ছবি : সংগৃহীত

১৮ এপ্রিল ২০২৩। ঢাকা। বিকাল চারটা। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অনুভূত হচ্ছে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কয়েকদিন ধরে তীব্র তাপপ্রবাহে নাকাল ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষ। এখনই এর থেকে রেহাই মিলবে না।

এদিকে, ১৫ এপ্রিল ২০২৩, ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তপ্ত দিন পার করল রাজধানীবাসী। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বেলা তিনটা পর্যন্ত ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাশাপাশি বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় গরমের আঁচ আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে। (প্রথম আলো, ১৫ এপ্রিল ২০২৩)

ঢাকার পাশাপাশি ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলায় এই তাপপ্রবাহ বইছে। তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।

আরও পড়ুন >>> উন্নয়ন প্রকল্প কি বায়ু দূষণের কারণ? 

টানা ১৫ দিন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। চলতি মৌসুমে টানা ১৩ দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হওয়া চুয়াডাঙ্গায়। এই জেলায় রেকর্ড করা হয়েছে ৪২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। যা সারা দেশের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে পাবনার ঈশ্বরদীতে। (ঢাকা পোস্ট, ১৭ এপ্রিল ২০২৩)

মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমাদের মস্তিষ্কের তাপ নিয়ন্ত্রক সবসময় এই তাপমাত্রা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে...

বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ তরিফুল নেওয়াজ কবির জানিয়েছেন, ১৯৬৫ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর আগে ১৯৬০ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠেছিল ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ১৯৭৫ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেটাই এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে রেকর্ড। এই খরতাপে অতিষ্ঠ জীবন, নাকাল স্বাস্থ্য।

মানুষ তাপমাত্রার পরিবর্তন সইতে পারে, কিন্তু তার একটা সীমা আছে। অতি নিম্ন তাপমাত্রায় মানুষ হাইপোথার্মিয়া (Hypothermia)-এর ঝুঁকিতে পড়ে, ঠিক তেমনি অতি উচ্চ তাপমাত্রায় মানুষের জীবনও ঝুঁকিতে পড়ে।

মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমাদের মস্তিষ্কের তাপ নিয়ন্ত্রক সবসময় এই তাপমাত্রা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে। কোনো ফ্যান বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছাড়া এই তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য আমাদের পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা হওয়া দরকার ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আরও পড়ুন >>> আধিপত্য নয়, বন্ধুত্ব করি প্রকৃতির সঙ্গে 

আর্দ্রতার সাথে তাপমাত্রার অনুভবের তারতম্য ঘটে, আর্দ্রতা বেশি হলে বেশি গরম অনুভূত হবে। কোনো জায়গায় তাপমাত্রা ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর আর্দ্রতা শূন্য হলে অনুভূতি হবে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু ওই জায়গায় আর্দ্রতা ৮০ শতাংশ হলে, অনুভূতি হবে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

অতি উচ্চ তাপে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। নিম্নে তা দেওয়া হলো—

পানি স্বল্পতা: উচ্চ তাপমাত্রায় আমাদের শরীর থেকে স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে ঘামের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায়, তার ফলে শরীরে পানি স্বল্পতা দেখা যায়। 

হিট ক্রাম্প: দীর্ঘক্ষণ উচ্চ তাপমাত্রায় থাকলে মাংসে ক্রাম্প বা খিঁচুনি হতে পারে। সাধারণত পা ও পেটের মাংসে এই ক্রাম্প হয়ে থাকে। অতিরিক্ত ঘামে শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যাওয়ায় এইরূপ হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন >>> মরণ ফাঁদের নির্মাণকাজ 

তাপবিধ্বস্ত: শরীর উত্তপ্ত হয়ে যদি ঠান্ডা না হতে পারে, তাহলে তাপবিধ্বস্ত হতে পারে। এর লক্ষণগুলো হচ্ছে অত্যধিক ঘাম, দুর্বলতা, মাথা ব্যথা, বমিভাব ও মাথা ঘোরা।

তাপজনিত অসুস্থতার মধ্যে হিটস্ট্রোক হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক, যা জীবন সংশয়ের কারণ হতে পারে। তখন শরীরের তাপমাত্রা মস্তিষ্কের তাপ নিয়ন্ত্রকের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়....

হিটস্ট্রোক: তাপজনিত অসুস্থতার মধ্যে হিটস্ট্রোক হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক, যা জীবন সংশয়ের কারণ হতে পারে। তখন শরীরের তাপমাত্রা মস্তিষ্কের তাপ নিয়ন্ত্রকের আয়ত্তের বাইরে চলে যায় এবং শারীরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়াগুলো অকার্যকর হতে থাকে। রোগী ভুল বকতে থাকে, খিঁচুনি, জ্ঞান হারানো এবং অর্গান সমূহ অকার্যকর হতে থাকা।

শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা: উচ্চ তাপমাত্রা হাঁপানি ও শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি অবস্ট্রাকটিভ রোগ সমূহ (সিওপিডি) বাড়িয়ে তুলতে পারে।

চামড়ার সমস্যা: অত্যধিক তাপমাত্রায় চামড়ায় গুটিগুটি ওঠা, ফোস্কাপড়া ও চুলকানির মতো নানা সমস্যা হতে পারে।

খাদ্য ও জলবাহিত রোগ: খরতাপে নদী নালা খালবিলে পানি কমে যায় বা শুকিয়ে যায়। কমে আসা পানিতে জীবাণুর ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় কলেরা, জন্ডিস ইত্যাদি খাদ্য ও জলবাহিত সংক্রমণ বেড়ে যায়। পানির নিরাপত্তায় জোর দিতে হবে। 

আরও পড়ুন >>> উন্নয়ন প্রকল্প কি বায়ু দূষণের কারণ? 

আমরা চাইলেই যেহেতু তাপমাত্রা কমাতে পারছি না, সেহেতু আমাদের প্রতিরোধের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। অতি আবশ্যক না হলে, গরমে বাইরে যাবেন না।

রোদ এড়িয়ে চলুন। ছাতা মাথায় দিন। সকালে ও সন্ধ্যার দিকে প্রয়োজনীয় কাজ করার চেষ্টা করুন। প্রচুর পানি পান করুন। এখন তরমুজের মৌসুম। তরমুজ বা অনুরূপ রসালো ফল খান। নানা ধরনের পানীয় পান করুন।

পাঁচ বছরের নিচে এবং পঁয়ষট্টি বছরের ঊর্ধ্বের ব্যক্তিরা উচ্চতাপে অসুখের বেশি ঝুঁকিতে থাকে; তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। কারও উচ্চ তাপজনিত কোনো অসুস্থতা দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নিন।

গরম থেকে ঠান্ডা জায়গায় স্থানান্তর করুন। ঠান্ডা পানি দিয়ে মাথা, গা, হাত, পা ধুয়ে দিতে হবে, ঠান্ডা ভেজা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা যেতে পারে। তাপানুকুল জায়গায় বা ঠান্ডা জায়গায় বসিয়ে বা শুয়ে রাখুন। হিটস্ট্রোক সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক