ছোটবেলায় বাড়িতে মেহমান এলে বা আসবে শুনলে ভাবতাম, তিনি বা তারা আমাদের জন্য কী নিয়ে আসবেন। ধরেই নিতাম তিনি খালি হাতে আসবেন না। কিছু না কিছু তো আনবেনই। ঠিক সেই ছোটবেলার মতোই আমরা আশায় থাকি ভারত থেকে যখন কেউ আসেন। ব্যক্তি পর্যায়ে বলছি না, বলছি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে নগণ্য কোনো সচিব এলেও আমরা আশায় বুক বাঁধি। এবার নিশ্চয়ই কিছু আসবে আমাদের জন্য। এ নিয়ে আমরা নিজেরাই ঢাক বাজাতে থাকি। এবার কী কী উপহার পেতে পারি। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। প্রত্যাশিত উপহার পাওয়া যাবে কি যাবে না, এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার পাশাপাশি থাকে আকাশকুসুম স্বপ্ন।

দুই দেশে সরকার বদল হলেও প্রত্যাশা বা স্বপ্নের বদল হয় না। বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতের কাছে তৃষ্ণার জল প্রথম দাবি। অর্থাৎ তিস্তার জল কবে মিলবে, এর উত্তর খোঁজা হচ্ছে অনেকদিন ধরে। সরকারের পর সরকার বদল হয়েছে, কিন্তু সদুত্তর মেলেনি। আমরা এই সদুত্তর আশা করতেই পারি।

দুই দেশে সরকার বদল হলেও প্রত্যাশা বা স্বপ্নের বদল হয় না। বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতের কাছে তৃষ্ণার জল প্রথম দাবি। অর্থাৎ তিস্তার জল কবে মিলবে, এর উত্তর খোঁজা হচ্ছে অনেকদিন ধরে। সরকারের পর সরকার বদল হয়েছে, কিন্তু সদুত্তর মেলেনি।

ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতি কমছে না, বরং বাড়ছে। ‘সেভেন সিস্টার’ বা ‘সাত বোন’ বলে পরিচিত সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশ এখনও প্রত্যাশিত বাণিজ্য সুবিধা পায়নি। মূল ভূখণ্ডে তো নয়ই। সার্কভুক্ত সদস্য রাষ্ট্র হিসেবেও আঞ্চলিক অনেক সুযোগ-সুবিধা ভারত, নেপাল থেকে পেতে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হয়নি। ভিসা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছে। তবে সেখানে লাভের গুড় কিন্তু ভারতের দিকেই।

চিকিৎসা, পর্যটন ও সাধারণ পর্যটন থেকে এ খাতে ভারতের আয়ই বেশি। বিদ্যুৎ এসেছে ভারত থেকে, এদিকে দেশের অনেক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট রয়ে যাচ্ছে অব্যবহৃত। মোটামুটিভাবে বলা যায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে লেনাদেনার সম্পর্ক, বিশেষ করে ধনী প্রতিবেশী হিসেবে, সেখানে বাংলাদেশের হাল গরিব প্রতিবেশীর মতোই। প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের প্রতি আমাদের উচ্চ আশা।

ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী, নরসীমা রাও, আইকে গুজরাল, প্রণব মুখার্জি, নরেন্দ্র মোদি, জ্যোতি বসু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ কেউ কম আসা-যাওয়া করেননি। একাত্তরের পর ভারত বাংলাদেশকে কতটুকু দিল? প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে কী দিলেন?
১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ভারত প্রতিবছর গঙ্গা দিয়ে বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো বছরে মাত্র দেড় হাজার কিউসেক পানি পেয়েছে বাংলাদেশ। জ্যোতি বসু পদ্মার জল, তিস্তার জল কোনো জলের মীমাংসা করে যেতে পারেননি। যৌথ নদী কমিশনও এখন আর কার্যকর নয়ই বলা যায়। বন্ধ হয়নি সীমান্তে মানুষ হত্যা। গরু পাচার বা অন্য যেকোনো চোরাচালানের অজুহাতে সীমান্তে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই ভারতের সাধারণ নাগরিকরাও সীমান্ত হত্যা মেনে নিতে পারছেন না।

