বাঙালির একটা বহুল প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, ‘গরিবের সুন্দরী বৌ সকলের বৌদি’। প্রবাদবাক্যটি শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এর মধ্যে নির্মম বাস্তবতা রয়েছে। বাংলা পঞ্জিকাকে নিয়ে কয়েক দশকে যেভাবে অহেতুক উদ্ভট টানাহেঁচড়া কাটাছেঁড়া হয়েছে এবং সেই ধারাবাহিকতায় আজও হচ্ছে, তাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের শুধু এই প্রবাদ বাক্যের কথায় মনে আসে বারবার। এক্ষেত্রে অবশ্য সাধারণ মানুষের কিছুই করার নেই। তাদের মনে শুধুই কিছু প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায়।

এত টাকা খরচ করে সহস্র বছরের আবহমানকালের বাংলা পঞ্জিকাকে কেন ঘনঘন পরিবর্তন করা হচ্ছে? এর সদুত্তর অধিকাংশের কাছেই নেই। কী জন্য পরিবর্তন করা হচ্ছে এবং কাদের কল্যাণের জন্যে পরিবর্তন করা হচ্ছে এর সদুত্তরও সাধারণ মানুষের কাছে নেই। পঞ্জিকা সংস্কার প্রসঙ্গে তাদের বিভিন্ন বক্তব্য এবং বিবৃতি দেখলে বোঝা যায়, তাদের কথাগুলো সুনির্দিষ্ট নয়, কেমন ধোঁয়াশা আলো-আঁধারি কথাবার্তা।

আবহমান বাংলার পঞ্জিকা যারা কাটাছেঁড়া করে অনৈতিক পরিবর্তন করছেন, তাদের কাছে হয়তো এই পরিবর্তনের কোনো যৌক্তিক সদুত্তর আছে বা থাকতে পারে। কিন্তু দেশের সাধারণ বাঙালির কাছে এই বিষয়টি শুধুমাত্র, ক্ষমতার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের একগুঁয়েমি এবং ক্ষমতার প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়।

আরও পড়ুন >>> মিলিত প্রাণের কলরবে ‘সংক্রান্তি ও বৈশাখ’ 

কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তি অধ্যাপক, গবেষক নাম ধারণ করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা, বাঙালির বিভাজন এবং নিজেকে ইতিহাসে যুক্ত করার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই বাংলা বর্ষপঞ্জি ঘনঘন পরিবর্তন করে চলছে বলা যায়। আপনাদের যদি এতই পরিবর্তনের ইচ্ছে, তবে বৈদেশিক গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা বা আরবীয় হিজরি পঞ্জিকা তো সামান্য একটু সংস্কারের নামে কাটাছেঁড়া করার প্রচেষ্টা নিয়ে দেখতে পারেন।

হিজরি পঞ্জিকা চান্দ্র মাসকে অনুসরণ করায় এই পঞ্জিকাকে ৩৫৪/৩৫৫ দিনে বছর হয়। যা সৌরবছর, ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে বছরের থেকে ১১ দিন বা ১০ দিনের পার্থক্য। হিজরি পঞ্জিকায় একই মাস বিভিন্ন ঋতুতে বারেবারে ঘুরে ঘুরে আসে। এই বর্ষপঞ্জির সাথে বাংলা বা ইংরেজি বর্ষপঞ্জির মতো সুনির্দিষ্ট কোনো ঋতুচক্র নেই।

বাংলাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকা সংস্কারের দায়িত্বে সর্বদাই নেতৃত্বে ছিল বাংলা একাডেমি। প্রতিষ্ঠানটি বাংলা বর্ষপঞ্জিকা সংস্কারের জন্য ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ নামে একটি কমিটি গঠন করে।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনসহ আরও অনেক জাতীয় দিনকে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার জন্য যদি বাংলা পঞ্জিকা পরিবর্তন করতে হয়, তবে যারা বাংলা পঞ্জিকা বারেবারে সংস্কার করছেন তাদের উদ্দেশ্যে দুটি কথা বলতে চাই—বাংলা এবং ইংরেজি বর্ষপঞ্জির দিনের মধ্যে ১ দিনের সামান্য পার্থক্য হয়। কিন্তু হিজরি পঞ্জিকায় পার্থক্যটা অনেকদিনের। বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে বললে পরিষ্কার হবে।

ধরুন, আজ ১৪ এপ্রিল আমার জন্মদিন, তবে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে আগামী বছর আমার জন্মদিন পালিত হবে ১১ দিন পূর্বে, ৩ এপ্রিল। পরের বছর জন্মদিন হবে আরও ১১+১১ = ২২ দিন পূর্বে। এরপরের বছর হবে ১১+১১+১১ = ৩৩ দিন বা একমাস পূর্বে। এমন করে করে একটি মাস, একটি বছরের পর্যন্ত পার্থক্য চলে আসে।

