সরকারি খাদ্য বিভাগের আওতায় খোলা বাজারে চাল বিক্রি হয় যা ওএমএস নামে পরিচিত। শুরু করার পর থেকেই চাল কিনতে আগ্রহী লোকের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। অনেকেই সেই ভোর রাত থেকেই অগ্রিম লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। বিষয়টা অনেকটাই টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো বা ট্রাকের পেছনে লোকজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সাথে দৌড়ানোর দৃশ্যের পুনরাবৃত্তির মতো ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

আমরা বারবার বলে আসছি, করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। কিন্তু সংসার চালাতে তাদের খরচের পাল্লা বাড়ছে দ্রুত গতিতে। এতেই মানুষ সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।

ধার দেনা করে একটা সময় সংসার চালিয়েছেন, কিন্তু এখন সেই পথও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই মানুষ বাধ্য হয়ে কম দামি পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভরা মৌসুমেও দেশে চালের দাম বাড়তি কেন? আবার চালের সাথে খাদ্যের অন্যান্য বিষয় যেমন আটা ও ময়দার দামও বাড়ছে কেন?

বাজারে ৬০-৬২ টাকায় মিনিকেট চাল পাওয়া গেলেও এখন ঐ টাকায় বিআর-২৮ মোটা চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা। একইভাবে ১১০ টাকার ডাল এখন ১৪০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। মাছ, মাংসের দামও চড়া।

নিত্যপণ্যের দরদামেও স্বস্তির কোনো খবর নেই। দাম ছুটছে তো ছুটছেই। এমন পরিস্থিতিতে বড় বিপদে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের সাধারণ মানুষ। কেউ কেউ এতদিন খাবারের পরিমাণ কমালেও এখন আবার বাধ্য হয়েই তুলনামূলক কম দামের পণ্যের দিকেই তাদের চোখ। 

করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। কিন্তু সংসার চালাতে তাদের খরচের পাল্লা বাড়ছে দ্রুত গতিতে। এতেই মানুষ সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।

আমাদের দেশে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় আমন ধান কাটা। এর পাশাপাশি চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের সময়সীমাও বাড়ানো হয়। কিন্তু এসবের সুফল চালের বাজারে দেখা যায়নি। ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ছে কেন? তার কারণ অনুসন্ধানের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করেছেন।

তবে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে চাল ব্যবসার সাথে জড়িতদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চাল ব্যবসা বড় বড় কর্পোরেট গ্রুপের  হাতে চলে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাজারে নতুন চাল আসার সাথে সাথেই তারা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কিনে নিয়ে মজুত করে, পরে এই চাল প্যাকেটজাত করে বাজারে ছাড়ে।

প্লাস্টিকের সুদৃশ্য বস্তায় ৫০ কেজি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটে বাজারজাত করে। এই ‘ভিআইপি চালের’ দাম অনেক বেশি। আর তার প্রভাবে সাধারণভাবে সব চালের দাম বাড়তি হচ্ছে।

তাদের প্রভাবে চটের বস্তার চাল বাজার থেকে দিন দিন উধাও হয়ে যাচ্ছে। আবার এর বাইরে ধানের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং গমের ব্যবহার কমে চালের চাহিদা বাড়ার কারণেও চালের দাম বাড়ছে। এর সঙ্গে মজুত প্রবণতাও কাজ করছে।

আবার কর্পোরেট গ্রুপগুলোর বেশি দামে চাল বিক্রির কারণে চালের বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। যে চাল প্যাকেটজাত করে ৭৫-৮০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে, সেই চালই খোলা বাজারে ৬০-৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, চলতি আমন মৌসুমে সারা দেশে ৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবাদ হয়েছিল ৫৯.৫৪ হেক্টর জমিতে। এবার আমন ধানের মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক কোটি ৬৩ লাখ মেট্রিক টন। আর হেক্টর প্রতি উৎপাদন লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩. ৫৬ মেট্রিক টন।

এখনো পর্যন্ত যে পরিমাণে ধান কাটা হয়েছে, তাতে হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ৩.৬ থেকে প্রায় ৪ মেট্রিক টন। এবার কৃষকও আমনের ভালো দাম পাচ্ছেন। ধানের মান অনুযায়ী এক হাজার টাকা থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা মণ দরে এখন আমন ধান বিক্রি হচ্ছে। এতে কৃষকের যে খরচ হয়েছে তার চেয়ে বেশি পাচ্ছেন তারা।

তারপরও চালের বাজারে অস্থিরতা কেন? এই বিষয়ে চালকল মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বড় বড় শিল্প গ্রুপ এখন চাল ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। নতুন চাল উঠলেই তারা তা কিনে নিয়ে প্লাস্টিকের সুদৃশ্য বস্তা এবং প্যাকেটজাত করে বেশি দামে বিক্রি করে।

৬০ টাকা কেজির চাল তারা ৭৫-৭৬ টাকায় বিক্রি করে। আগে তারা সরু, পোলাও ও সুগন্ধি চাল এভাবে বিক্রি করতো। এখন তারা প্রায় সব ধরনের চালই বিক্রি করছে। এর প্রভাব বাজারেও পড়ছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে একটু উচ্চ মানের চাল বাজারজাত করছে প্যাকেট করে। তার একটি প্রভাব থাকতে পারে চালের দাম না কমায়।

কৃষি উপকরণ, সারের দাম বেশি। কৃষি শ্রমিকের মজুরিও বেশি, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে ধানের। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গমের আমদানি কমে যাওয়া। ফলে বাংলাদেশের মানুষের চালের চাহিদা বেড়েছে। এইসব কারণে চালের চাহিদা বেড়েছে। তাই ভরা মৌসুমেও দাম কমছে না। আবার  কিছু মিল মালিকদের মধ্যেও মজুত প্রবণতা বেড়েছে।

নিত্যপণ্যের ক্রমাগত দাম বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন মধ্যবিত্তসহ সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে তুলনামূলক কম দামের পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় চলমান কার্যক্রমগুলোর আওতা ও পরিধি বাড়ানো এবং খাদ্য বিভাগের আওতায় পরিচালিত ওএমএস ও টিসিবির মাধ্যমে পরিচালিত ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় ১ কোটি পরিবারের প্রদেয় সহায়তার পরিমাণ ও পারিবার সংখ্যা বাড়ানো। 

চালকল মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বড় বড় শিল্প গ্রুপ এখন চাল ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। নতুন চাল উঠলেই তারা তা কিনে নিয়ে প্লাস্টিকের সুদৃশ্য বস্তা এবং প্যাকেটজাত করে বেশি দামে বিক্রি করে।

পাশ্ববর্তী দেশের আদলে পাড়া-মহল্লায় ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলার ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বারবার অনুশাসন দিচ্ছেন, সেই অনুযায়ী প্রকৃত কৃষকদের হাতে ভর্তুকি পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে।

কৃষকরা যেন তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় যথাযথ জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে আমদানি ও বিক্রয় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হবে।

বাজার তদারকিতে উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সমন্বিত বাজার তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে নিদিষ্ট কিছু পণ্য আমদানিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে।

কৃষি ও খাদ্য পণ্যের দাম নির্ধারণে ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, দাম নির্ধারণে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ভোক্তার অংশগ্রহণ ও মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।

মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনে পৃথক মূল্য নির্ধারণ কমিশন গঠন করা যেতে পারে। সিন্ডিকেট ও মজুতদারি ঠেকাতে প্রতিযোগিতা কমিশনের মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় ও দৃশ্যমান করা উচিত। এছাড়াও মজুত আইনের সংজ্ঞাও পরিবর্তন করে মজুতদারদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

 এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)