ফেলানী হত্যার পরও নিয়মিত লাশের প্রাচীর উঠছে যেন সীমান্তে। আমরা চাই সীমান্ত হত্যা বন্ধ হোক। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশ কখনও বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে পেরে ওঠে না। বড় প্রতিবেশীর অনুকম্পাই ভরসা। সেই অনুকম্পাতেই হয়তো ছিটমহল জটিলতার অবসান হয়েছে। কিন্তু ছিটমহল জটিলতার সমাধান বাংলাদেশের ব্যাষ্টিক অর্থনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পেরেছে?

ভারত কিন্তু আমাদের আখাউড়া স্থলবন্দর, আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন রুটের সঙ্গে সড়ক, ট্রেন যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে তাদের ‘সেভেন সিস্টার’ রাজ্যের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ স্থাপন করে আর্থিক লাভবান হয়েছে বেশি।

নরেন্দ্র মোদি এ মাসেই বাংলাদেশ সফর করবেন। ২৬ মার্চ তার সম্ভাব্য সফরের প্রস্তুতি হিসেবে ৪ মার্চ ঢাকা সফর করে গেলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। আমরা জয়শঙ্করের সফর ঘিরে আবার অতিথির উপহার নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আবার আমাদের চোখে অর্থাৎ স্বপ্নে নদীর জল ভাসতে থাকল। এবার মোদি এসে কি তিস্তা নিয়ে কিছু বলবেন? শিবশঙ্কর বলে গেলেন, ‘তিস্তার বিষয়ে ভারত পূর্বের অবস্থানেই আছে।’ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে এবার যদি আবার মমতাই আসেন। তবে তিস্তার জল বাংলাদেশমুখী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মমতাকে ইলিশ এবং আরও উপহার দিয়েও জল বিষয়ে তার কাছ থেকে বাংলাদেশ কোনো মমতা আদায় করতে পারেনি। যদি মমতার তৃণমূল না আসে, বিজেপি বিধানসভায় জয়ী হলে কি মোদি চোখ বুজে তিস্তার জল দিতে রাজি হয়ে যাবেন?

জয়শঙ্করের সফর ঘিরে আবার অতিথির উপহার নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আবার আমাদের চোখে অর্থাৎ স্বপ্নে নদীর জল ভাসতে থাকল।

নরেন্দ্র মোদিকে তেমন বোকা ভাববার সুযোগ নেই। যারা ভোট দিয়ে বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে আসীন করাবেন, তাদের মতের বাইরে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি তিস্তার জল আঁজলা ভরে এনে আমাদের করতলে তুলে দেবেন না। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকালীন সময়ে তার বাংলাদেশ সফরটিও ভোটের রাজনীতির অংশ।

এখানকার দুটি মন্দির সফর করে ভোটের অঙ্কে প্রভাব রাখেন এমন দেড় কোটি ভোটারকে তুষ্ট করবেন তিনি। অতএব গঙ্গা, টিপাই মুখ, ট্রানজিট, আন্তঃবিদ্যুৎ সরবরাহ, সেভেন সিস্টার রাজ্যের বাণিজ্য, সীমান্ত বাজার, ছিটমহল এবং তিস্তা যাই বলি না কেন, কোনো দরকষাকষিতেই প্রভাবশালী প্রতিবেশীর কাছ থেকে বাংলাদেশ গৌরবজনক উপহার পায়নি। মোদির আসন্ন সফরও তেমন কোনো উপহার কপালে জুটবে বলে মিথ্যে স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। গরিব প্রতিবেশীর ক্ষমতাধর প্রতিবেশীকে সয়ে যাওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে? এরপরও ভারতের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। সেই প্রত্যাশা পূরণ হবে এইটা আমাদের বিশ্বাস।

তুষার আবদুল্লাহ।। গণমাধ্যমকর্মী