আরও পড়ুন >>> সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ 

হিজরি বর্ষপঞ্জির মাসগুলো এভাবে সারাবছর প্রত্যেকটি ঋতুতে ঘুরতে থাকে। ইংরেজিতে জানুয়ারি মাসের কথা আসলেই আমাদের মনে হয় প্রচণ্ড শীতের কথা। বাংলা জ্যৈষ্ঠমাস বললেও আমাদের মনোজগতে প্রচণ্ড গরমের তীব্রতার একটি ছবি ভেসে উঠে। কিন্তু হিজরি বর্ষপঞ্জির মাসগুলোয় সুনির্দিষ্ট এমন কোনো ঋতুচক্রই নেই। তাহলে এই পঞ্জিকা সংস্কারে কেন আপনারা উদ্যোগী হচ্ছেন না।

প্রথমত এটি বৈদেশিক পঞ্জিকা, দ্বিতীয় কারণ হলো সেই পঞ্জিকা প্রসঙ্গে সংস্কার শব্দটি উচ্চারণ করলেও বিপদ আছে। পক্ষান্তরে অভাগা বাংলা মায়ের বুকে যতই কাটাছেঁড়া করা হোক, দিনশেষে সেই বঙ্গজননী সর্বংসহা ক্ষমাসুন্দরী মূর্তি।

আবহমান বাংলার পঞ্জিকাটি সূর্যের দ্বাদশ রাশিতে পরিভ্রমণের সাথে যুক্ত। তাই পঞ্জিকাটি অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত। পৃথিবীর চতুর্দিকে দ্বাদশ সংখ্যক নক্ষত্রপুঞ্জ রয়েছে তাদেরই রাশি বলা হয়। এই দ্বাদশ রাশি হলো—মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ এবং মীন।

পৃথিবী থেকে যে নক্ষত্র রাশিকে যেমন দেখা যায়, সেই অনুসারে তাদের নামকরণ করা হয়েছে। পৃথিবী থেকে যে নক্ষত্ররাশিকে অনেকটা মেষ বা ভেড়ার মতো দেখতে মনে হয় তাকে ‘মেষরাশি’ বলা হয়। একইভাবে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য রাশিগুলোরও নামকরণ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি রাশি একেকটি মাস এবং সূর্যের পরিভ্রমণের পথচক্রের সাথে যুক্ত।

সূর্য মেষ রাশিতে গমন করলে বৈশাখ মাস হয়। এইভাবে সূর্যের দ্বাদশ রাশিচক্রে পরিভ্রমণের ফলে দ্বাদশ মাস হয়। পঞ্জিকায় পুরুষোত্তম মাস বা মলমাস নামে আরও একটি অধিক ত্রয়োদশ মাস রয়েছে। চান্দ্র ও সৌর পঞ্জিকার সামঞ্জস্য বিধানের জন্য প্রতি তিনবছর অন্তর অন্তর এই ত্রয়োদশ মাসটির আগমন ঘটে। অর্থাৎ বাংলা পঞ্জিকাটি সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে যুক্ত, তাই ঘরে বসে কাগজে কলমে এই পঞ্জিকাকে কাটাছেঁড়া করে নববর্ষের দিন ১৪ এপ্রিল নির্দিষ্ট করে দেওয়াটা সম্পূর্ণভাবে অনৈতিক, অযৌক্তিক এবং বালখিল্যতাপূর্ণ আচরণ।

আরও পড়ুন >>> বৈশাখী মেলা : পূর্বাপর 

এই ভূখণ্ডে সংবৎসরকালের হিসাব কোনো নতুন বিষয় নয়। বৈদিক যুগ থেকেই প্রচলিত। বৈদিক পরম্পরা থেকেই দিন, পক্ষ, মাস  এবং সংবৎসরকালের পরিমাপটি বৃহত্তর ভারতবর্ষের প্রায় সব পঞ্জিকায় প্রবেশ করেছে। বাংলা পঞ্জিকাও এর ব্যতিক্রম নয়।

‘সংবৎসরোঽসি পরিবৎসরোঽসীদাবৎসরোঽসী—দ্বৎসরোঽসি বৎসরোঽসি।
উষসস্তে কল্পন্তামহোরাত্রাস্তে কল্পন্তামর্ধমাসাস্তে কল্পস্তাং মাসাস্তে কল্পন্তামৃতবস্তে কল্পন্তাং সংবৎসরস্তে কল্পতাম্।
প্ৰেত্যা এত্যৈ সং চাঞ্চ প্র চ সারয়।
সুপর্ণচিদসি তয়া দেবতয়াঽঙ্গিরস্বদ্ ধ্রুবঃ সীদ।।’
(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা : ২৭.৪৫)

