জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি((ডব্লিউএফপি) কর্তৃক ২০২২ সালের আগস্টের বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও ঝুঁকি তদারকি বিষয়ে জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নিত্যপণ্য কেনার জন্য ২৯ শতাংশ পরিবারকে সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে। সব সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে ১০ শতাংশ পরিবার। ৬৪ শতাংশ পরিবার কোনো না কোনোভাবে ঋণ নিচ্ছে। ৪৪ শতাংশ পরিবার বাকিতে পণ্য কিনছে।

সংস্থাটি দেশের আট বিভাগের ১২০০ পরিবারের ওপর জরিপ পরিচালনা করে এমন তথ্য পেয়েছে। তথ্যগুলো আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতি ও ভোক্তা সংশ্লিষ্টরা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে নানা তথ্য ও ব্যাখ্যা দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলা হচ্ছে।

ক্যাবসহ নানা সংগঠনের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল জীবন জীবিকা ও সংসার চালাতে মানুষ প্রতিনিয়তই চাপের মধ্যে আছেন। বৈশ্বিক করোনাসহ নানা কারণে মানুষের আয় কমেছে। কিন্তু তাদের খরচের পাল্লা ক্রমাগত ভারি হচ্ছে। একটা সময় মানুষ ধার দেনা করে সংসার চালিয়েছে। এখন বাধ্য হয়ে সঞ্চয়ের ওপর হাত বাড়াচ্ছে।

আরও পড়ুন >>> সঞ্চয়পত্র : মুনাফা হ্রাস, সংকট ও বাস্তবতা 

অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতির কারণে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। এই সময়ে মানুষের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা কমা স্বাভাবিক। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চেয়ে ব্যাংকের সুদহার অনেক কম। সঞ্চয় কমার এটি একটি বড় কারণ।

এছাড়া মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যাওয়ায় একই পরিমাণ পণ্য কিনতে আগের চেয়ে এখন বেশি অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী সবাই নগদ টাকা বেশি রাখছেন। তাদের মতে, দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ অনেকটাই দেশীয় সঞ্চয় নির্ভর। নানা কারণে বিদেশি বিনিয়োগ কম। সঞ্চয় কমলে বিনিয়োগ সক্ষমতা আরও কমবে। ফলে সঞ্চয় প্রবণতা কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য শুভ সংবাদ নয়। 

দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ অনেকটাই দেশীয় সঞ্চয় নির্ভর। নানা কারণে বিদেশি বিনিয়োগ কম। সঞ্চয় কমলে বিনিয়োগ সক্ষমতা আরও কমবে।

মানুষের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা কমছে কি না তা বোঝার সবচেয়ে বড় উপায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি এবং মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধি। দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখন খারাপ অবস্থায় রয়েছে। সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাতে বাধ্য হওয়া শ্রেণির মধ্যে মধ্যবিত্তরাই একটি বৃহৎ অংশ।

চাকুরীজীবী কয়েকজনের সাথে আলোচনায় জানা যায়, টানাটানির সংসারে করে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা ব্যাংকে ডিপিএস শুরু করেন, কিন্তু প্রতি মাসে শুধু বাজার খরচা শুধুই বেড়েই চলেছে।

আরও পড়ুন >>> টাকার নাকি পাখা গজাইছে! 

তার ওপর যাতায়াত, সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্য সব খরচ সমানতালে পাল্লা দিয়ে বেড়েছেই চলেছে। কিন্তু আয় সেই আগের জায়গায় স্থির। ফলে সংসার চালাতে গিয়ে একটা সময় ঋণী হতে হচ্ছে। পরে নিরুপায় হয়ে ডিপিএস বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আর জমানো টাকা থেকেই প্রতি মাসে টাকা তুলে খরচ করতে হচ্ছে।

সংকটের সময় অন্যের ওপর নির্ভর না করে জমানো টাকা দিয়ে অন্তত সংসারের টানাটানি কিছুদিনের জন্য হলেও মেটানো সম্ভব। অনেকে আবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। যার কারণে ব্যাংকগুলোয় নতুন করে ডিপিএস বা এফডিআর হিসাব খোলার প্রবণতা অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে, বেড়েছে ব্যক্তি পর্যায়ের ঋণ।

ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফা দিলেও সাম্প্রতিক সময়ে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে অনেকখানি। ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট ও নানা গুজবের কারণে মধ্যবিত্তসহ সীমিত আয়ের অনেকেই হাতে নগদ টাকা আগের চেয়ে বেশি রাখছেন।

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাতে বাজারের পণ্য ও সেবার দাম এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বেড়েছে। আবার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ও ব্যাংকে টাকা রাখার মুনাফাও কমেছে। একটা সময়ে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা সঞ্চয়পত্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতেন।

আরও পড়ুন >>> মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা 

সরকার সেখানে লাভের ওপর নজর দিয়ে সেখানেও মুনাফা কমিয়েছেন। ফলে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের অনেকেই এখন সঞ্চয় থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আর সঞ্চয়ের বিপরীতে যে লাভ পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে সংসার চালানো যাচ্ছে না। ফলে সীমিত আয়ের মানুষ সংসারের খরচ চালাতে সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। 

মানুষের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা কমছে কি না তা বোঝার সবচেয়ে বড় উপায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি এবং মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধি। দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখন খারাপ অবস্থায় রয়েছে।

আবার বাসা ভাড়া, সন্তানের স্কুল, শিক্ষা উপকরণ, যাতায়াতসহ অন্যসব খরচও বাড়ছেই। ফলে হাত পড়ছে সঞ্চয়ে। সংসারের চাকা ঘোরাতে অনেকে আবার নানা রকম ঋণের জাঁতাকলে পড়ছেন। ব্যক্তি পর্যায় কিংবা অন্য নানা উৎস থেকেও ধার দেনা করে সংসার চালাচ্ছেন অনেকে প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষ।

ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে সাধারণত নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ টানাটানির মধ্যেও সঞ্চয় করার চেষ্টা করেন। করোনার পর পরিবহন খরচ ও চাহিদা বাড়ার কারণে এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। আর এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে অধিকাংশ পণ্যের দাম আর এক দফা উসকে দিয়েছে।

এটা সবাই স্বীকার করেন, মানুষের আয় না বাড়লেও খরচ বেড়েছে। এই কারণে সঞ্চয় ভেঙে ফেলার প্রবণতা স্বাভাবিক। এক বছর আগে একজন মানুষ ১০০ টাকায় যে পরিমাণ চাল কিনতেন, এখন একই পরিমাণ কিনতে খরচ হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকা। আবার আমানতের মুনাফা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় অনেকে সঞ্চয় না করে জমি, স্বর্ণ বা ফ্ল্যাটের মতো সম্পদে বিনিয়োগ করছেন। যার প্রভাব পড়েছে প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে সঞ্চয়ের ওপর।

আরও পড়ুন >>> বৈশ্বিক খাদ্য সংকট : বাংলাদেশ কি প্রস্তুত? 

এটা ঠিক যে, সীমিত আয় ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ মূলত সঞ্চয় করেন। সংকটকালীন সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবেই নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ সঞ্চয় করেন। সামর্থ্যবানরা নিজেরা সঞ্চয়ের পরিবর্তে বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করেন। বাড়তি মূল্যস্ফীতির এই সময়ে তাদের একটি অংশ তা অব্যাহত রাখতে পারছেন না।

বৈশ্বিক কারণে মূল্যস্ফীতি বারবার বাড়ছে। তবে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক হলে যেকোনো সময় এটা ঠিক হয়ে যাবে। ফলে আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে পরিস্থিতি সামলাতে হবে। আর এজন্য সরকারকেও সঞ্চয়ে আগ্রহী করতে সঞ্চয়ের ওপর লাভের পরিমাণ বাড়ানো, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের আস্থা ফিরাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সাথে খাদ্য সংক্রান্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে খাদ্য সংক্রান্ত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বাড়াতে তৎপর হতে হবে।

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)