ছবি : সংগৃহীত

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কেউ সরাসরি বলছেন, কেউ আকার ইঙ্গিতে বলছেন। কিন্তু সমস্যা যে আছে তা স্পষ্ট। সমস্যা হলো আমাদের মূল শিক্ষাক্রম কারিগরি শিক্ষায় নামিয়ে আনা হয়েছে। আইটি, প্রযুক্তি, কারিগরি ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা জীবনেও উদ্ভাবনী জাতিতে পরিণত হতে পারব না।

উদ্ভাবনী দেশগুলো আমাদের কাছ থেকে এটাই চায় যেন আমরা যেন তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির বাজার হতে পারি। বিশাল ক্যানভাসে আমাদের সরকার এবং এই শিক্ষাক্রমের সাথে যারা জড়িত তারা বুঝে হোক কিংবা না বুঝে হোক ঐসব উদ্ভাবনী দেশের মিডলম্যান বা এজেন্ট বা পণ্যের ভোক্তা হিসেবে পরিণত হচ্ছে।

বিজ্ঞান শেখার আগে আইটি, প্রযুক্তি ইত্যাদি কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়া কারিগরি শিক্ষাক্রমের কাজ। সমাজের একটা বড় অংশকে এই শিক্ষা দিতে হবে।

আরও পড়ুন >>> জিপিএ-৫ তৈরির কারখানা! 

দেশকে যারা জ্ঞান, বিজ্ঞান, গবেষণা ও উদ্ভাবনে এগিয়ে নেবে তাদের জন্য শিক্ষাক্রম হবে সেই শিক্ষার স্কুল অথবা কলেজে। সেখানে গুরুত্ব পাবে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, অ্যাকাউন্টিং, বাংলা ভাষা, ইংরেজি, পরিসংখ্যান, অর্থনীতি ইত্যাদির মতো বিষয়।

আমাদের নীতিনির্ধারকেরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান মানে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার, হোয়াইট বোর্ড ও মার্কার ব্যবহার ইত্যাদি বোঝেন। মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে স্কুল লেভেলে যদি পাওয়ার পয়েন্টে লেকচার দেওয়া হয় তাতে ক্ষতি ছাড়া লাভ খুব কমই হবে। মাল্টিমিডিয়া থাকতে পারে। বিশেষ কিছু ছবি বা গ্রাফ ইত্যাদি দেখানোর জন্য থাকলে ভালো হয় কিন্তু আবশ্যিক নয়।

এই শিক্ষাক্রমের ভালো দিক বলে যেটা চালানো হয়েছে সেটা হলো এসএসসি থেকে আগে যেই বিভাজন হতো সেটা আর থাকবে না। এইটা ভালো। কিন্তু যেভাবে বিভাজন উঠিয়ে দেওয়া হলো তা মোটেই ভালো কিছু না।

আমাদের নীতিনির্ধারকেরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান মানে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার, হোয়াইট বোর্ড ও মার্কার ব্যবহার ইত্যাদি বোঝেন...

সবার জন্য সব compulsory বা আবশ্যিক করা মোটেই যুক্তিযুক্ত হয়নি। এর মাধ্যমে শিক্ষার গড় মান কমিয়ে দেওয়া হলো। যেটা করা উচিত ছিল সেটা হলো কয়েকটি বিশেষ বিষয় আবশ্যিক করে (যেমন ভাষা, বাংলাদেশের ইতিহাস) বাকি সব বিষয় ঐচ্ছিক করে দেওয়া। শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দ মতো বিষয় নির্বাচন করবে। এটা করা হয় ইংল্যান্ডে যেটি আমাদের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা পড়ে।

আরও পড়ুন : সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি?

নতুন শিক্ষাক্রমের আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো শিক্ষকদের দ্বারা Continuous Assessment বা টানা মূল্যায়ন। আমরা বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক আবহে বাস করি সেখানে এটি কতটা কার্যকর হবে?

