ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর পানীয়জলের উৎসগুলো ক্রমেই ধ্বংস হচ্ছে। এক দিকে বেহিসাবি নগরায়ন, অন্যদিকে মানুষের অসচেতনতা। দুইয়ের জাঁতাকলে ঢাকায় ক্রমশ কমছে জলাশয়। বাস্তুতন্ত্র থেকে স্থানীয় জলবায়ু, সবকিছুতেই তার প্রভাব পড়ছে।

কখনো নিজের অজান্তে, কখনো আবার গুরুত্বহীন কারণে আমরা জলাশয়ের উপর অবিচার-অনাচার করে চলেছি। জলাশয় সংরক্ষণ না করলে পানি সংরক্ষণ অসম্ভব। ঢাকায় পানি ধারণের জায়গা কমে যাচ্ছে। প্রতি বছর পানির স্তর নিচে নামছে। এভাবে চললে আগামী প্রজন্ম সুপেয় পানি পাবে না।

নদী ভরাট, নাব্যতা হ্রাস ও দূষণের কারণে ছোট-বড় অনেক নদী বর্তমানে বিপন্ন। একসময়ের অপরূপ বুড়িগঙ্গা নদী আজ হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য। ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার পানি এক স্রোতে মিশে বুড়িগঙ্গা নদীর সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলার সুবাদার মুকাররম খাঁ তার শাসনামলে বুড়িগঙ্গা নদীর সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শহরের যেসব অংশ নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, সেখানে প্রতি রাতে আলোকসজ্জা করা হতো।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবাজারে আগুন : দোকান নয়, পুড়েছে লাখো মানুষের স্বপ্ন

এছাড়া নদীর বুকে অংসখ্য নৌকাতে জ্বলতো ফানুস বাতি। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি হতো। ১৮০০ সালে টেইলর বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন—‘বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে তখন দূর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো।’ তবে বুড়িগঙ্গার আগের ঐতিহ্য এখন আর নেই।

দখলদারের থাবা থেকে কোনোভাবেই মুক্তি মিলছে না ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর ঢাকার বুড়িগঙ্গা। দিন দিন দখল হয়ে নালায় পরিণত হচ্ছে নদীটি। কালের বিবর্তনে দখল হয়ে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গার নদী তীর। শুধু বুড়িগঙ্গা নয় অবৈধ দখলদারিত্ব আর দূষণে বিপন্ন হতে চলেছে তুরাগ নদী।

কালের পরিক্রমায় গতি হারাতে বসেছে তুরাগ। দখল-দূষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান চললেও পরিত্রাণ মেলেনি তুরাগের। নদীগুলোর পানিতে লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামসহ নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য অবমুক্ত হচ্ছে। এগুলো ভূগর্ভে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানির উৎসকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

দূষণের অন্যতম কারণ হলো কেউই নিয়ম মানেন না। পরিবেশবিদদের মতে, নদীগুলো বাঁচাতে হবে। দূষণ শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতে হবে। হাজার হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়া যাবে, কিন্তু একটি নদী সৃষ্টি করার সামর্থ্য কারও নেই; যা সৃষ্টি করা যায় না, তা ধ্বংস করা যাবে না। নদ-নদীর সুরক্ষা ও সংরক্ষণে মনোযোগী হতে হবে।

কালের পরিক্রমায় গতি হারাতে বসেছে তুরাগ। দখল-দূষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান চললেও পরিত্রাণ মেলেনি তুরাগের। নদীগুলোর পানিতে লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামসহ নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য অবমুক্ত হচ্ছে।

জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে প্রত্যন্ত গ্রামেও জলাশয় ভরাট করে তৈরি হচ্ছে বসতি, নয়তো কৃষি জমি। জলের অভাবে সংকটাপন্ন জলাভূমি ও তার জীববৈচিত্র্য, ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। ইতিমধ্যে ঢাকা ও এর আশেপাশে জলাভূমি, নিম্নাঞ্চল ও কৃষি জমি ভরাট হয়েছে ৯০ শতাংশ। জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের জীবনযাত্রা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

আরও পড়ুন >>> শহর যেন মৃত্যুফাঁদ 

ঢাকায় বর্তমানে মাত্র কয়েকটি জলাশয় টিকে আছে গোটা শহর জুড়ে। এর মধ্যে অন্যতম হাতিরঝিল লেক, ধানমন্ডি লেক, গুলশান-বারিধারা লেক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লেক, উত্তরা লেক এবং মিরপুরের চিড়িয়াখানা ও উদ্ভিদ উদ্যান লেক।

ঢাকা শহরের ইতিহাস যদি দেখি, ১৯২৪ সালের দিকে ব্রিটিশ মানচিত্রে ১২০টির মতো পুকুরের উপস্থিতি দেখা যায় (বর্তমান পুরান ঢাকা)। আজকে ২০২৩ সালে মাত্র ২০টির মতো এমন পুকুর টিকে আছে, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শহরের ইতিহাস। ঢাকা শহরে খালের সংখ্যা কমতে কমতে এখন ২২টির মতো টিকে আছে, তাও খুব সংকুচিত আকারে।

আশঙ্কা করা হয়েছে, জলাশয় ভরাটের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে। ১৯৭৮ সালে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৫২ হেক্টর আর নিম্নভূমি ছিল ১৩ হাজার ৫২৮ হেক্টর। একই সময়ে খাল ও নদী ছিল ২ হাজার ৯০০ হেক্টর।

রাজধানীর বৃষ্টির পানি এসব খাল দিয়েই পড়েছে নদীতে। ২০১৪ সালে ঢাকা ও আশপাশে জলাভূমি কমে হয়েছে ১ হাজার ৯৩৫ হেক্টর, নিম্নভূমি ৬ হাজার ১৯৮ হেক্টর এবং নদী-খাল ১ হাজার ২ হেক্টর। অর্থাৎ ৩৫ বছরে জলাশয় কমেছে ৩৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এই সময়ের ব্যবধানে নিম্নভূমি কমেছে ৫৪ দশমিক ১৮ এবং নদী-খাল ৬৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

এই বিপুল সংখ্যক জলাশয় হারিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ নগরায়ন। উন্নত দেশে আধুনিকভাবে বিল্ডিংয়ে ওয়াটার রিজার্ভার থাকে ও বৃক্ষ রোপণের ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশে তা মানা হচ্ছে না।

আরও পড়ুন >>> এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!

অপরিকল্পিত নগরায়নের পাশাপাশি একাধিক কারণ এই সংকটের পেছনে। প্রথমত, পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই তা অপরিষ্কার অবস্থায় পড়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, মানুষ ততটা সচেতন নয়। এলাকার পুকুর ভরাট হলে যে গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠার কথা, সেটা তেমন দেখা যায় না।

একটি শহরে যদি জলাভূমি না থাকে, বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থেকে নগরবাসী কীভাবে রক্ষা পাবে? শহরের পানি সংকট নিরসন ও জলাবদ্ধতা রোধে জলাশয়, খাল-বিল, নদী-নালার গুরুত্ব অপরিসীম।

অথচ পুকুর ভরাট করলে পরিবেশের যে কী বিপুল ক্ষতি তা অজানা নয়। পুকুর ভরাট মানে বাস্তুতন্ত্রের ইতি ও জলজ প্রাণীরও বিলুপ্তি। ক্ষতি হচ্ছে আমাদেরও। জলাশয়গুলোর উপর স্থানীয় জলবায়ু নির্ভর করে। পুকুর ভরাট হওয়ার কারণে সেই ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি কমে আসছে। তার ওপর ভূপৃষ্ঠের জলও উধাও হয়ে গেলে ভবিষ্যৎ খুব খারাপ।

এখন বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে, পাশাপাশি পুকুর ভরাট ও হচ্ছে। কিন্তু আমরা সচেতন হচ্ছি না। ঢাকা শহরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেই আমাদের মনে পড়ে, এই নগরে যেসব পুকুর ছিল, সেগুলো গেল কোথায়!

