বঙ্গবন্ধু মানুষের সঙ্গে মিশছেন, মানুষের কাছ থেকে শিখছেন, তিনি হেঁটে রাজনীতি করেছেন, গরুর গাড়িতে চড়ে রাজনীতি করেছেন, রেলগাড়িতে চড়ে রাজনীতি করেছেন, সাইকেলে চড়েছেন, মানুষের পাশে থেকেছেন, মানুষের ভাষা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তার সাহিত্যগুলোও মানুষের জন্য রচিত। রাজনীতিবিদদের সাহিত্যের প্রতি এমন অনুরাগ খুবই ইতিবাচক।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা পোস্টকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক আমজাদ হোসেন হৃদয়

ঢাকা পোস্ট: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন তিনটি আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ভাবনাকে কীভাবে দেখেছেন?

ড. আতিউর রহমান: বঙ্গবন্ধু আজীবন অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, অসমাপ্ত আত্মজীবনীগুলোতেও বিষয়টি ফুটে উঠেছে। তিনি ১৯৪৬ সালে যখন দাঙ্গা হয় কলকাতায়, তখনও তার শিক্ষকরা বলেছেন, মুজিব নামে একজন ছাত্রনেতা আছেন, যিনি সবসময় আমাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। কোনো অবস্থাতেই যেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হয়, সে অনুযায়ী কাজ করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর যে তিনটি বই, সে তিনটি বইয়ের সাহিত্যমূল্য অসামান্য। তিনটি বই আমি ভালো করে পড়েছি, কাজে লাগিয়েছি আমার গবেষণায়। তিনি যে এতো সুন্দর করে বাংলা বলতে পারেন, এটি খুবই কম দেখা যায়।

ছোটবেলা থেকেই তিনি ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করতেন এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক জীবনেও তার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। তিনি মানবিক ছিলেন। সবাইকে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবেই দেখেছেন, মুসলিম না হিন্দু, এমন কোনো সাম্প্রদায়িক ভাবনা তার ছিল না। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শুরুতেই তিনি লিখছেন, একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র জাতি নিয়েই আমি ভাবি।

ঢাকা পোস্ট: দাঙ্গার সময়টা বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে পীড়া দেয়?

ড. আতিউর রহমান: দাঙ্গার সময়টা বঙ্গবন্ধুকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়। ১৯৫৪ সালে আদমজীতে যখন দাঙ্গা হচ্ছিল তখন তিনি দৌড়ে গিয়েছিলেন, মানুষ বাঁচানোর জন্য প্রাণপ্রণে চেষ্টা করছিলেন। অন্যদিকে ১৯৬৪ সালে যখন ঢাকায় দাঙ্গা হচ্ছিল তখন তিনি ওয়ারীতে দৌড়ে গিয়েছিলেন হিন্দুদের বাঁচানোর জন্য এবং রাতভর তিনি সেখানে কাটিয়েছেন। কয়েকদিন তিনি আন্দোলনের মধ্যে ছিলেন এবং বলেছিলেন আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের কোনো অবস্থাতেই যেন কেউ ক্ষতি করতে না পারে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও এই কথাটি এসেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যাতে না আগায়, সেজন্য তিনি সার্বক্ষণিক চেষ্টা করছেন।

ঢাকা পোস্ট: বঙ্গবন্ধুর সাহিত্য, স্মৃতিশক্তি কী বার্তা দেয়?

ড. আতিউর রহমান: আমি মনে করি বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে তিনি শুধু সাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত হওয়ার দাবিদার। তার যে তিনটি বই, সে তিনটি বইয়ের সাহিত্যমূল্য অসামান্য। তিনটি বই আমি ভালো করে পড়েছি, কাজে লাগিয়েছি আমার গবেষণায়। তিনি যে এতো সুন্দর করে বাংলা বলতে পারেন, এটি খুবই কম দেখা যায়। তিনি প্রচুর বই পড়তেন, তার বিশাল লাইব্রেরিও ছিল। আর স্মৃতিশক্তিও ছিল অসাধারণ, হাজার হাজার মানুষের নাম তিনি মনে রাখতে পারতেন। আত্মজীবনীগুলোতে তিনি অসংখ্য মানুষের নাম লিখেছেন। শুধু নিজের দলের লোকদের নাম মনে রাখছেন তাই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের লোকদের নামও মনে রেখেছেন, যা আত্মজীবনীগুলোতেও ফুটে উঠেছে।

ঢাকা পোস্ট: বঙ্গবন্ধু নিজে সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন, যার প্রমাণ মেলে আত্মজীবনীতে। একজন রাজনৈতিক নেতার সাহিত্যের প্রতি এমন অনুরাগ, বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

ড. আতিউর রহমান: এটা খুব কম রাজনৈতিক নেতার মাঝে দেখি। আমাদের উপমহাদেশে জওহরলাল নেহেরু ছিলেন, যিনি রাজনীতিবিদ হয়ে কারাগারে বসে লিখতেন এবং ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর যে তিনটি বই আমাদের হাতে পৌঁছেছে তার সাহিত্যমান অসাধারণ। এমন নান্দনিক বৈশিষ্ট্য অনেক নেতার আছে কি না সন্দেহ।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তিও ছিল অসাধারণ, হাজার হাজার মানুষের নাম তিনি মনে রাখতে পারতেন। আত্মজীবনীগুলোতে তিনি অসংখ্য মানুষের নাম লিখেছেন। শুধু নিজের দলের লোকদের নাম মনে রাখছেন তাই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের লোকদের নামও মনে রেখেছেন, যা আত্মজীবনীগুলোতেও ফুটে উঠেছে।

তিনি মানুষের সঙ্গে মিশছেন, মানুষের কাছ থেকে শিখছেন, তিনি হেঁটে রাজনীতি করেছেন, গরুর গাড়িতে চড়ে রাজনীতি করেছেন, রেলগাড়িতে চড়ে রাজনীতি করেছেন, সাইকেলে চড়েছেন, মানুষের পাশে থেকেছেন, মানুষের ভাষা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তার সাহিত্যগুলোও মানুষের জন্য রচিত। রাজনীতিবিদদের সাহিত্যের প্রতি এমন অনুরাগ খুবই ইতিবাচক।

ঢাকা পোস্ট: বঙ্গবন্ধু কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন?

ড. আতিউর রহমান: বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, তার স্বপ্ন ছিল একটি সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন। তেমন বাংলাদেশই আমরা পাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরে এক দশকে বাংলাদেশ অনেকটা পথ এগিয়েছে। এই মহামারির মধ্যেও জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর চেতনার সঙ্গে যেটা খানিকটা মেলে না সেটি হলো ‘দুর্নীতি’। তিনি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চেয়েছিলেন। বাংলাদেশে এখনো দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না, বিপুলভাবে দুর্নীতি হচ্ছে, স্বজনপ্রীতি আছে। অনেকক্ষেত্রে যোগ্য মানুষটি যোগ্য জায়গায় থাকতে পারছে না। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ পরিপূর্ণতা অর্জন করবে।

এইচ আর/বিডি