ছবি : সংগৃহীত

৪ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার দিনটি শুরু হলো অমঙ্গলের খবর দিয়ে। সাহরি শেষে নগরবাসী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এই সময়েই আগুন লাগে বঙ্গবাজারে। ঢাকার ফুলবাড়িয়া এলাকার এই মার্কেটটি দেশজুড়েই জনপ্রিয়।

দেশের নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের প্রিয় ‘শপিং মল’ বঙ্গবাজার। বসুন্ধরা সিটি বা যমুনা ফিউচার পার্কের মতো চকচকে আধুনিক শপিং মলে যাদের প্রবেশের সামর্থ্য নেই, তারা বছর জুড়ে ভিড় করেন বঙ্গবাজারে। সস্তায় ভালো মানের পোশাক সামগ্রী পাওয়া যায় এখানে।

প্রবাসী বাংলাদেশিরাও দেশে এলে চেষ্টা করেন একবার হলেও বঙ্গবাজারে ঢুঁ মারার। শুধু দেশের মানুষ বা প্রবাসীরা নয়, বাংলাদেশে থাকা বিদেশিদের কাছেও বঙ্গবাজার প্রিয়।

আরও পড়ুন >>> শহর যেন মৃত্যুফাঁদ 

বঙ্গবাজার সারাবছরই জমজমাট থাকে। কিন্তু কোনো উৎসব এলে বঙ্গবাজারে পা ফেলাই কঠিন। আর এখন সামনে দেশের বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। তাই এখন বঙ্গবাজারের সব দোকান, গোডাউনে উপচেপড়া পণ্য। মুহূর্তেই সব ছাই হয়ে গেছে।

এই লেখা যখন লিখছি, তখনো ঠিক জানি না, বঙ্গবাজারে কীভাবে আগুন লেগেছে। ভোর ৬টা ১০ মিনিটে আগুন লাগে এবং দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবাজার মার্কেটের দোকানগুলো মূলত টিন ও কাঠ দিয়ে তৈরি। আর মার্কেটের মূল পণ্য কাপড়। ফলে আগুনের লেলিহান শিখা দ্রুতই গ্রাস করে নেয় পুরো মার্কেটটি।

প্রবাসী বাংলাদেশিরাও দেশে এলে চেষ্টা করেন একবার হলেও বঙ্গবাজারে ঢুঁ মারার। শুধু দেশের মানুষ বা প্রবাসীরা নয়, বাংলাদেশে থাকা বিদেশিদের কাছেও বঙ্গবাজার প্রিয়।

বঙ্গবাজার থেকে আগুনের সূত্রপাত হলেও একে একে লাগোয়া মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেটসহ পুরো কমপ্লেক্স পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পাশের এনেক্সকো টাওয়ার এবং আরও কিছু ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় আগুনে।

আরও পড়ুন >>> এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!

আগুন লাগতেই পারে। তবে সতর্কতা ও পূর্ব প্রস্তুতি ক্ষতির ভয়াবহতা কমাতে পারে। কিন্তু বঙ্গবাজারের আগুনে কিছুই কাজে আসেনি। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের মতো বিশাল ও ঘিঞ্জি শপিং এরিয়ায় আগুন নেভানোর নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।

বঙ্গবাজারের ঠিক উল্টো দিকেই ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর। খবর পাওয়ার সাথে সাথে ফায়ার সার্ভিস কাজে নেমে পড়ে। একে একে ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে নেমে পড়ে। যোগ দেয় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ। বঙ্গবাজারে লাগা আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল পুলিশ সদর দপ্তরের ব্যারাকে। এরই জেরে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল।

বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার আকাশ থেকে পানি ও পাউডার ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে। তারপরও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ৬ ঘণ্টা সময় লেগেছে। অনেকে আগুন নেভানোর বিলম্বের জন্য ফায়ার সার্ভিসকে দায়ী করেছেন।

বাংলাদেশের অনেক সেবা খাত নিয়ে হাজারটা অভিযোগ থাকলেও ফায়ার সার্ভিসের চেষ্টা ও আন্তরিকতা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তারা জীবন দিয়ে মানুষের সম্পদ ও জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পর্যাপ্ত পানির অভাবে ফায়ার সার্ভিস তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছিল না।

