মেয়েতো কালো। কিন্তু, ভারী মিষ্টি। ছোটবেলায় বাসায় বেড়াতে আসা মেহমানদের সামনে পরিচয় পর্বটা ছিল এমন। একবার দুইবার না, প্রায় প্রতিবার এমনই। আমার বড় বোন ছিল তুমুল সুন্দরী, ছোটবেলা থেকেই। কালো, তবে মিষ্টি। এই কথা বলেই সবার দৃষ্টি আমার ওপর থেকে ঘুরে যেত আমার বড় বোনের দিকে। সে কি করে... কি খেতে পছন্দ সবার মনোযোগ, সব ব্যস্ততা তাকে ঘিরে। আমি তখন থেকে বুঝতে পারি মিষ্টি মেয়ে আসলে এক ধরনের সান্ত্বনা, আমি কালো এটাই পরিচয়... এটাই বড় সত্য।

আমাদের সংস্কৃতি বা রুচিবোধ বা বিবেক এমন আধুনিক জায়গায় নেই যে, কালোকে আমরা সুন্দর বলতে পারি। এমনকি একটি শিশুর সামনে তার গায়ের রং নিয়ে যে কথা বলা যায় না, সেই বোধটুকুও আমাদের মাঝে নেই। যুগের পর যুগ তথাকথিত শিক্ষিত আর আধুনিক কিছু মানুষই এই দেশে গায়ের রং নিয়ে বিভাজন করেছেন।

রং ফর্সাকারী ক্রিম ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ বাজারে আসার পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়ে আসছে। ত্বকের রং উজ্জ্বল করতে প্রতি বছর লাখ লাখ তরুণ-তরুণী এ ক্রিম কিনছে। এই দেশেও সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি। বেশি বিক্রি হয় শুনে আপনি হয়তো ভাবলেন, এ আর নতুন কি, এইটা তো জানা তথ্য। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই বিক্রির পরিমাণটা কত? প্রতিবছর ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি বিক্রি হয় আগের বছরের চেয়ে ১৮ ভাগ বেশি। তার মানে আপনি চিন্তা করেন যারা বলে, দিন বদলেছে এখন আর কালো-সাদা ভেদাভেদ করে না কেউ। তা অসত্য।

এখন আরও বেশি সাদা রঙে মনোযোগী মানুষ। কেবল ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি তো নয়, এই দেশে রং ফর্সা করার সকল ক্রিম ব্যাপক জনপ্রিয়। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রং ফর্সা করা ক্রিম বিক্রি হয় এই দেশে। বলিউড, টালিউড, ঢালিউডের সেরা তারকারা এসব ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের মডেল হয়ে আসছেন। সব বিজ্ঞাপনেই চিৎকার করে সবার সামনে বলছেন, ‘ফর্সা হও’, ‘ফর্সা হও’। কারণ তারা জানেন এই ফর্সা হওয়াতেই সায় সবার।

বলিউড, টালিউড, ঢালিউডের সেরা তারকারা এসব ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের মডেল হয়ে আসছেন। সব বিজ্ঞাপনেই চিৎকার করে সবার সামনে বলছেন, ‘ফর্সা হও’, ‘ফর্সা হও’।

মেয়েরা সারা দিনরাত তার মেধা কোথায় তা চিন্তা না করে কেমন করে ফর্সা আর সুন্দর হওয়া যায় সেই বিষয়ে বেশি মনোযোগী। কারণ কি জানেন? কারণ সে জীবনের প্রতিটা ধাপে বোধ করেছে ফর্সা হলে জীবন, সহজ আর সফল। সে ক্লাসে যখন প্রথম যায় সে দেখতে পায় ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটির প্রতি আগ্রহ সবার। তার পড়াশোনা, তার যত্ন অন্য সবার চেয়ে বেশি। কেউ টেরও পায় না ছোটবেলাতেই তার মনটা খারাপ হতে থাকে। কালো মেয়ের সেই কষ্ট দেখার সময় কার?

এরপরও জীবনে প্রথম ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে কোনো ছেলের দিকে তাকিয়েও সে দেখে ভালোবাসার মানুষটার সেই দৃষ্টিতে অন্য একটা সুন্দর মেয়ের হাহাকার, যে দারুণ ফর্সা। পড়ালেখা শেষে যত মেধাবী ফলাফলই হোক না কেন ইন্টারভিউ বোর্ডে এগিয়ে থাকে ফর্সা সুন্দর মেয়েটাই। তারপরও মেধার গুণে যদি সে চাকরিটা পায়ও, প্রতিটি ধাপ পেরোতে তার যে কষ্ট, তা কেবল একজন কালো মেয়ে জানে।

তারপরও বেঁচেবর্তে টিকে থাকা আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে যখন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে সেই যুদ্ধটা হয় সবচেয়ে ভয়াবহ। ‘মেয়ের গায়ের রং তো কালো’ এই কথা বলে কতজনের কাছে যে বাতিল হতে হয়, এই ভয়াবহ কষ্টের খবর জানে কেবল সেই পরিবার আর জানে মেয়েটি।

এই যে ধাপে ধাপে অবস্থার মধ্য দিয়ে মেয়েটি যায়, কেন বলেন তো? কেবল আমাদের মানসিকতা। বিজ্ঞজনেরা বলেন, ‘গায়ের রং নিয়ে কথা বা প্রশ্ন তোলা যায় না।’ এই শিক্ষাটাই আমাদের নেই। কিন্তু জানেন, আমি অনেক শিক্ষিত নারীবাদী আধুনিক পুরুষ দেখেছি, যারা মনে করেন ফর্সা মানেই দারুণ কিছু। তাদের অফিস, টেলিভিশন স্ক্রীন সব ফর্সা, যারা তাদের দখলে। আমি যখন টেলিভিশন প্রেজেন্টেশন শুরু করি। আমাকে বাদ দেয়া হয়েছিল। কারণ আমি সুন্দর নই।

‘মেয়ের গায়ের রং তো কালো’ এই কথা বলে কতজনের কাছে যে বাতিল হতে হয়, এই ভয়াবহ কষ্টের খবর জানে কেবল সেই পরিবার আর জানে মেয়েটি।

সুন্দর মানে কী? আমি জেনেছিলাম সেটা ফর্সা। এই যে আমার আশেপাশে এতো শিক্ষিত মানুষের ছড়াছড়ি তারা এখনও ভাবেন একটা ফর্সা সুন্দর মেয়েই কেবল পারে স্ক্রিন দর্শক করে রাখতে। আমার সবচেয়ে প্রিয়, ছেলের বন্ধুটিকেও দেখি ফর্সা মেয়ের জন্য তার এক ধরনের প্রবল আকর্ষণ। আপনি বলতে পারবেন, এমন কোনো সিনেমার নায়িকা আছে আমাদের, যে কালো? আমরা সবাই নিজের জান্তে-অজান্তে এই দেশে প্রতিষ্ঠা করেছি ফর্সা মানেই সুন্দর।

আমরা অনেক সময় নিজের অজান্তেই বর্ণবাদ উস্কে দেই। যা আমাদের দায়িত্ব নয়। অনেক সময় এইসব বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু আমি জানি, এদের কাউকে রং ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন করতে বললে তারা হুমড়ি খেয়ে পড়বেন। নিজের ছেলের জন্য খুঁজবেন ফর্সা সাদা মেয়েটিই। এই দেশে এই কারণে প্রতিভাবানদের জায়গা হয় না, এই দেশে এই জন্য অপেরা উইনফ্রের জন্ম হয় না। কারণ এই দেশে সবার অন্যকে বিচারের মেধা মাথায় না, থাকে চোখে। আর কালো, ঠিক আরাম দেয় না চোখ।


নাজনীন মুন্নী ।। সাংবাদিক