Equinox)। এখানে বলে রাখি, চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদে (solar terms)। প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য।

প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ করছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাকে-আশাকে।

আগেই বলেছি, চীনা চান্দ্রপঞ্জিকার ষোড়শ সৌরপদের নাম ‘ছিউফেন’ বা ‘শারদীয় বিষুব’। চলতি বছর এর ব্যাপ্তিকাল ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত।

বিষুবরেখা একটি কাল্পনিক রেখা, যা পৃথিবীকে উত্তর ও দক্ষিণ—এই দুই গোলার্ধে ভাগ করেছে। এই রেখার (যাকে ‘নিরক্ষরেখা’ বা ‘নিরক্ষবৃত্ত’ বা ‘বিষুবীয় রেখা’-ও বলা হয়) দৈর্ঘ্য ৪০,০৭৫ কিলোমিটার। উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু থেকে সমান দূরত্বে, পৃথিবীর মাঝ বরাবর, এই কাল্পনিক রেখা বা বৃত্তের অবস্থান (তাই, বিষুবরেখাকে পৃথিবী নামক বিশাল গোলকের পরিধিও বলা যেতে পারে)।

যেহেতু পৃথিবী সূর্যের সম্মুখে সাড়ে ৬৬ ডিগ্রি কোণ করে প্রদক্ষিণ করে, সেহেতু সূর্য সবসময় বিষুবরেখার উপর অবস্থান করে না। মার্চ থেকে শুরু করে জুন পর্যন্ত সূর্য উত্তর গোলার্ধে অবস্থান করে। তখন উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল।

এরপর ধীরে ধীরে, পৃথিবীর প্রদক্ষিণের ফলে, দক্ষিণ গোলার্ধ সূর্যের সামনে আসে। জুন মাসের পর সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধের দিকে অগ্রসর হয় (আসলে সূর্য অগ্রসর হয় না, পৃথিবীই অগ্রসর হয়!) এবং বিষুবরেখা অতিক্রম করে। আর এই অতিক্রম কালেই, শারদীয় বিষুবের প্রথম দিন (যা এবার পড়েছে ২৩ সেপ্টেম্বরে) সূর্য বিষুবরেখার ঠিক উপরে অবস্থান করে।

চীনা দর্শন অনুসারে, বিশ্বে দু’ধরনের শক্তি বিরাজ করছে—ইন (Yin) ও ইয়াং (Yang)। এর মধ্যে ‘ইন’ হচ্ছে নেগেটিভ ও নিষ্ক্রিয় এবং ‘ইয়াং’ হচ্ছে পজেটিভ ও সক্রিয়। চীনের প্রাচীন গন্থ The Detailed Records of the Spring and Autumn Period (770-476 BC) অনুসারে, শারদীয় বিষুব সৌরপদে ‘ইন’ ও ‘ইয়াং’-এর মধ্যে শক্তির ভারসাম্য বিরাজ করে। তাই এসময় দিন (ইয়াং) ও রাত (ইন) সমান হয়; শীত (ইন) ও গরম (ইয়াং)-ও থাকে সমানে সমান।

গোটা বিশ্বের সমুদ্রে, নদ-নদীতে, ভূমিতে নানান ধরনের কাঁকড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে মিঠাপানিতে পাওয়া যায় প্রায় ৮৫০ ধরনের কাঁকড়া। কাঁকড়ার আকারও হয় বিভিন্ন ধরনের। মাত্র কয়েক মিলিমিটার প্রশস্তের ‘পি কাঁকড়া’ (pea crab) যেমন আছে, তেমনি আছে জাপানিজ স্পাইডার ক্র্যাবের (Japanese spider crab) মতো বিশাল কাঁকড়াও।

বিশ্বে প্রতিবছর সমুদ্র থেকে প্রায় ১৫ লাখ টন কাঁকড়া ধরা হয়। বলা বাহুল্য, এসব কাঁকড়া সামুদ্রিক খাবার হিসেবে জনপ্রিয়। চীনারাও মজা করে কাঁকড়া খায়। তবে, তাদের বিশ্বাস শারদীয় বিষুবে কাঁকড়া খেতে সবচেয়ে বেশি মজা। কাঁকড়ার মাংস মানুষের হাঁড়ের মজ্জার পুষ্টি জোগায় এবং শরীরের অতিরিক্ত তাপ কমায় বলে চীনা ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাবিদ্যায় বলা হয়েছে।

শারদীয় বিষুবের প্রথম দিনে বিশেষভাবে ‘ছিউছাই’ (Qiucai) নামক এক ধরনের বন্য ফুল খাওয়ার প্রথা রয়েছে দক্ষিণ চীনে। এই প্রথার নাম, ‘শারদীয় বিষুবে ছিউছাই খাওয়া’। শারদীয় বিষুবের প্রথম দিনে দক্ষিণ চীনের গ্রামের মানুষ দল বেধে ছিউছাই তুলতে যায়।

ছিউছাই ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। মাঠ থেকে তুলে আনা ছিউছাই মাছের সঙ্গে মিশিয়ে ‘ছিউথাং’ (Qiutang) নামক স্যুপ তৈরি করা হয়। চীনা ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাবিদ্যা অনুসারে, ছিউথাং খেলে যকৃৎ ও অন্ত্র ভালো থাকে।

সাধারণভাবে চীনারা ফুল ও ফুলের সুঘ্রাণ পছন্দ করে। তবে, শারদীয় বিষুবে, বিশেষ করে দক্ষিণ চীনে, অজম্যানথাস (osmanthus) ফুলের ঘ্রাণ নিতে পছন্দ করে তারা। মোটামুটি ৩০ ধরনের অজম্যানথাস প্রজাতি পাওয়া যায় চীনে।

দক্ষিণ চীনে এসময় দিনে মোটামুটি গরম ও রাতে মোটামুটি ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। তাই, দিনে ও রাতে চীনাদের পোশাকে আসে পরিবর্তন। চীনা ভাষায় এই সময়কালকে ‘কুইহুয়াচ্যং’ (Guihuazheng) বলেও ডাকা হয়, যার আক্ষরিক অর্থ ‘অজম্যানথাস মগ্নতা’। শারদীয় বিষুব ক্রিসেন্থেমাম বা চন্দ্রমল্লিকার সৌন্দর্য উপভোগেরও উত্তম সময়। এই সময় ফুল পরিপূর্ণভাবে ফোটে।

প্রাচীনকালে চন্দ্রদেবী তথা চাঁদের পূজা করা হতো শারদীয় বিষুবে। চৌ রাজবংশ আমলে, চীনের প্রাচীন সম্রাটেরা, বসন্ত বিষুবে সূর্যের ও শারদীয় বিষুবে চাঁদের পূজা করতেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শারদীয় বিষুবে চাঁদ পূর্ণাঙ্গ হয় না। আর পূর্ণাঙ্গ চাঁদ না-দেখা গেলে, উৎসবের আমেজটাই মাঠে মারা যায়।

এই কারণেই, পরবর্তীকালে, চন্দ্রদেবীর পূজার সময়টা নিয়ে যাওয়া হয় মধ্য-শরৎ উত্সবে। চলতি বছর চীনের মধ্য-শরৎ উত্সব ছিল ১০ সেপ্টেম্বর। সেদিন আকাশে ছিল পূর্ণাঙ্গ গোলাকার চাঁদ।

 

আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)