জলাশয় সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে প্রশাসনের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। আমাদের কিছু আইন আছে জলাধার রক্ষায়। কিন্তু সেগুলো আমরা কেউ মানি না। জলাশয় সংরক্ষণ করতে হবে। পানির মান ঠিক রাখতে হবে। তার চারপাশে সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজ করা দরকার। তা হলে এলাকার মানুষেরও পুকুরের প্রতি মমত্ববোধ বাড়বে। একেবারে আলাদা একটা সংস্থা দরকার যা শুধু জলাশয়ের দেখাশোনা করবে।

আরও পড়ুন >>> যেটা দিতে পারব না, সেটা কেড়ে নেওয়ারও অধিকার নেই 

ঢাকার বিপন্ন জলাধারের কারণে জলাবদ্ধতা অসহনীয় পর্যায়ে। এই সমস্যার সমাধানে কিছু কাজ করা যেতে পারে। প্রথমেই নগরের নালা-নর্দমা ও খালগুলো দখলমুক্ত করতে হবে। অবৈধ সব স্থাপনা অপসারণ করলে পানি নিষ্কাশন দ্রুত ও সহজ হবে। জলাবদ্ধতা কমাতে সংক্ষিপ্ত, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। মধ্যবর্তী পরিকল্পনায় জলাশয় দখলমুক্ত করতে ভূমি চিহ্নিত করতে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী কাজে লাগানো যেতে পারে।

হাজার হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়া যাবে, কিন্তু একটি নদী সৃষ্টি করার সামর্থ্য কারও নেই; যা সৃষ্টি করা যায় না, তা ধ্বংস করা যাবে না। নদ-নদীর সুরক্ষা ও সংরক্ষণে মনোযোগী হতে হবে।

খাল উদ্ধার করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলেও শুধু খাল উদ্ধার করেই রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব হবে না। ইট পাথর আর কংক্রিট কমিয়ে বৃষ্টির পানি শোষণের জন্য প্রয়োজন সবুজায়ন ও জলাশয়। তার ওপরেও জোর দিতে হবে।

নালা-নর্দমা ও খালে যাতে কেউ আবর্জনা ফেলতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে। অবশ্য এসব কাজ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আইনি সহযোগিতা দিতে হবে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়গুলো সক্রিয় ও দায়বদ্ধ করতে হবে। এসব কাজ করা গেলে জলাবদ্ধতা যখন সহনীয় পর্যায়ে আসবে, তখন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের সুযোগ পাওয়া যাবে। দেশে জলাভূমি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত নীতিমালা করা দরকার। বিপন্ন জলাশয়কে বাঁচাতে মাস্টার প্ল্যান করে তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

দিন দিন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে একদিকে যেমন জলাভূমির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে, ঢাকা হারিয়েছে তার মূল্যবান জীববৈচিত্র্য। যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে রাজধানীর সার্বিক পরিবেশের উপর।

আরও পড়ুন >>> মরণ ফাঁদের নির্মাণকাজ 

পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতার শিকার হচ্ছে এখানে বসবাসকারী মানুষ। ঢাকার পরিবেশের এই বিরূপ আচরণ মনুষ্য সৃষ্ট। পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রকৃতি সুরক্ষায় এখনই উদ্যোগী না হলে অচিরেই বাসযোগ্যতা হারাবে ঢাকা। তাই যে জলাশয়গুলো এখনো টিকে আছে, সেগুলো রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে।

জলজ দূষণ রোধের পাশাপাশি জলাশয়ে আয়তন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।  মানুষকে সচেতন করা গেলেই কেবল পরিবেশ সুরক্ষা পাবে। পরিবেশ ধ্বংস করে দেশের কোনো টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই সত্যকে মাথায় রেখেই সকলকে জলাশয়গুলোর সুরক্ষা ও সংরক্ষণে মনোযোগী হতে হবে।

ড. মো. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। অধ্যাপক ও গবেষক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
khasru73@juniv.edu