আরও পড়ুন >>> যেটা দিতে পারব না, সেটা কেড়ে নেওয়ারও অধিকার নেই 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের পুকুর থেকে লম্বা পাইপ দিয়ে পানি এনে আগুন নেভানোর কাজ করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত হাতিরঝিল থেকেও পানি নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার।

আমরা নগরীর সব জলাধার ভরাট করে ভবন বানিয়ে ফেলেছি। এখন আগুন নেভানোর জন্য পানি পাই না। প্রত্যেকবার আগুন লাগলে আরেকটা সমস্যা হয়। উৎসুক জনতার কারণে ফায়ার সার্ভিস তার দায়িত্ব পালন করতে পারে না।

আগুন একেবারে লাগবে না, তেমন গ্যারান্টি কেউই দিতে পারবে না। আমাদের চেষ্টা করতে হবে আগুন লাগলে যাতে তা দ্রুত নেভানো যায়, তার চেষ্টা করা।

১৯৯৫ সালের ভয়াবহ আগুনে একবার পুড়ে গিয়েছিল বঙ্গবাজার। ২০১৮ সালেও একবার আগুন লেগেছিল। তবে সেইবার বেশি ক্ষতি হয়নি। তার মানে বারবার আগুনেও বঙ্গবাজার এলাকার ব্যবসায়ীরা সতর্ক হননি।

প্রাথমিকভাবে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা রাখা। পানির উৎসব নিশ্চিত রাখা এবং ফায়ার সার্ভিসের কাজটা ঠিকমতো করতে দেওয়া। ফায়ার সার্ভিসকে পর্যাপ্ত পানি না দিয়ে, তাদের পথ আটকে রেখে তাদের অফিস ভাঙচুর করে লাভ হবে না।

আগুনের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে আমাদের সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। বঙ্গবাজারে এবারই প্রথম আগুন লাগেনি। ১৯৯৫ সালের ভয়াবহ আগুনে একবার পুড়ে গিয়েছিল বঙ্গবাজার। ২০১৮ সালেও একবার আগুন লেগেছিল। তবে সেইবার বেশি ক্ষতি হয়নি। তার মানে বারবার আগুনেও বঙ্গবাজার এলাকার ব্যবসায়ীরা সতর্ক হননি। আগুন প্রতিদিন লাগবে না। কিন্তু আমাদের সতর্ক থাকতে হবে প্রতিদিন। কারণ একবারের আগুন নিঃস্ব করে দেয় অনেককে।    

আরও পড়ুন >>> মরণ ফাঁদের নির্মাণকাজ 

টেলিভিশনে আগুনের লেলিহান শিখায় আমরা মার্কেট পুড়তে দেখেছি। আসলে পুড়েছে লাখো মানুষের স্বপ্ন ঈদের আনন্দ। ৫ হাজার দোকান পুড়েছে। মানে ৫০ হাজার পরিবার সর্বস্ব হারিয়েছে। এই ৫০ হাজার পরিবারের লাখো মানুষের জীবনে এবার ঈদের আনন্দ আসবে না।

আগেই যেমন লিখেছি, ঈদকে সামনে রেখে সব দোকানেই ছিল নতুন কাপড়, গোডাউন ছিল ঠাসা। প্রায় কিছুই উদ্ধার করা যায়নি। ঈদের আগে এই মার্কেট আবার চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর খুললেও নতুন করে আবার পণ্য তোলার সামর্থ্য থাকবে না বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর।

আগুন নিয়ে কয়েকদিনর মাতামাতির পর আমরা সবাই ভুলে যাবো। যেমন আমরা ভুলে গেছি সিদ্দিকিবাজারে আহত-নিহতদের। এই ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হবে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ী আর কর্মচারীদের।

সরকার যতই তাদের পাশে দাঁড়াক, যা ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করা কখনোই সম্ভব নয়। তবু আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই। স্বপ্ন পুড়ে যাওয়া মানুষগুলোর পাশে যেন দাড়াই আমরা সবাই।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