ছবি : সংগৃহীত

৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই আলোচিত, বিতর্কিত, গুরুত্বপূর্ণ এবং জট লাগানো দিন। দিনটি একেকজন একেকভাবে পালন করে। আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই কার বিপ্লব, কে পালন করে; কার হাসি, কে হাসে?

এখন বিএনপি সবচেয়ে ঘটা করে দিনটি পালন করে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তো বিএনপির জন্মই হয়নি। বিএনপির জন্ম ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। আর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তখন ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দি। এমনকি জিয়াউর রহমান তখন কাগজে কলমে কেউই ছিলেন না।

৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২৪ আগস্ট মোশতাক জিয়াকে সেনাপ্রধান বানালেও ৩ নভেম্বর ক্যু করে সেনাপ্রধান হন জেনারেল খালেদ মোশাররফ। নিজ বাসায় বন্দি হন জিয়া। এমনকি জান বাঁচাতে জিয়া তখন পদত্যাগ করে পূর্ণ পেনশন দেওয়ার আবেদন পর্যন্ত করেছিলেন।

আরও পড়ুন : রাজনৈতিক পাপের উৎস সন্ধানে 

খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন। বাসার ল্যান্ডফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও তার বেডরুমের ফোন লাইনটি সচল ছিল। সেই ফোনেই তিনি কর্নেল তাহেরকে বলেছিলেন, ‘সেভ মাই লাইফ’। ডাক পেয়ে তাহের তার ‘সৈনিক সংস্থা’ নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন।

আসলে তাহের অনেকদিন ধরেই ঘোট পাকাচ্ছিলেন, অপেক্ষায় ছিলেন সময়ের। তাহের যে জিয়াকে ভালোবেসে তার জীবন বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তা নয়। বিপ্লবের গোপন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সুযোগ ভেবেই মাঠে নেমেছিলেন তিনি। জাসদের মধ্যেই তখন অনেক বিভ্রান্তি।

বিএনপি সবচেয়ে ঘটা করে দিনটি পালন করে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তো বিএনপির জন্মই হয়নি। বিএনপির জন্ম ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর...

কর্নেল তাহেরের বিপ্লবের কথা জানতেনই না জাসদের অনেকে। ৭ নভেম্বর বিপ্লব হোক, প্রতিবিপ্লব হোক, ব্যর্থ বিপ্লব হোক, হঠকারিতা হোক—করেছে জাসদ।

৭ নভেম্বর তো বিএনপির সাফল্যের দিন নয়, জাসদের ব্যর্থতার দিন, সেটাই ঘটা করে পালন করে বিএনপি। পদচ্যুত, গৃহবন্দি সেনাপ্রধান ক্যুও করতে পারেন না, বিপ্লব তো নয়ই।

যে সৈনিক জিয়াকে নিয়ে উল্লাস করেছে তারা তো ছিল কর্নেল তাহেরের অনুগত। রাস্তায় যে জনগণ সৈনিকদের সঙ্গে মিলে ট্যাংকের ওপর উঠে উল্লাস করেছে, তারা তো জাসদের কর্মী।

আরও পড়ুন : ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস 

মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, যদি সেদিন জাসদের বিপ্লব সফল হতো; যদি জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের সাথে বেইমানি না করতেন, যদি জিয়া তাহেরের স্ক্রিপ্ট ফলো করে শহীদ মিনারে গিয়ে বিপ্লবের ঘোষণা দিতেন; তাহলে আজ বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্রটা কেমন হতো?

আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকতো জাসদ, যেমনটা ছিল ৭৫’র আগে, বিএনপির হয়তো জন্মই হতো না। সত্যি রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

জাসদের বিপ্লব সফল হলে ভালো হতো, আমি এমনটা মনে করি না। জাসদের বিপ্লব সফল হলে কী হতো আসলে তা বলা মুশকিল। যারা বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন, তারাও এর পরিণতি সম্পর্কে আদৌ জানতেন কি না, আমার সন্দেহ।

জাসদ আগে কী অপকর্ম করেছে, পরে কী করতে পারতো, তা আলাদা তর্ক। তবে অফিসারদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিপ্লব ভালো কিছু বয়ে না আনারই কথা। আর সিরাজুল আলম খান যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আফিম খাইয়ে ধ্বংস করেছেন একটা মেধাবী প্রজন্মকে, ৭ নভেম্বর কি তার চূড়ান্ত পরিণতি? জাসদের লোকজন কি তা বিশ্বাস করেন?

আরও পড়ুন : জেলহত্যা দিবস : ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় 

সিরাজুল আলম খানের কি সায় ছিল ৭ নভেম্বরের তথাকথিত বিপ্লবে? মাত্র তিনবছর বয়সী একটা রাজনৈতিক দল কিছু ‘খ্যাপাটে সৈনিক’-এর ওপর ভর করে মধ্যরাতে গুলি ফুটিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করে ফেলবে? বিপ্লব কি এতই সহজ? ৭ নভেম্বর কি জাসদের বিপ্লব, নাকি স্বপ্নবাজ কর্নেল তাহেরের ইউটোপিয়ান বিপ্লব বিলাস? প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর পাওয়া দায়।

৩ নভেম্বর ১৫ আগস্টের খুনি চক্রের বিরুদ্ধে ক্যু করেছিলেন খালেদ মোশাররফ। কিন্তু তিনি আর্মি ক্যু করতে চেয়েছিলেন সিভিলিয়ান স্টাইলে। রক্তপাতের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। ক্ষমতা নয়, চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে। আলাপ-আলোচনা-সমঝোতার সুযোগে কালক্ষেপণ হয়।

যে সৈনিক জিয়াকে নিয়ে উল্লাস করেছে তারা তো ছিল কর্নেল তাহেরের অনুগত। রাস্তায় যে জনগণ সৈনিকদের সঙ্গে মিলে ট্যাংকের ওপর উঠে উল্লাস করেছে, তারা তো জাসদের কর্মী।

বিভ্রান্তি ছড়ায়, গুজব ছড়ায়, ক্যুর শুরুতেই পলায়নপর খুনি চক্র কারাগারে হত্যা করে জাতীয় চারনেতাকে। এই ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে নামে জাসদ, আরও স্পষ্ট করে বললে কর্নেল তাহের। তিনি জিয়াউর রহমানের মাথায় লবণ রেখে বরই খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের সৈনিকদের উসকানি দিতে যতটা পটু ছিলেন, জনসমাগম করতে ততটা নয়। জনগণ জাসদের পক্ষে ছিল না বলেই তাহেরের চেয়ে বেশি চালাক জিয়া বরইটি নিয়ে নিজেই খেয়ে ফেলেন।

৭ নভেম্বর একটা জিনিস প্রমাণিত হয়েছে। আপনি যাই করেন, আপনার পাশে জনগণ থাকতে হবে। জনগণের সমর্থন না থাকলে বিপ্লব বলেন আর আন্দোলন; তা টেকসই হবে না।

জাসদ যদি সেদিন শহীদ মিনারে ১০ লাখ লোকের সমাবেশ করতে পারতো, তাহলেই পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারতো। জিয়া যখন বুঝলেন, কর্নেল তাহেরের পেছনে জনগণ নেই, তখনই তিনি সুযোগটি নিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন : জিয়া বীর উত্তম পদবির যোগ্য নয় 

কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে জিয়া ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন অবশ্যই। কারণ তাহের জিয়াকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের বিপ্লবী ‘সৈনিক সংস্থা’ করে ক্যান্টনমেন্টে গোপন রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তার বিপ্লবের মূল স্লোগান ছিল ‘সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’। এই ধরনের হঠকারী তৎপরতা সবসময়ই অপরাধ।

৭ নভেম্বর কিন্তু জাসদের প্রথম হঠকারিতা নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও, এমপি হত্যা, থানা লুট, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ চেষ্টার চূড়ান্ত পরিণতি ৭ নভেম্বর। আর এই ৭ নভেম্বরেই জাসদের কফিনে শেষ পেরেকটুকু ঠুকেছিলেন কর্নেল তাহের।

আরও পড়ুন : রাজনৈতিক দলের রাজনীতি 

৭ নভেম্বর নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু সবচেয়ে কম আলোচনা হয় সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়টি নিয়েই। ৭ নভেম্বর আমরা হারিয়েছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তিন শ্রেষ্ঠ বীরকে। খালেদ মোশাররফ তো ছিলেন বীরদের বীর। কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা আর কর্নেল আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দারের বীরত্বও মুক্তিযুদ্ধের রূপকথার অংশ।

খুনি চক্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে প্রাণ দেওয়া খালেদ মোশাররফ আজ যেন ভুলে যাওয়া নাম। শেখ হাসিনা ইতিহাসের অনেক দায় মিটিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, জেলহত্যা মামলার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। এখন সময় খালেদ-হুদা-হায়দার হত্যার বিচার করার। ইতিহাসের দায় মেটাতে হবে সবাইকেই।

প্রভাষ আমিন।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