ভারতের শিলিগুড়িতে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় করণীয় শীর্ষক আলোচনার জন্য তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কাজের ফাঁকে বেড়ানো আমার অভ্যাস। তাই পরিবার নিয়ে গেলাম ভারতের শিলিগুড়ি, গ্যাংটক, পেলিং শহরে।

গ্যাংটক এবং পেলিং শহরে গিয়ে পানি খাওয়ার জন্য কোনো বোতল পেলাম না। সবাই দেখছি গ্লাসে পানি খাচ্ছে। পানির কোনো প্লাস্টিকের বোতল সেখানে বিক্রি হয় না। বিভিন্ন দোকান ঘুরে অনেক কষ্টে ৫ লিটারের একটি বোতল পেলাম। সেটি হোটেলে নিয়ে এসে বাচ্চাদের খাবারের জন্য দিলাম।

ওই এলাকায় সবাই তাদের সাপ্লাইয়ের পানি নির্দ্বিধায় পান করছেন কিন্তু আমার সাহস হলো না কারণ বাংলাদেশে সাপ্লাইয়ের পানি পানে আমরা আশ্বস্ত নই। যখন দোকানে শপিং করতে গেলাম তখন তারা আমাকে পণ্য সরবরাহ করলেন নিউজ পেপার দিয়ে পেঁচিয়ে।

আরও পড়ুন : জলবায়ু পরিবর্তন বনাম ক্রিকেট : বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতখানি? 

তাদের কাছে ব্যাগ চাইলাম তারা বলল, সিকিম সরকার পরিবেশ দূষণ রক্ষায় সব ধরনের প্লাস্টিক পণ্য বর্জন করেছে। এগুলো এখন ব্যবহৃত হয় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম তাহলে আমি পণ্যটি কি করে নিয়ে যাব? তারা বললেন আপনি কাপড়ের ব্যাগ কিনতে পাবেন সেটা কিনে তার মধ্যে করে আপনার সমস্ত কেনাকাটার পণ্যগুলো নিতে পারেন।

গ্যাংটক, পেলিং দুটি শহরের চতুর্দিকে তাকালে কোনো প্লাস্টিকের বোতল বা প্লাস্টিক চোখে পড়ে না। প্রকৃতি এবং পরিবেশ রক্ষায় তাদের এই অসামান্য উদ্যোগ মনে-মনে প্রশংসা করলাম আর ভাবলাম আমরা কেন করতে পারছি না?

আপনি এই মুহূর্তে যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার ডানে-বামে তাকিয়ে দেখুন আপনি কোনো না কোনো প্লাস্টিক দেখতে পাবেন। আপনি যদি বাইরে থাকেন তাহলে একটি দুটি নয় অসংখ্য প্লাস্টিক আপনি দেখতে পাবেন। আপনার মনে হবে প্লাস্টিকের সঙ্গেই আমাদের বসবাস। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্ষতি এবং আশঙ্কার কারণ এই প্লাস্টিক।

১০০ বছর ধরে জমতে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্যের বিশাল বোঝা নিয়ে এই পৃথিবী এখন বিপাকে। জীবনযাত্রা সহজ করা প্লাস্টিক পণ্য এখন আমাদের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে।

১৮৫৫ আবিষ্কারের পর প্লাস্টিক সবার নজর কাড়ে। কম খরচ, সহজ উৎপাদন যোগ্যতা, বহুমুখীতা, পানির সাথে সংবেদনহীনতা সর্বোপরি দামে সুলভ ইত্যাদি কারণে প্লাস্টিক কাগজের ক্লিপ থেকে মহাকাশযানের বিভিন্ন ধরনের বহুমুখী পণ্যে ব্যবহার হয়ে আসছে।

বিশেষ করে খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এছাড়াও চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাতে বহু মানুষের জীবন রক্ষায় কাজে লেগেছে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেছে প্লাস্টিকের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্ক।

১০০ বছর ধরে জমতে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্যের বিশাল বোঝা নিয়ে এই পৃথিবী এখন বিপাকে। জীবনযাত্রা সহজ করা প্লাস্টিক পণ্য এখন আমাদের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে।

আরও পড়ুন : জলবায়ু পরিবর্তন : ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা কি সক্ষম?

আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বেশিরভাগই একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। নর্দমা, পুকুর, ড্রেন, নদী হয়ে ফেলে দেওয়া এসব প্লাস্টিকের সর্বশেষ গন্তব্য হয় সমুদ্র। এর ফলে পানি দূষণ ও জলাবদ্ধতার পাশাপাশি সামুদ্রিক প্রাণী ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। নিঃসন্দেহে এটি জলজ প্রাণী, খাদ্য শৃঙ্খল ও সর্বোপরি মানবজাতির জন্য এক অশনিসংকেত।

প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার বা উৎপত্তি স্থান থেকে বিভিন্ন উপায়ে ভিন্ন ভিন্ন আকারে বিভিন্ন পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। নদী বা সমুদ্রের স্রোত বাতাসের গতি ভৌগোলিক বৈচিত্র্য তার কারণে প্লাস্টিক বর্জ্য বিভিন্ন উপায়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

ঢাকাসহ বাংলাদেশের প্রতিটি নদী এবং সমুদ্র তলদেশে এখন প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ পরিপূর্ণ। প্লাস্টিকের এই মাইক্রো কণা সমূহ নিয়মিত মানুষসহ অন্য প্রাণীর খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ছে, যা খুবই বিপদজনক ৷ বিভিন্ন উপায়ে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে।

ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ভূপৃষ্ঠীয় ও ভূগর্ভস্থ পানির সাথে মিশে যায়। এরপর এটি পানি চক্রের সঙ্গে আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে। আর এভাবেই পানি গ্রহণের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

আরও পড়ুন : পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের ভূমিকা কী?

মাটিতে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব বাস করে, যারা প্লাস্টিক অণুর ভাঙনে সাহায্য করে। এইসব অণুজীব ‘নাইলোনেজ’ এনজাইম ক্ষরণের মাধ্যমে নাইলন অণুকে ভেঙে ফেলে। আর এই প্লাস্টিক ভাঙনের মাধ্যমে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। মিথেন গ্যাস একটি গ্রিন হাউস গ্যাস যা পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী।

মাইক্রো এবং ম্যাক্রো প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থের সঙ্গে অতিবেগুনি রশ্মি এবং পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের মিথস্ক্রিয়া করে প্লাস্টিকের কণা এবং তার নানা রকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যেমন বিসফেনল পরিবেশ নির্গত হয়।

রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় এক হাজার দুই শত কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়।

এসব মাইক্রো মাইক্রো এবং ন্যানো কণা এবং বিস্তৃত রাসায়নিক পদার্থ মানুষ ও অন্যান্য জীবের হরমোন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিক জীবের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে এবং স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত করে নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও ন্যানো প্লাস্টিক উদ্ভিদ ও প্রাণী কোষের ভেতরে অবস্থিত ডিএনএ ও আরএনএ অণুর মধ্যে মিউটেশন ঘটিয়ে ক্যান্সার তৈরি করতে পারে।

শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয় গোটা বিশ্বেই প্লাস্টিকের বর্ধিষ্ণু ব্যবহার ভয়াবহ স্তরে পৌঁছে গেছে। পরিবেশে প্লাস্টিকের এই আগ্রাসন থামানোর চেষ্টা অবশ্য শুরু হয়েছে। বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশ প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে এগিয়ে এসেছে। জাতিসংঘ এই বিষয়ে সব রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে বলেছে।

আরও পড়ুন : উন্নয়ন গ্রাস করছে প্রকৃতি 

বাংলাদেশে ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও আইনের কোনো বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় এক হাজার দুই শত কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়।

প্লাস্টিক এবং গৃহস্থালির বর্জ্য পদার্থের মাধ্যমে নদী দূষণের কারণে মৃত প্রায় ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন নদ-নদীগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে জীবনযাপন করছে নগরবাসী।

ঢাকা ও এর আশপাশের নদী রক্ষায় সোচ্চার হয়েছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর চৌধুরী। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এবং ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

নদী রক্ষায় তার সাহসী ঘোষণা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে তিনি নদী রক্ষায় সাহসী পদক্ষেপ কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে আমরা তার উপরে আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতে চাই।

আরও পড়ুন : বিশ্ব পরিবেশ দিবস : আমাদের ব্যর্থতা ও করণীয় 

বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ, নদী, সমুদ্র এবং বাস্তুসংস্থান সর্বোপরি মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ অত্যাবশ্যক। পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।

পলিথিন ব্যাগ ও টিস্যু ব্যাগের উৎপাদন এবং ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাসহ নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহারকারীদের আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা উচিত।

পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পচনশীল দ্রব্য দিয়ে তৈরি, বিশেষ করে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙা ইত্যাদি সহজলভ্য করা এবং এগুলো ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার।

প্লাস্টিক পণ্য বর্জন, হ্রাস, পুনঃব্যবহারের ক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। শুধুমাত্র সরকারি পর্যায়ে নয় প্লাস্টিক বর্জন, হ্রাস, পুনঃব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার লক্ষ্যে ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনে নাগরিকদের সচেষ্ট হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়