অর্থাৎ ‘হে অগ্নি, তুমি সংবৎসর, পরিবৎসর, ইদাবৎসর, ইদ্বৎসর ও বৎসররূপ। সকাল, দিন-রাত, অর্ধমাস, পক্ষ, মাস, ঋতু ও সংবৎসর প্রভৃতি তোমার অবয়বরূপে যোগ্য হোক। তুমি স্বেচ্ছায় আসা, যাওয়া, সঙ্কোচন ও প্রসারণ করো। তুমি সুপর্ণের মতো গৃহীত হও, তুমি বাক্যের সাথে প্রাণের মতো স্থির হয়ে যাও।’

যদিও বাংলা পঞ্জিকা সুপ্রাচীনকাল থেকে বৈদিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপরে দণ্ডায়মান। এরপরেও অপ্রয়োজনীয় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাংলা পঞ্জিকা সংশোধনের প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন থেকেই চলছে।

বাংলাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকা সংস্কারের দায়িত্বে সর্বদাই নেতৃত্বে ছিল বাংলা একাডেমি। প্রতিষ্ঠানটি বাংলা বর্ষপঞ্জিকা সংস্কারের জন্য ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ নামে একটি কমিটি গঠন করে।

আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়

এই কমিটির সংস্কারের প্রধান বিষয়গুলো ছিল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিনের পরিধি মাপের প্রচলিত রীতি পরিবর্তন করে গ্রেগরিয়ান বা খ্রিস্টিয় রীতি অনুসরণ করে রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে দিনের সূচনাকাল হিসেবে গণ্য করা। অথচ প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে একটি দিন শুরু হওয়ার রীতি। অধিবর্ষে চৈত্রমাসে ৩১ দিনের কথা বলা হয়। তবে এই কমিটির সুপারিশে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ গণনার ক্ষেত্রে ছিল প্রচণ্ড জটিলতা।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পণ্ডিত ব্যক্তি হয়েও, তার থেকে ভিন্ন পরিমণ্ডলের বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা ছিল অ্যাস্ট্রোনমির বিষয়। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকারের আমলে করা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ কমিটির সুপারিশ কোনো সরকারই কার্যকর করেনি।

১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, পাকিস্তান আমলে করা সংস্কারকৃত পঞ্জিকা যা এতকাল খাতাবন্দি ছিল, সেই পঞ্জিকাকে মুক্ত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিলে সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়।

হিন্দু, বৌদ্ধ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া পঞ্জিকাকে অনুসরণ না করে আবহমান পঞ্জিকাকেই অনুসরণ করে চলে। এর ফলে বাঙালির পহেলা বৈশাখ আজ ১৪ এপ্রিল এবং ১৫ এপ্রিলে দুইদিনে অনুষ্ঠিত। শুধু প্রতি তিনবছর পরে অধিবর্ষের কারণে ১৫ এপ্রিল উভয় পঞ্জিকাতেই একই সাথে নববর্ষ অনুষ্ঠিত হয়।

পাকিস্তান সরকার চেয়েছিল বাঙালির ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে বিভাজিত করতে। বাঙালি যেন খণ্ডবিখণ্ড থাকে, বিচ্ছিন্ন থাকে। তাদের সেই বাঙালি বিভাজনের স্বপ্নটি বাস্তবায়িত হয় স্বাধীন দেশে ১৯৮৭ সালে।

১৯৯৫ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হারুন-উর-রশিদকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। সেই কমিটি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কমিটির মূল সুপারিশের নিরিখে সেই বছরের ২৯ আগস্ট তাদের ২০টি সুপারিশ পেশ করে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চৈত্র মাসের পরিবর্তে ফাল্গুন মাসকে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষের মাস হিসেবে নির্ধারণ। যা এখন পর্যন্ত অনুসরণ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন >>> উৎসবের সর্বজনীন অর্থনীতি 

আবারও আরেক দফা বর্ষপঞ্জির পরিবর্তন করা হয় ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। এজন্য বাংলা একাডেমির পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি এক সভার আয়োজন করে। এই সভায় অধ্যাপক ড. অজয় রায়ের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, অধ্যাপক জামিল চৌধুরী, অধ্যাপক আলী আসগর প্রমুখ।

পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদের দ্বিতীয় সভায় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি বিভিন্ন সুপারিশ প্রদান করে। বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম ছয় মাস বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত ৩১ দিনে গণনা করা হবে। এছাড়া কার্তিক থেকে মাঘ এবং চৈত্র মাস ৩০ দিনে গণনা করা হবে। শুধু ফাল্গুন মাস ২৯ দিনে গণনা করা হবে। তবে ইংরেজি বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ২৯ দিনের পরিবর্তে ৩০ দিনে গণনা করা হবে।

