হাসান সাহেব অন্তর্মুখী মানুষ। মনে মনে অনেক কিছু ভাবেন, কিন্তু মৃদু হাসি-বিনিময় ছাড়া কখনওই সেসব কথা কাউকে বলা হয়ে ওঠে না তার। দুই সন্তান নিয়ে থাকেন ঢাকা শহরে। একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। বেতন যা পান তাতে ব্যয় নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে।

গত পাঁচ বছরে খরচ বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু বেতন রয়ে গেছে আগের জায়গাতেই। হঠাৎ বেশকিছু টাকার প্রয়োজন পড়ে তার। কী করে জোগাড় হবে— ভাবতে ভাবতে অফিসে যাওয়ার জন্য লোকাল বাসে চড়ে বসেন হাসান সাহেব। অফিসে পৌঁছে অন্য দিনের মতো কম্পিউটার ওপেন করে কাজ শুরু করেন। আচমকা তার হাত অবশ হয়ে আসে। ‘আমার হাত’— বলতে বলতে কথা জড়িয়ে যায় তার।

পাশের ডেস্কের আবির লক্ষ করেন বিষয়টি। ডেস্ক ছেড়ে উঠে আসতে আসতে হাসান সাহেব ঢলে পড়েন। আবির পত্রিকায় স্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় সম্পর্কে পড়েছিলেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করেন। প্রায় ৪০ মিনিট পর অ্যাম্বুলেন্স  আসলে হাসান সাহেবকে নিয়ে আবির রওনা দেন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যানজটে আটকা পড়ে পথেই চলে যায় দুই ঘণ্টা। চিকিৎসকের কাছে পৌঁছাতে পেরিয়ে যায় আরও ১৫ মিনিট।

আরও পড়ুন >>> জীবন নিয়ে খেলা! 

আবির জানতেন স্ট্রোকের রোগীর জন্য প্রথম তিন থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যানজটের কারণে অপচয় হয়ে গেছে অনেকটা সময়। হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবির কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভাবেন, শেষপর্যন্ত চিকিৎসকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন তারা। চিকিৎসকও দিতে পেরেছেন আইভি থ্রম্বোলাইসিস।

অধিক জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬৫.১৬ মিলিয়ন বা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। শহরে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যা পাঁচ কোটি ২০ লাখ নয় হাজার ৭২ জন। শুধু ঢাকা শহরে (উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন) বাস করেন এক কোটি দুই লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জন [২]।

দেশে মোট মোটরযানের সংখ্যা ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৪৪টি। এর মধ্যে বাসের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৭৮৯ টি, মিনিবাস ২৭ হাজার ৩৬১টি, প্রাইভেট-কার তিন লাখ ৭৩ হাজার ৮০৬টি, জিপ ৬৮ হাজার ৩৫৪টি, মাইক্রোবাস এক লাখ পাঁচ হাজার ৪১২টি এবং মোটরসাইকেল ৩২ লাখ ৯৯ হাজার ১১২টি

বিপুল এই জনগোষ্ঠীর চলাচল ও পণ্য পরিবহনের জন্য বাহনও দরকার অনেক বেশি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য (৩০ জুন ২০২১) অনুযায়ী, দেশে মোট মোটরযানের সংখ্যা ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৪৪টি। এর মধ্যে বাসের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৭৮৯ টি, মিনিবাস ২৭ হাজার ৩৬১টি, প্রাইভেট-কার তিন লাখ ৭৩ হাজার ৮০৬টি, জিপ ৬৮ হাজার ৩৫৪টি, মাইক্রোবাস এক লাখ পাঁচ হাজার ৪১২টি এবং মোটরসাইকেল ৩২ লাখ ৯৯ হাজার ১১২টি [৩]।

২০২১ সালে ঢাকায় এক লাখ ৫০ হাজার ৫৬১টি, ২০২০ সালে এক লাখ ১৮ হাজার ২৫৪টি যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছিল। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ঢাকায় ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৭৫টি যানবাহন নিবন্ধিত। বিআরটিএ’র হিসাবে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে সারাদেশে ৯৬ হাজার ৮৭৮টি যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছে। এ সময় ঢাকায় নিবন্ধিত হয় ২৯ হাজার ৬৭৮টি যানবাহন, যা মোট সংখ্যার ৩০ দশমিক ৬৩ শতাংশ [৩]।

আরও পড়ুন >>> অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক সিলগালা : বেটার লেট দ্যান নেভার 

এখানে দেখা যায়, মোটরসাইকেলের নিবন্ধন বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এরপরই আছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা। নগর ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা দরকার কিন্তু ঢাকায় আছে নয় শতাংশের মতো। রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) জরিপ অনুযায়ী, রাজউক এলাকায় রাস্তা আছে ১৩ হাজার ৮৬৫ কিলোমিটার। পাঁচ ফুট বা তার কম প্রস্থের সড়ক আছে এক হাজার ৭৮৭ কিলোমিটার, আট ফুট বা তার কম প্রস্থের রাস্তার দৈর্ঘ্য পাঁচ হাজার ২২ কিলোমিটার, ১০ ফুট বা তার কম প্রস্থের সড়ক আট হাজার ২৫৮ কিলোমিটার।

২০ ফুট বা তার চেয়ে বেশি প্রস্থের সড়ক রয়েছে এক হাজার ৪৫৬ কিলোমিটার। সবমিলিয়ে রাজউক এলাকায় ১০ দশমিক ৫১ শতাংশ সড়ক রয়েছে, যেখানে আদর্শ মান ২৫ শতাংশ। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার মোট সড়ক দুই হাজার ৭০০ কিলোমিটারের বেশি। ডিএনসিসি এলাকায় এক হাজার ৫০০ কিলোমিটার এবং ডিএসসিসি এলাকায় এক হাজার ২২৭ কিলোমিটার [৪] ও [৫]। 

নগর ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা দরকার কিন্তু ঢাকায় আছে নয় শতাংশের মতো। রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) জরিপ অনুযায়ী, রাজউক এলাকায় রাস্তা আছে ১৩ হাজার ৮৬৫ কিলোমিটার। পাঁচ ফুট বা তার কম প্রস্থের সড়ক আছে এক হাজার ৭৮৭ কিলোমিটার, আট ফুট বা তার কম প্রস্থের রাস্তার দৈর্ঘ্য পাঁচ হাজার ২২ কিলোমিটার, ১০ ফুট বা তার কম প্রস্থের সড়ক আট হাজার ২৫৮ কিলোমিটার

ঢাকার রাস্তায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি রয়েছে। বেড়ে চলছে ব্যক্তিগত ছোট ছোট গাড়ি ও বাইকের সংখ্যা। ফলে যানজট নিয়ন্ত্রণ দুরূহ হয়ে পড়ছে।

আরও পড়ুন >>> স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?

এদিকে, ঢাকার রাস্তায় বের হলেই যানবাহনের হর্নের শব্দে কান পাতা যেন দায়। রাস্তায় হাঁটতে গেলে তো বটেই, আজকাল ফুটপাত ধরে হাঁটতে গেলেও বাইকের হর্নের শব্দে চমকে ওঠার উপক্রম হয়। যদি কেউ হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপের রোগী হন তাহলে তাকে একরকম জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে রাস্তায় বের হতে হয়। উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজানোর ফলে মানুষ বা পরিবেশের ওপর বড় ধরনের বিপদ আসতে পারে। হর্নের বড় উৎস হিসেবে ধরা হচ্ছে বাস, ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি বা বাইকে ব্যবহৃত উচ্চমাত্রার হর্ন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে যানজটের তীব্রতা দিনদিন প্রকট হচ্ছে। যানজটের সাধারণ ক্ষতিগুলোর সঙ্গে সঙ্গে যে বিষয়গুলো অমাদের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে তা হলো দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা।

তারা বলছেন, দীর্ঘক্ষণ যানজটে পড়ে নাগরিকদের মেজাজ হচ্ছে খিটখিটে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, কিডনি সমস্যা, হৃদযন্ত্র ও প্রজননতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে কান ও চোখের। শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ও স্নায়বিক ক্ষতির অন্যতম কারণও অতিরিক্ত যানজট।

মোটরগাড়ি বিশেষ করে দুই স্ট্রোকবিশিষ্ট ইঞ্জিনের গাড়ি বায়ুদূষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। শহরে বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস যানবাহনের ধোঁয়া। এটা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিত একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ধোঁয়া নির্গমন নিয়ন্ত্রণ এবং ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত করা। ছোট গাড়ি ক্রয়ে মানুষকে নিরুৎসাহিত করে গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহিত করা।

আরও পড়ুন >>> নকল ও ভেজাল ওষুধের প্রভাব ও প্রতিকার 

ঢাকা শহরের মতো বড় শহরগুলোতে পরিবারপ্রতি একের অধিক গাড়ি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। কোনো কোনো এলাকাকে সম্পূর্ণভাবে মোটরযানমুক্ত ঘোষণা করে জনসাধারণের মধ্যে সাইকেল চালানো এবং পায়ে চলার প্রবণতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এতে জনসাধারণের অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

আমরা প্রত্যাশা করি, বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে সাময়িক প্রশান্তি অনুভব করলেও তা আমাদের কর্মঘণ্টা ও কর্মক্ষমতা— দুটোই কেড়ে নিচ্ছে, সে বিষয়ে সবাই একমত হবেন। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন কমিয়ে আনা সম্ভব। এটা করতে পারলে নিশ্চিত হবে নগরের সুস্বাস্থ্য ও নাগরিকের সুস্বাস্থ্য।

লেখক : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট
 
রেফারেন্স :

১. Urban Transport and Health Available online : https://www.who.int/publications-detail-redirect/9789241502443 (accessed on 11 October 2022).

২. বাংলাদশে পরসিংখ্যান ব্যুরো Available online: http://www.bbs.gov.bd/site/page/efc8de5d-dee5-4cb7-918c-7498bcd5981a/http%3A%2F%2Fwww.bbs.gov.bd%2Fsite%2Fpage%2Fefc8de5d-dee5-4cb7-918c-7498bcd5981a%2F- (accessed on 17 September 2022).

৩. বাংলাদশে সড়ক পরবিহন র্কতৃপক্ষ-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদশে সরকার Available online: http://www.brta.gov.bd/ (accessed on 12 October 2022).

৪. মাসুম ওবায়দুর, ‘বাড়ছে ছোট গাড়ি, বাড়াচ্ছে যানজট’ Available online: https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article2042566.bdnews (accessed on 12 October 2022).

৫. রাজধানী উন্নয়ন র্কতৃপক্ষ (রাজউক) Available online: http://www.rajuk.gov.bd/ (accessed on 11 December 2022).

এমএআর/