আমাদের সমসাময়িক অর্থনীতি এবং রাজনীতি উভয় বিষয়েই সবচেয়ে আলোচিত ও শঙ্কার শব্দটি হচ্ছে, অর্থনৈতিক 'মন্দা'। অর্থনীতিবিদ্যা অনুযায়ী মন্দাকলীন সময়ে জাতীয় গড় আয়, চাকরি, বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয়, উৎপাদন, পারিবারিক আয়, ব্যবসায়িক লাভ—সবকিছুই অনেক কমে যায়।

আবার অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও দেউলিয়ার হার বাড়ে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই সময়ে বিশেষ করে সাধারণ জনগণের চরম আর্থিক দুর্দশায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ বিশ্বব্যাংক বলেছে, ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো একযোগে সুদের হার বাড়ানোয় বিশ্ব একটি বৈশ্বিক মন্দার দিকে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন : বৈশ্বিক মন্দা ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি 

বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম অর্থনীতি—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরো অঞ্চল—তীব্রভাবে মন্থর হয়ে পড়েছে এবং এমনকি ‘পরবর্তী বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা মাঝারি আঘাত একে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে।’

বৈশ্বিক মন্দার কারণ খুঁজতে সাম্প্রতিক চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক (CGTN) এবং চাইনিজ ইন্সটিটিউট অব পাবলিক ওপিনিয়ন যৌথভাবে বিশ্বব্যাপী ১০০ জন অর্থনীতিবিদদের একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত সঞ্চয় কখনো অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। সঞ্চয় তখনই কাজে আছে যখন এটা অর্থনীতির বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১০০ জন অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ৯০ শতাংশ বিশ্বাস করেন যে, ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ অর্থাৎ ফেডের ক্রমাগত সুদের হার বৃদ্ধি স্ট্যাগফ্লেশনের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। উপরন্তু, ৯৪ শতাংশ একমত যে উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো ফেডের পদক্ষেপের কারণে ঋণ সংকট বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছে।

ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ ২০২২ সালে ছয়বার সুদের হার বাড়িয়েছে। বৈশ্বিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির জন্য করোনা মহামারির দীর্ঘসূত্রিতা ও ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রধানত দায়ী করা হলেও অনেক অর্থনীতিবিদ যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুত পরিবর্তনশীল সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী করেন।

উন্নত দেশেগুলো যদি সম্ভাব্য আর্থিক মন্দায় কবলিত হয় তবে তার ঢেউ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে আঘাত হানবে এবং এটাই স্বাভাবিক। বৈশ্বিক মন্দায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুই খাত প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে।

আরও পড়ুন : বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং বাংলাদেশ

বাণিজ্য ঘাটতি আরও প্রকট দেখা দিবে। অধিকন্তু, ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাস, মূল্যস্ফীতির আস্ফালন, উচ্চ বেকারত্বের হার, ইত্যাদির যৌথ প্রভাবে এমনিতেই আমাদের অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তাই, বিশাল জনবহুল এই দেশে মন্দা মোকাবিলা আমাদের জন্য সত্যি একটি কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে।

সম্ভাব্য আর্থিক মন্দা মোকাবিলার গুরুত্ব সর্বোচ্চ বিবেচনায় রেখে ১১ অক্টোবর ২০২২ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভার ভার্চুয়াল প্রারম্ভিক বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশবাসীকে আরও খাদ্য উৎপাদনের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বিশ্ব সম্প্রদায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আগামী বছর একটি গুরুতর দুর্ভিক্ষ হতে পারে যখন অর্থনৈতিক মন্দা আরও গভীর হবে এবং খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে। সুতরাং, আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং খাদ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।

পাশাপাশি জনগণকে কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কোনো অপ্রয়োজনীয় খরচ বাড়াব না, বরং আমরা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পানি, গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহারে আরও সাশ্রয়ী এবং সচেতন হবো।

তিনি দেশের প্রতিটি পরিবারকে তাদের সাধ্যমতো সঞ্চয় করার অনুরোধ জানান। এটি সরকারের জন্যও প্রযোজ্য। সরকার কোনো কিছুই অপ্রয়োজনে ব্যবহার করতে যাবে না।

আরও পড়ুন : প্রান্তিক আয়ের মানুষের আর্তনাদ কেউ কি শুনছে?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য জনগণকে সঞ্চয়ে সচেতন করে তুলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেকে ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপায়ে ব্যয় সংকোচন করে অর্থ সঞ্চয় করা শুরু করেছেন। কেননা, বর্তমান সঞ্চয় ভবিষ্যতের যেকোনো মন্দা বা সংকট মোকাবিলায় শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ভবিষ্যতে সম্ভাব্য তীব্র অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা মাথায় রেখে মানুষ যেভাবে পারছে হাতে অর্থ রাখতে চাইছে।

সঞ্চয় অবশ্যই ভালো, যদি সঞ্চিত অর্থ উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করা হয়। সঞ্চয় ব্যাংক কিংবা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হলে সেটা অর্থনীতির উৎপাদন বৃদ্ধি করে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের আয় বাড়ায় ও প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।

তবে, অর্থনৈতিক মন্দার সময় চিত্রটা ভিন্নতর হতে পারে। অর্থনৈতিক মন্দায়, সাধারণ জনগণ বিশ্বাস করে যে ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র, পুঁজিবাজার কিংবা অন্যান্য জায়গায় বিনিয়োগ করলে প্রয়োজনের সময় অর্থ ফেরত পাওয়া কঠিন হতে পারে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যদি আমরা অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়ি তাহলে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন কিংবা সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায় বিধি নিষেধ আরোপ হতে পারে। জামাকৃত অর্থ প্রয়োজনের সময় উত্তোলনে অহেতুক জটিলতা এড়াতে তারা সঞ্চিত অর্থ নিজেদের কাছে রেখে দেওয়াই অধিক নিরাপদ মনে করেন।

আরও পড়ুন : স্ট্যাগফ্লেশন : বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে? 