শিক্ষকদের আর্থিকভাবে দুর্বল রাখলে তারা কতটা স্বাধীনভাবে মূল্যায়ন করতে পারবে? এই বেতনে যে মানের শিক্ষক নিয়োগ দেই আমরা তারা কতটা মূল্যায়নে সক্ষম হবে? এইসব না ভেবেই এই পদ্ধতি চালু করা বিপর্যয় হবে। একই কারণে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর কোনো সুফল তো পাইনি উল্টো শিক্ষার মানের ক্ষতি হয়েছে।

নিম্ন বেতনে নিম্নমানের শিক্ষকই পাওয়া যাবে। এই শিক্ষকরা কখনো মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারবেন না। আমাদের সরকার এটাই চায় বলেই শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো বা শিক্ষকদের বেতন ভাতাদি বাড়ানোর উদ্যোগ কখনো নেয়নি। লেখাটি শেষ করছি আমার কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক বিমল সরকারের কাছ থেকে পাওয়া একটি গল্পের মাধ্যমে—

একবার এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্য পরিদর্শনে বের হলেন।

প্রথমে তারা একটি জেলখানা পরিদর্শন করলেন।

আরও পড়ুন : শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ 

জেলখানার বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করার পর মুখ্যমন্ত্রী জেলারের কাছে জানতে চাইলেন, জেলখানার উন্নয়নের জন্য কত টাকার অনুদান দরকার।

জেলার বললেন—স্যার, এখানে সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। এখন কোনো সাহায্যের দরকার নেই।

মুখ্যমন্ত্রী বললেন—তবু আমরা যখন এসেছি; আপনি বলুন।

জেলার কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে বললেন—আপনি যখন চাইছেন, তখন পাঁচ লাখ টাকা দেবেন স্যার।

শিক্ষাক্রমের ভালো দিক বলে যেটা চালানো হয়েছে সেটা হলো এসএসসি থেকে আগে যেই বিভাজন হতো সেটা আর থাকবে না। এইটা ভালো। কিন্তু যেভাবে বিভাজন উঠিয়ে দেওয়া হলো তা মোটেই ভালো কিছু না....

মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী সেটি নোট করে নিলেন।

এরপর তারা একটি কলেজ পরিদর্শন করতে গেলেন।

কলেজের বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করার পর মুখ্যমন্ত্রী অধ্যক্ষকে প্রশ্ন করলেন—কলেজের উন্নয়নের জন্য কী পরিমাণ টাকার প্রয়োজন?

আরও পড়ুন >>> মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষা : সংকট ও করণীয় 

অধ্যক্ষ কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন—স্যার, এই কলেজে শিক্ষকের অভাব আছে। ভবনগুলোর সংস্কার প্রয়োজন, উপযুক্ত ফার্নিচার নেই, ল্যাবরেটরির সব যন্ত্রপাতি নেই, লাইব্রেরির জন্য বই দরকার।

মুখ্যমন্ত্রী তাকে ধমক দিয়ে বললেন—রাজকোষে বেশি টাকা নেই। ন্যূনতম কত হলে চলবে সেটা বলুন।

অধ্যক্ষ বললেন—কম করে হলেও পঞ্চাশ লাখ টাকা।

মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী সেটা নোট করে নিলেন।

এরপর দুই নেতা রাজধানীতে ফিরে গেলেন।

আরও পড়ুন : মাধ্যমিকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পাঠ : চ্যালেঞ্জ ও করণীয় 

পরের দিন মুখ্যমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে বললেন—জেলখানায় পঞ্চাশ লাখ আর কলেজে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার জন্য একটি আদেশপত্র বের করুন।

অর্থমন্ত্রী অবাক হয়ে জানতে চাইলেন—অনুদানের টাকার অঙ্ক উল্টে গেল কেন?

মুখ্যমন্ত্রী বললেন—সেই বুদ্ধি থাকলে আপনি আমার চেয়ারে বসতে পারতেন।

অর্থমন্ত্রী বললেন—তার মানে?

মুখ্যমন্ত্রী হেসে বললেন—দেখুন, ওই কলেজে আপনিও পড়তে যাবেন না, আমিও না। কিন্তু আমাদের যেকোনো সময়ে জেলখানায় যেতে হতে পারে। তাই জেলখানার পরিবেশ একটুখানি আরামদায়ক করে রাখছি।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়