ছবি : সংগৃহীত

একটি-দুটি নয়। এক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ২৩টি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসব ঘটনার বেশিরভাগই ছিল আলোচিত। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে নিন্দার ঝড় উঠেছে।

অতীতে ছাত্রলীগ করতেন এমন অনেকেও সাম্প্রতিক এসব ঘটনায় বিব্রত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। আন্দাজ করা যায়, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার এই সময়ে ক্ষমতাসীন দলও নিশ্চয়ই এসব ঘটনায় সন্তুষ্ট নয়।

ছাত্রলীগের স্লোগান—শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি। অথচ এমন স্লোগানের সংগঠন এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শান্তির বদলে দলের এক শ্রেণির নেতা-কর্মী সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে অশান্তির কারণ হচ্ছেন, বাধা হচ্ছেন প্রগতির পথে।

ছাত্রলীগের বর্তমান নেতারা যতই বলুন না কেন ‘দোষের দায় ব্যক্তির, সংগঠনের নয়’, এমন কথা বলে আসলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। ক্যাম্পাসে নেতাকর্মীর ভালো মন্দের দায় সংগঠনের ওপরই বর্তায়।

এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, অতীতেও ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সংগঠনের ওপরই বর্তেছে স্বাভাবিকভাবেই। ক্ষমতার মসনদে যে রাজনৈতিক দলই থাকুক, বাংলাদেশে কম-বেশি সেই রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনই প্রভাব বিস্তার করেছে। হয়তো এই মাত্রা কম-বেশি থাকতে পারে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এক মাসে ছাত্রলীগ সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা ঘটিয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে যে ঘটনা ঘটেছে তা মেনে নেওয়ার মতো নয়। 

ছাত্রলীগের স্লোগান—শিক্ষা, শান্তি আর প্রগতি। অথচ এমন স্লোগানের সংগঠন এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ছাত্রীকে সারা রাত নির্যাতন করেছেন ছাত্রলীগের প্রভাবশালী এক নেত্রী। নিরীহ ওই ছাত্রীর অভিযোগ, হলের গণরুমে ডেকে নিয়ে সাড়ে চার ঘণ্টা তাকে মারধর ও নির্যাতন করা হয়।

বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়। একপর্যায়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে নির্যাতন করা হয়। একটি ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করান ছাত্রলীগের নেত্রীরা। এই ঘটনা কাউকে জানালে তাকে জীবননাশ ও ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দেওয়া হয়।

ঘটনার পরদিন ভয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া হয় নিপীড়নের শিকার ওই ছাত্রী। ঘটনা এমনই ভয়াবহ ছিল। একটি ছাত্র সংগঠনের নেত্রীর বিরুদ্ধে এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সহজে মেনে নেওয়ার মতো নয়।

সাধারণ অনেক শিক্ষার্থীও নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমে ওই ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ করেছেন। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।

সবকিছুর বর্ণনা দেওয়ারও দরকার পড়ে না। শুধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে।

এছাড়া ছিনতাই, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘর্ষ এবং সিট বাণিজ্যসহ নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী পুরো সংগঠনকে বিব্রত করেছেন।আওয়ামী লীগের সভাপতি ছাত্রলীগকে পড়ালেখায় মনোযোগী হতে বলেছিলেন। সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ্যেই ছাত্রলীগের উদ্দেশ্যে সতর্কতামূলক বার্তা দিয়েছেন। অনিয়ম কিংবা সংঘাতপূর্ণ রাজনীতিতে না জড়াতে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

কিন্তু ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতাকর্মী এসবের কোনো পরোয়া করছেন না। এসব বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণে বিতর্কের মুখে পড়ছে দেশের আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রলীগ।

সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই এই ছাত্রসংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। ছাত্রলীগের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর নাম। কাজেই এই সংগঠনের হয়ে বিতর্কিত কাণ্ডে জড়ানো মানে বঙ্গবন্ধুকে অপমান করার চেষ্টা করা।

আমরা দেখেছি, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে তীব্র সমালোচনা হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে নামমাত্র সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিছুদিন পার হতেই এদের অনেককে দায়মুক্তি দিয়ে আবার সংগঠনে নিয়মিত করা হয়।

ছাত্রলীগের নাম বাংলাদেশের নানা অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছিল সেই সংগঠনের নেতারা, তাদের নাম উঠছে এখন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে।

ছাত্রলীগকে যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য কাজ করা উচিত সেখানে এই ছাত্র সংগঠন জড়িয়ে পড়েছে আধিপত্য বিস্তারে। প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে ব্যবহার হচ্ছে ক্ষমতার লাঠিয়াল হিসেবে।

ছাত্রলীগের নাম বাংলাদেশের নানা অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছিল সংগঠনটি। সেই সংগঠনের নাম উঠছে এখন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্রলীগ হওয়ার কথা ছিল নির্ভরতার নাম। অথচ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তা হয়ে উঠেছে আতঙ্কের নাম। ছাত্র সংগঠন হিসেবে যেখানে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে সরব হওয়ার কথা সেখানে উল্টো অধিকার হরণ করা হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এদেশের গ্রামের অনেক সাধারণ পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনা করে। ক্যাম্পাসে ছাত্রাবাসই তাদের ভরসা। একটু আরামে থাকা-ঘুমানো-পড়াশোনা করা তাদের অধিকার। সেই অধিকার কেন হরণ করা হচ্ছে? ছাত্রলীগ কেন নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর অত্যাচার করছে?

ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জন্য কি স্বাভাবিক পরিবেশ থাকবে না? ছাত্রদের ভরসা দেওয়ার বদলে আতঙ্ক কেন তৈরি করছে ছাত্রলীগের বিতর্কিতকাণ্ডে জড়িতরা?

আদিত্য আরাফাত ।। বিশেষ প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