নিজের কাছে সঞ্চয় গচ্ছিত রাখা একদিকে যেমন নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে, ঠিক অন্যদিকে এই সঞ্চয় অর্থনীতির কোনো কাজে আসে না। তাই অর্থনীতিবিদরা বলেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সঞ্চয় কখনো অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। সঞ্চয় তখনই কাজে আছে যখন এটা অর্থনীতির বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

তাছাড়া, সঞ্চয়ের সবচেয়ে বড় বাঁধা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। করোনাসৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ, রেকর্ড মূল্যস্ফীতিসহ নানা অর্থনৈতিক সংকটে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে কিংবা ধার-কর্জ করে সংসার চালাচ্ছেন। যাদের কিছুই পাওয়ার সাধ্য নেই তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়।

সমাজের একটা শ্রেণির কাছে অর্থের প্রাচুর্য থাকলেও বেশিরভাগ মানুষের কোনো সঞ্চয় নেই। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলোয় আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে। একই সঙ্গে সরকারের সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে।

তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষ বা মন্দার কথা বিবেচনা করে অনেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী ভিন্ন রকমের ভোগ্য পণ্যসামগ্রী কিনে মজুদ শুরু করে দিয়েছেন। এতে করে বিত্তবানেরা হয়তো প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগ্য পণ্য সামগ্রী মজুদ করতে পাচ্ছেন। কিন্তু অতি সাধারণ মানুষ যারা অল্প টাকা দিয়ে জীবন ব্যয় পরিচালনা করেন কিংবা দিন এনে দিন খান তাদের এই সুযোগ কোথায়! অযথাই নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যসামগ্রী মজুদ করার কারণে ভবিষ্যতে ভোগ্য পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হবে।

আরও পড়ুন : আইএমএফের ঋণ : জ্বলছে কি জ্বালানি বাজার? 

তাছাড়া, ভিন্ন ধরনের বাজারে সক্রিয় সিন্ডিকেট সদস্যরা এর সুযোগ নিতে পারেন। ফলে, বাজার থেকে অনেক দ্রব্যসামগ্রী হয়তো উধাও হয়ে যেতে পারে কিংবা পাওয়া গেলেও তার দাম থাকবে আকাশচুম্বী। আর এই কারণে সাধারণ জনগণ তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় পরিচালনায় ভবিষ্যতে আরও কঠিন বাঁধার সম্মুখীন হবেন।

আমার অর্থ আছে এই বলে আমি অতিরিক্ত জিনিসপত্র কিনে রেখে অন্যদের মহা বিপদে ফেলতে পারি না! এটা অমানবিক, অনৈতিক এবং যেকোনো ধর্মীয় দিক থেকেও অগ্রহণযোগ্য।

তাই, আমাদের সকলেরই উচিত কোনো ধরনের দ্রব্যসামগ্রী প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত মজুদ না করা। যদি কোনো সমস্যা আসে তখন আমরা সবাই একত্রিতভাবে তার মোকাবিলা করব। কিন্তু আমার অর্থ আছে এই বলে আমি অতিরিক্ত জিনিসপত্র কিনে রেখে অন্যদের মহা বিপদে ফেলতে পারি না! এটা অমানবিক, অনৈতিক এবং যেকোনো ধর্মীয় দিক থেকেও অগ্রহণযোগ্য। অর্থনীতিতে নোবেল স্মারক পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, খাদ্যের অভাবে কখনো দুর্ভিক্ষ হয়নি; হয়েছে সুসম বণ্টনের অভাবে।

ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক মন্দার কথা বিবেচনা করে, অনেকে আবার ভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল মজুদেরও চিন্তাভাবনা করছেন, ইউএস ডলার কিনে রাখছেন যা অর্থনীতির জন্য একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।

আরও পড়ুন : সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি! 

সরকারের তরফ থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির সঠিক তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে আমাদের দেশও শ্রীলঙ্কার মতো একটা অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হতেও পারে।

পরিশেষে, মন্দা মোকাবিলায় অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ব্যয় আর সঞ্চয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে যুক্তির প্রতিফলন ঘটাটা জরুরি। সঞ্চয় যেমন মন্দা নিরাময়কারী হিসেবে কাজ করে, ঠিক তেমনি অতিরিক্ত সঞ্চয় মন্দাকে দীর্ঘায়িত করে পারে।

যদি মানুষ ব্যয় না করে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে, জিডিপি কমে যাবে এবং একটি দুষ্টচক্র তৈরি হবে। তাই, ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সংকটের জন্য আমাদের কম সংবেদনশীল হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও শিক্ষক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়