সংশোধনের ফলে ১৪২৩ বঙ্গাব্দ থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বাংলা তারিখ হবে ৮ ফাল্গুন; ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের বাংলা তারিখ ১২ চৈত্র; ৮ মে রবীন্দ্রজয়ন্তী ২৫ বৈশাখ; ২৫ মে নজরুলজয়ন্তী ১১ জ্যৈষ্ঠ এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের বাংলা তারিখ হবে ১ পৌষ।

১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকারের সময় থেকে শুরু করে ১৯৮৭, ১৯৯৫, ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা পঞ্জিকার বড় ধরনের পরিবর্তন করায় পরেও সন্তুষ্ট নয় এই পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি। তারা ২০১৯ সালে এসেও আবার বাংলা পঞ্জিকা পরিবর্তন করার সুপারিশ করে বাংলা একাডেমির উল্লেখিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি।

দেশের চৌদ্দশত বছরের পঞ্জিকাকে স্বল্প সময়ে এত ঘনঘন পরিবর্তনে আমাদের মতো অধিকাংশ সাধারণ মানুষই হতাশ। তাই ২০১৯ সালের পঞ্জিকা সংস্কারের খোঁজখবর নেওয়ার আমি প্রয়োজন বোধ করিনি। যারা পরিবর্তন করছে তাদের মাথায় রাখা উচিত বাঙালি মানেই শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাঙালি না। আমাদের এমন কিছুই করা ঠিক হবে না যাতে সারা পৃথিবীর বাঙালিদের সাথে আমাদের যোগসূত্রটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, পাকিস্তান আমলে করা সংস্কারকৃত পঞ্জিকা যা এতকাল খাতাবন্দি ছিল, সেই পঞ্জিকাকে মুক্ত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিলে সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়।

বাংলাদেশ ছাড়াও, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এই দুটি প্রদেশে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ। আসাম, ঝাড়খণ্ডে দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি। এর বাইরে ভারতের অন্যান্য প্রদেশসহ লন্ডন, নিউইয়র্কে কোটি কোটি বাঙালি আছে। আমরা বাংলা পঞ্জিকাকে যাই পরিবর্তন করি তা ভৌগোলিকভাবে অবস্থিত সব স্থানের বাঙালিকে যুক্ত করেই তবে করতে হবে। নচেৎ এটা হবে, ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’—এই বাক্যটির মতো বৃথা প্রয়াস।

আরও পড়ুন >>> নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায় 

আজ বাঙালির দুই নয়নমণি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম বছরে দুইবার জন্মগ্রহণ করছে। দুই বাংলায় দুইদিন তাদের জয়ন্তী উৎসব পালিত হচ্ছে। আজ দুই বাংলায় দুইদিনে চৈত্রসংক্রান্তি পালিত হচ্ছে, দুইদিন নববর্ষ পালিত হচ্ছে, দুইদিন পৌষপার্বণ পালিত হচ্ছে, দুইদিন বসন্ত উৎসব পালিত হচ্ছে, দুইদিন বাঙালির সব সর্বজনীন উৎসব পালিত হচ্ছে। বাঙালির জীবনে এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে?

এই লজ্জা থেকে পরিত্রাণ যদি আমরা চাই, তবে সব বাঙালির ঐক্যবদ্ধভাবে বিজ্ঞানসম্মত পঞ্জিকা সংস্কার করতে হবে। না হয় হাজার বছরের পুরনো চলমান পঞ্জিকায় ফেরত যেতে হবে। নচেৎ হিন্দুর পঞ্জিকা-মুসলিমের পঞ্জিকা অথবা এপার বাংলার পঞ্জিকা-ওপার বাংলার পঞ্জিকা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে এবং রূপে সমান্তরাল তুষের আগুন চলতেই থাকবে, জ্বলতেই থাকবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৭ সালে ইমন কল্যাণ রাগে বৈশাখ আহ্বান করে বলেছেন, সব মুমূর্ষুরে উড়িয়ে দিয়ে, সব আবর্জনা বিদূরিত করে, সব গ্লানি, সব জরা ঘুচিয়ে দিয়ে পৃথিবীকে অগ্নিস্নানে শুদ্ধ করে হে বৈশাখ তুমি আমাদের মাঝে আগমন করো।

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে   মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
     বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি,   যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
     অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
     মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
     অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানের মতো আমরাও চাই পহেলা বৈশাখ যেন বাঙালির পঞ্জিকা বিভাজন, সব ধরনের বিভাজনকে অপসৃত করে আমাদের মাঝে আগমন করে। নববর্ষে হোক নব সুচিন্তার অরুণোদয়। বিদূরিত হোক সব বিভেদ, বিভাজন এবং সংকীর্ণতা।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়