অভিশপ্ত এক বছর। যে বছর পৃথিবীর গায়ে শোকের কালো চাদর জড়িয়ে গেছে। সৌজন্যে করোনা। এরকম একটা বছরকে কে মনে রাখতে চাইবেন! সবাই, সবাই ভুলে থাকতে চাইবেন কালো বছরটাকে। কিন্তু চাইলেই কি পারবেন? পারছেন! করোনা ভ্যাকসিন আসার পরও। পৃথিবীতে করোনার বর্ষপূর্তি হয়ে গেছে গেল ডিসেম্বরে। আর বাংলাদেশে করোনা প্রথম শনাক্ত হয় ২০২০-এর ৮ মার্চে। মাঝখানের এই সময়টা কেমন কেটেছে আমাদের? শঙ্কা-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। আর প্রতিদিন মৃত্যুর খবরে ঘুম ভেঙেছে আমাদের। নৈঃশব্দ্যের মাঝেও শুনেছি কত নক্ষত্র পতনের শব্দ! শিক্ষা-সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি-ব্যবসা-বাণিজ্য জগতের কত বড় বড় নাম হারিয়ে গেছে আমাদের মাঝ থেকে। অসুস্থ পৃথিবী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। নতুন এক স্বাভাবিক জীবনের মধ্য দিয়ে আমরাও এগিয়ে যেতে চাইছি। ‘নিউ নরমাল লাইফ’ আমাদের অনেক কিছু শেখাচ্ছে। কিন্তু আমরা কি ভুলে থাকতে পারছি গেল একটা বছরকে? কোনোদিন কি ভুলতে পারব?

জীবনযুদ্ধে অনেক সুপার অ্যাচিভার হার মেনেছেন করোনার কাছে। জীবনে সাফল্যের জয়মন্ত্র তাদের জানা ছিল। কিন্তু অদৃশ্য এক ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচার মন্ত্র পৃথিবীর কারোই জানা ছিল না। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এতটা অসহায় কি আর কখনো দেখা গেছে পৃথিবীকে? করোনা থেকে গোটা পৃথিবীর মানুষ একসঙ্গে মুক্তির পথ খুঁজেছে।

উন্নত, উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত, গরিব সব দেশের অসহায়ত্ব ফুটে বেরিয়ে পড়ে করোনাকালে। তবে ব্যর্থতার বোঝা বেশি দিন মানুষ টানতে চায়নি। মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন যেখানে লম্বা হয়েছে, সেটা দেখতে দেখতে আবার চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা খুঁজেছে করোনা থেকে মুক্তির উপায়। খুঁজে পেয়েছে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার ভ্যাকসিনের ফরমুলা।

বিশ্বের প্রথম পনেরোটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও জায়গা করে নিয়েছে, যারা তাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় দুই ভাগ মানুষকে করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দিতে পেরেছে।

এখন নানা দেশে তৈরি হচ্ছে কোটি কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন। উন্নয়নশীল দেশের সিঁড়িতে পা রাখা বাংলাদেশ অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে হলেও অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছিল ভ্যাকসিনের জন্য। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ।

বিশ্বের প্রথম পনেরোটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও জায়গা করে নিয়েছে, যারা তাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় দুই ভাগ মানুষকে করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দিতে পেরেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের রুগ্ন চেহারা বেরিয়ে পড়ে করোনাকালে এই খাতের দুর্নীতির কারণে। তবে টিকা ব্যবস্থাপনায় অন্তত খানিকটা স্বস্তি আর আস্থা ফিরছে এদেশের জনমানসে। একদিকে, বাংলাদেশ উদযাপন করতে যাচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। চলছে মুজিব শতবর্ষ। এর মধ্যে চরম অস্বস্তি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল করোনা। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই অস্বস্তি কাটছে।

বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দাঁড়িয়ে বলতে পারছে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা পিছিয়ে নেই। আসলে লড়াইয়ে জেতে তারা, যাদের ভেতরের বিষয়টা পরিষ্কার। বিশ্বাসটা মজবুত। করোনার বিরুদ্ধে জিততে হলে ঝুঁকি নিতে হবে, বাংলাদেশ সরকার সেটা বুঝতে পেরেছিল। তাই ভ্যাকসিনের জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখা হয়েছিল।

করোনা বড় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বুঝিয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীতে আসলে আমরা কেউ ভালো নেই। অর্থ-কড়ি-ক্ষমতা-বিত্ত-বৈভব দিয়ে ভালো থাকার অভিনয় করি মাত্র! অভিনয় করতে করতে কখনো কখনো ভালো-মন্দের পার্থক্যটা বুঝতে পারি না। করোনা আসলে সবাইকে এক সমান্তরালে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে, যেখানে কেউ ভালো নেই। করোনা এদেশের মানুষের জীবন-দর্শন কতটা পাল্টে দিতে পেরেছে বা পারল জানি না। লড়াই করে জিতে আসা অনেক বড় বড় তারকার মুখে একটা কথা প্রায়ই শুনেছি, ‘যে দুঃখ তুমি পেয়েছ, কষ্ট পেয়েছ লড়াই জিতে, সেটা বাকি পৃথিবীর মানুষকে বলতে যেও না।’ ব্যাখ্যাটাও সহজ। লোকে অন্যের দুঃখ দেখে আনন্দ পায়! কিন্তু করোনাকালে সত্যিই কি আমরা অন্যের দুঃখ-কষ্ট-ব্যথা-বেদনা দেখে অদৃশ্য কোনো আনন্দ পেয়েছি? খুব জোর দিয়ে বিশ্বাস করতে চাই; না তেমন কিছু হয়নি পৃথিবীতে।

বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দাঁড়িয়ে বলতে পারছে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা পিছিয়ে নেই। আসলে লড়াইয়ে জেতে তারা, যাদের ভেতরের বিষয়টা পরিষ্কার। বিশ্বাসটা মজবুত।

করোনাকালে অন্যের দুর্দশা দেখে কে কী বলবেন! সবাই তো দুর্দশাগ্রস্ত। করোনায় ক্লান্ত পৃথিবী। তবে হ্যাঁ, করোনাও একদিন ফুরিয়ে যাবে। পৃথিবীর ক্লান্তিও শেষ হবে। নতুন এক পৃথিবীর মুখোমুখি হব আমরা। সেখানেও হয়তো অনেকে বলবেন, করোনা না হলে অনেক কিছু হতো আমাদের। হয়তো হতো। কিন্তু হয়নি বলে সেই আক্ষেপ নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ারও কোনো মানে হয় না। নতুন প্রাণশক্তি নিয়েই তো আবার চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, করোনা আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। অনেক স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু এই পৃথিবীতে আমাদের ঘুম ভাঙুক স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু স্বপ্নগুলো যেন আর ভেঙে না যায়। আমাদের স্বপ্নের ওপর করোনা হুল ফুটিয়েছে। কিন্তু আমরা স্বপ্নকে ছেড়ে যাব কেন?

করোনার একটা বছর আমরা খুব বাজেভাবে পার করেছি, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই খারাপ স্মৃতিগুলো ভুলে থাকার চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে আগামীতে। তার একটা উপায় হতে পারে, ভালো স্মৃতিগুলো বারবার সামনে নিয়ে আসা। আর খারাপ স্মৃতিগুলোকে মন থেকে মুছে ফেলা। তবে হ্যাঁ, করোনা এখনো হার মানেনি পুরোপুরি। তাই আমাদের লড়াইটাও চলমান। করোনার আঘাতে ‘ধুলো ওড়া এই উইকেটে’ দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। তাহলে হয়তো নিজের নামের পাশে বড় একটা স্কোর দেখা যাবে। লড়াই মানুষকে অপেক্ষা করতে শেখায়। আর অপেক্ষা শেখায় লড়াইয়ে জিততে। আমরা করোনা জয়ের অপেক্ষায়ই থাকলাম।

অঘোর মন্ডল ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক