ছবি : সংগৃহীত

নারীর জন্যে মোটেই ভালো যায়নি ২০২২ সাল। এই যে বলছি ভালো যায়নি বছরটা এর মানে কিন্তু এই না যে, এর আগের বছর খুব ভালো ছিল বা আগামী বছর আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে বাংলাদেশে নারীর অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন হয়ে যাবে।

বছরটা ভালো যায়নি মানে হচ্ছে, ২০২২ সালও সমাজে নারীর অবস্থা আগের মতোই ছিল, কোনো অগ্রগতি হয়নি, ধর্ষণ ও নারীর প্রতি অন্যান্য নির্যাতন এর আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে এবং ২০২২ সালে নারীর অধিকারের প্রশ্নে কিছু নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে যেগুলো নারীর মুক্তির সংগ্রাম প্রভাবিত করবে।

২০২২ সালের শুরুতেও কোভিডের প্রভাব ছিল, সকলের তখন প্রত্যাশা ছিল যেকোনোভাবে এই কোভিড পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারলেই বাঁচি। এরপরই তো শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, এই যুদ্ধের প্রভাব তো শুধু ইউক্রেনে সীমাবদ্ধ থাকেনি, আমাদের দেশসহ পৃথিবীর নানা দেশের নারী পুরুষ সকলেই এই যুদ্ধের প্রভাবে কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> মেয়েতো কালো

সব মিলিয়ে প্রত্যাশাও এমন কিছু ছিল না যে, এই বছর নারীর জন্যে খুব ভালো কিছু হবে, আর বাস্তবে হয়েছে যেটা, নারীর জীবন ২০২২ সাল আগের বছরের চেয়ে ছিল কঠিন, বৈরী আর কষ্টের।

২০২২ সাল নারীর প্রতি আমরা কতটা সদয় ছিলাম জানেন? আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৮৮৬ জন্য নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই ৮৮৬ জনের মধ্যে ৫৬ জন হচ্ছে ৬ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশু। ১০০ জন হচ্ছে ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু। 

ধর্ষণের পর অপরাধী যদি ধরা পড়ে আর সময়মতো বিচার হয় তাহলে অন্তত আমরা বলতে পারি যে, অবস্থা ততটা খারাপ নয়...

সংখ্যাগুলো আরেকটু বেশি হবে, কেননা কয়েক’শ ধর্ষণের শিকার নারীর বয়স সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাহলে আপনিই হিসাব করে দেখুন গড়ে প্রতি মাসে কয়জন নারী শিশু, যাদের বয়স ৬ থেকে ১৩, ওরা বাংলাদেশের পুরুষদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে এই সময়ে ১৪৩ জন—ওদের যুক্ত করে গড় করুন, তাহলে ভয়াবহতার রূপ আরও খানিকটা স্পষ্ট হবে। এই ৮৮৬ জন নানা বয়সী নারীর ধর্ষণের কথা বলছি, এটা কিন্তু সম্পূর্ণ ছিল মোটেই নয়।

আরও পড়ুন >>> বাল্যবিবাহ উপসর্গ মাত্র, মূল ব্যাধি পিতৃতন্ত্র

এইটা হচ্ছে সেইসব খবর থেকে নেওয়া তথ্য, যেগুলো দেশের বড় চার পাঁচটা কাগজে ছাপা হয়েছে। অনেক ধর্ষণের খবর কোনোদিন গণমাধ্যমে মাধ্যমে আসেনি, সেসবও ধর্ষণের তথ্য আমাদের এই পরিসংখ্যানে নেই। ধর্ষণের সংখ্যা ও ভয়াবহতা এর আগের বছরের চেয়ে বেশি। এই যদি হয় অবস্থা, বাংলাদেশের নারীর জন্য বছরটা তাহলে কেমন ছিল?

ধর্ষণ তো সব দেশেই হয়, যতদিন পিতৃতন্ত্র থাকবে এবং নারীর অধিকার সম্পূর্ণরূপে কার্যকর না হবে ততদিন ধর্ষণ কম বেশি থাকবে। এইখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাষ্ট্র সরকার, দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা এইসব ঘটনায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া করে, নির্যাতিতা নারীরা কতটা আইনগত প্রতিকার পায় ইত্যাদি।

কেননা ধর্ষণের পর অপরাধী যদি ধরা পড়ে আর সময়মতো বিচার হয় তাহলে অন্তত আমরা বলতে পারি যে, অবস্থা ততটা খারাপ নয়। ঐ যে ৮৮৬টি ধর্ষণের খবরের কথা বলেছি ইতিপূর্বে, সেই ৮৮৬টি ঘটনার মধ্যে ২৭১টি ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে বলে জানা যায়নি। এগুলোর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণ রয়েছে, যেটাকে আমরা গ্যাং রেপ বলি, শিশু ধর্ষণ রয়েছে—যেসব ঘটনায় কোনো মামলার খবরই পাওয়া যায়নি, বিচার তো দূরের কথা।

৪২টি ঘটনায় ধর্ষণের পর নির্যাতিতার মৃত্যু হয়েছে, অনেক ঘটনায় ধর্ষণের পর নির্যাতিতা নারী আত্মহত্যা করেছে। বিচার? বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনায় দোষী ব্যক্তির সাজা হয়েছে এরকম খবর পাবেন খুবই কম—সারা বছরে হয়তো একটা অথবা দুইটা।

ধর্ষণের ঘটনার অনুপাতে শতকরা হিসাব করলে সেটা হবে অনুল্লেখযোগ্য বা উপেক্ষণীয় একটি ভগ্নাংশ মাত্র। এইটাই হচ্ছে ভয়াবহতা—বাংলাদেশে নারী ধর্ষণ হয়, শিশু ধর্ষণ হয় কিন্তু সাধারণত ধর্ষণের বিচার ও সাজা হয় না। ২০২২ সালেও তাই হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> তুমি অকুণ্ঠিতা

এই যে এগারো মাসের চিত্র, চিত্রটা আগের কয়েক বছরের তুলনায় ভয়াবহ, অপরাধের হার বেড়েছে। এখানে তো শুধু ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে যদি ধর্ষণ চেষ্টা, নারীর প্রতি নিপীড়ন ও সহিংসতার পরিসংখ্যান এবং এইসব ধর্ষণ ও সহিংসতার ধরন সম্পর্কে আলোচনা করা হয় তাহলে ভয়াবহতার রূপটা যে কত ভয়ংকর সেটা বোঝা যায়।

এই এগারো মাসে স্বামীর হাতে মৃত্যু হয়েছে ১৯০ জন নারীর। এমনিতে ঘরের মধ্যে মারধোরের শিকার হওয়া, ঘরের বাইরে যৌন হয়রানি ও অন্যবিধ নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছে নানা বয়সী অসংখ্য নারী। এইসব ঘটনা নির্দেশ করে আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান কোথায়। 

আমাদের সমাজে নারীকে পুরুষের সমান মানুষ বিবেচনা করা হয় না, বিবেচনা করা হয় মানুষের তুলনায় অধম একপ্রকার ঊন-মানুষ হিসেবে। নারীদের মধ্যে এই বৈষম্য বিরোধী একটা সংগ্রাম তো ক্ষীণ হলেও চলমান আছে।

আমাদের সমাজে নারীকে পুরুষের সমান মানুষ বিবেচনা করা হয় না, বিবেচনা করা হয় মানুষের তুলনায় অধম একপ্রকার ঊন-মানুষ হিসেবে। নারীদের মধ্যে এই বৈষম্য বিরোধী একটা সংগ্রাম তো ক্ষীণ হলেও চলমান আছে। কিন্তু সমান অধিকারের জন্য সংগ্রাম যতটা না তীব্র, এই বছর দেখা গেছে যে নারীকে পেছনের দিকে অবরোধের মধ্যে বেঁধে রাখার পক্ষে জনমত যেন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তার বহিঃপ্রকাশও হয়েছে নানা ঘটনায়।

নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনের ঘটনা একটা বড় উদাহরণ। একজন শিক্ষার্থী নারীকে তার পোশাকের জন্যে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে একদল লোক হামলা করেছে। সেই হামলায় নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখা গেছে আবার একজন নারীই। সেই হামলাকারী নারীর পক্ষে সমর্থন ও সহানুভূতিমূলক আচরণ দেখা গেছে সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল মানুষের মধ্যে।

আরও পড়ুন >>> মুক্তনীলের মুক্ত বিহঙ্গ 

নরসিংদীর সেই ঘটনা ছাড়াও বাসে একটি কম বয়সী নারীকে পোশাকের জন্যে হয়রানি হতে হয়েছে সেরকম একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজশাহীতে খোলা জায়গায় সিগারেট খাচ্ছিল বলে একজন ছাত্রীকে হুমকি দিয়েছে ও লাঞ্ছনা করেছে সেখানকার একদল লোক।

এছাড়াও নানা জায়গায় নারীদের হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়েছে পোশাকের জন্যে। অর্থাৎ একজন নারী কী পোশাক পরবে সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও বাংলাদেশের সমাজ স্বীকার করে না। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে যে নারীকে জীবনযাপন করতে হবে পুরুষের বেঁধে দেওয়া নিয়মের মধ্যেই, পরতেও হবে পুরুষের নির্ধারণ করে দেওয়া পোশাক।

নারীর অধিকার আদায় বা পুরুষের সমান মানুষ হিসেবে মর্যাদা লাভের গন্তব্য তো বহু দূর, কিন্তু দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ফলে যতটুকু অর্জন হয়েছিল, সেটাও যেন এখন পিছিয়ে যেতে বসেছে। এই বছরের এগারো মাসের ঘটনাবলি তো অন্তত সেই লক্ষণই নির্দেশ করে আরকি।

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট