বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তব্যে প্রায়ই বলতেন, জনগণের শক্তির কথা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে একাধিকবার গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ বঙ্গবন্ধুর এই বিশ্বাস ছিল, দেশের মানুষের ভালোবাসা তার জন্য আছে। কারণ তিনি জনগণের অধিকারের জন্যই বছরের পর বছর আন্দোলন করেছেন। গণমানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রতি সত্যিকারের আগ্রহ থাকলেই একজন রাজনীতিবিদ অগণিত মানুষের মনে স্থান করে নিতে পারেন।

সেই রাজনীতিবিদের প্রতি জনগণের অনুরাগ তখন হয়ে ওঠে অকৃত্রিম। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাংলাদেশের অজস্র মানুষ প্রকাশ করেছিল গভীর ভালোবাসা আর আস্থা। প্রকৃত রাজনীতির রূপ অনুধাবন আর চর্চা করার মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু অর্জন করেছিলেন মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন।

তা-ই প্রকৃত রাজনীতি যেখানে রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য সচেষ্ট হন। এখানেই প্রকৃত রাজনীতি আর রাজনৈতিক পীড়নের পার্থক্য। কৌটিল্যের বিখ্যাত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে প্রকৃত শাসকের আচরণের বর্ণনায় লেখা হয়েছে― ‘প্রজার সুখে রাজার সুখ, প্রজার কল্যাণে রাজার কল্যাণ।’ প্রাচীন ভারতে রাজা বলতে প্রজার সেবকদেরই বোঝানো হতো। স্বৈরশাসনের কোনো চিন্তাই সেখানে ছিল না। আব্রাহাম লিঙ্কন বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতায় সেই সরকার ব্যবস্থার কথাই বলেছেন, যেখানে জনগণের গুরুত্ব সর্বাধিক। সাধারণ মানুষ থেকে দূরে থাকা নয়, বরং তাদের অধিকারের জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করার কারণেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল জনগণের সমর্থনের শক্তি, যার কারণে তৎকালীন জনবিচ্ছিন্ন শাসকরা বঙ্গবন্ধুর ওপর রুষ্ট ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকের ক্রোধ বঙ্গবন্ধুকে ভীত করতে পারেনি। তিনি বাঙালিদের ন্যায়সংগত অধিকারের জন্য কাজ করে গিয়েছেন। ক্ষমতাশালী সেনাশাসকদের সঙ্গে আপস করেননি, তাদের তোয়াজ করেননি। ফলে, তাকে বারবার যেতে হয়েছে কারাগারে। কিন্তু প্রকৃত রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ তাকে জুগিয়েছিল নৈতিক সাহস। পাকিস্তানি শাসনযন্ত্রের নিপীড়ন বাঙালিদের অধিকারের জন্য তার কাজ করার প্রেরণা মুছে ফেলতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল জনগণের সমর্থনের শক্তি, যার কারণে তৎকালীন জনবিচ্ছিন্ন শাসকরা বঙ্গবন্ধুর ওপর রুষ্ট ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকের ক্রোধ বঙ্গবন্ধুকে ভীত করতে পারেনি। তিনি বাঙালিদের ন্যায়সংগত অধিকারের জন্য কাজ করে গিয়েছেন।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে নিজের দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য বঙ্গবন্ধুর অবিচলভাবে কাজ করে যাওয়ার দৃষ্টান্তের কথা চিন্তা করে বর্তমান সময়ের রাজনীতিবিদদের আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। কেবল ক্ষমতাশালী কোনো শ্রেণির সুবিধা নয়, বরং সাধারণ জনগণের কল্যাণ এবং সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার সত্যিকারের রাজনীতি কি করা হচ্ছে বর্তমান সময়ে? ১৯৫৪ সালে কারাগারে থাকার সময় দুই বছর আগে চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, ‘আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।’

বঙ্গবন্ধুর এই মত একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করে। আলোচনা, বিতর্ক, যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি মজবুত করার জন্যই জরুরি। কারণ, একপেশে প্রচারণা কখনোই প্রকৃত রাজনীতির সঙ্গে খাপ খায় না।

ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদরা যদি জনগণের এই অধিকার নিশ্চিত করতে আগ্রহী না হন তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রকৃত রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর যদি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার কাঠামো ভেঙে ফেলা না হয়, তাহলে স্বাধীনতার সুফল গণমানুষ উপভোগ করতে পারবে না। পুরনো সময়ের মতো সমাজে টিকে থাকবে শোষণ আর সামাজিক অন্যায়। কার্ল মার্কস মনে করতেন, জনগণকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন না করেও একটি রাষ্ট্র স্বাধীন হতে পারে। বিখ্যাত রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ফ্রান্ত্‌জ ফাঁনো বলেছিলেন, তখনই ঔপনিবেশিকতা থেকে প্রকৃত অর্থে মানুষের মুক্তি ঘটবে, যখন পুরনো সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনার পাশাপাশি মৌলিক পরিবর্তন আনা হবে মানুষের চেতনায়। যখন সম্পূর্ণ ভিন্ন চেতনার নতুন মানুষ তৈরি করা সম্ভব হবে, ঔপনিবেশিকতার পরিপূর্ণ অবসান ঘটবে কেবল তখনই।

স্বাধীন রাষ্ট্র সর্বাঙ্গীণভাবে সফল করে তোলার জন্য শাসক এবং গণমানুষের মনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হওয়া জরুরি, বঙ্গবন্ধুও এমন মত প্রকাশ করেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দেশে যে অব্যবস্থা আর সমস্যা তৈরি হয়েছিল, সেই কারণে সরকারি নীতির সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, ‘তারা জানতো না, কী করে একটি জাগ্রত জাতিকে দেশের কাজে ব্যবহার করতে হয় এবং জাতিকে গঠনমূলক কাজে লাগানো যায়। এর একটা বিশেষ কারণ হলো, যাদের কাছে ক্ষমতা এলো তারা জনসাধারণের ওপর আস্থা রাখতে পারেন নাই। কারণ, জনসাধারণের সাথে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এরা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে শুরু করলেন ইংরেজ আমলের আমলাতন্ত্রের উপর।’

অসমাপ্ত আত্মজীবনী-তে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছিলেন, ‘স্বাধীন দেশের স্বাধীন জনগণকে গড়তে হলে এবং তাদের আস্থা অর্জন করতে হলে যে নতুন মনোভাবের প্রয়োজন ছিল তা এই নেতৃবৃন্দ গ্রহণ করতে পারলেন না।’

একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ হিসেবে সমাজের মঙ্গলের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রাধান্য দিয়েছিলেন মানুষের মনের উন্নয়ন। তিনি লিখেছিলেন, ‘জাতির নৈতিক পরিবর্তন ছাড়া ও সুষ্ঠু কর্মপন্থা ছাড়া দেশ থেকে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এই দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করা দরকার। নিরাপত্তা আইন যদি ব্যবহার করতে হয়, তবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে বোধ হয় জনসাধারণ এই নিরাপত্তা আইনের কোনো সমালোচনা করতো না।’

স্বাধীন দেশ জনগণের জন্য প্রকৃত অর্থে কল্যাণকর করে তুলতে হলে নতুন মানসিকতা আর নতুন ব্যবস্থা প্রয়োজন, সেই কথা বঙ্গবন্ধু লিখেছেন স্পষ্টভাবে: ‘জাতির আমূল পরিবর্তন না হলে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা কষ্টকর। নতুন করে সকল কিছু ঢেলে সাজাতে হবে। ভাঙা দালানে চুনকাম করে কোনো লাভ হয় না― বেশি দিন টেকে না। আবার ভেঙে পড়ে। পুরান দালান ভেঙে ফেলে দিয়ে নতুন করে গড়ে তুললে, ঘুণ ধরতে বা ভেঙে পড়তে অনেক সময় লাগে। সাথে সাথে ভিত্তিটা মজবুত করতে হয়। ভিত্তি মজবুত না হলে সামান্য বাতাসে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।’ একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ হিসেবে সমাজের মঙ্গলের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রাধান্য দিয়েছিলেন মানুষের মনের উন্নয়ন। তিনি লিখেছিলেন, ‘জাতির নৈতিক পরিবর্তন ছাড়া ও সুষ্ঠু কর্মপন্থা ছাড়া দেশ থেকে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এই দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করা দরকার। নিরাপত্তা আইন যদি ব্যবহার করতে হয়, তবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে বোধ হয় জনসাধারণ এই নিরাপত্তা আইনের কোনো সমালোচনা করতো না।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই কথাগুলো চিন্তা করে দেশের বর্তমান সময়ের রাজনীতিবিদরা আত্মসমীক্ষণে মনোযোগী হতে পারেন। জনগণের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের সম্পৃক্ততা কি এখন গভীর? পুরনো শোষণমূলক কাঠামো কি এখনও টিকে আছে? মানুষের মধ্যে নৈতিক পরিবর্তন আনার জন্য, অন্যায় এবং অন্ধচিন্তা প্রত্যাখ্যান করার মতো নতুন চেতনা মানুষের মনে সুদৃঢ় করার জন্য সচেতন এবং আন্তরিক উদ্যোগ কি গ্রহণ করা হচ্ছে? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ে এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হওয়া জরুরি।

ড. নাদির জুনাইদ ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়