‘অস্থির সময়ে স্থির থাকা’ একজন জনসংযোগবিদের প্রধান নীতি হওয়া উচিত।

সারা বিশ্ব আজ এগিয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার চূড়ান্তে। সবকিছুর কেন্দ্রেই থাকছে প্রচারণা। আপনার মাধ্যমে যেমন প্রচারণা হয়ে থাকে তেমনি অন্যের মাধ্যমেও আপনার প্রচারণা হয়ে থাকে। সব প্রচারণা পজিটিভ হয়ে থাকে ব্যাপারটা তেমন না। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন মিডিয়া সকলেই কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। সোশ্যাল মিডিয়া আজ অনেকটা প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া যেকোনো খবরের মাধ্যম হতে পারে কিন্তু ধ্রুব সত্য ভাবার কোনো কারণ নেই। খবরের সূত্র ধরে সত্য-মিথ্যা যাচাই করে প্রচারণা হতে পারে।

আজ সবক্ষেত্রেই অনলাইন মিডিয়ার দৌরাত্ম্য দেখতে পাচ্ছি। যেকোনো ঘটনা ঘটার ক্ষণিকের মধ্যেই খবরের ব্যাপ্তি ঘটতে থাকে অনলাইন আর সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে। আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্রেকিং নিউজের প্রতিযোগিতা। এর কারণে অনেক সময় ভুল তথ্য চলে আসতে পারে জনসাধারণের কাছে। যা ইলেকট্রনিক কিংবা অনলাইন মিডিয়ার কাছে জনগণ প্রত্যাশা করে না।

জনসংযোগ পেশাটাই এমন আপনাকে প্রতিষ্ঠানের সব বিষয়ে কিংবা আপনার প্রতিষ্ঠান যে ধরনের ব্যবসার সাথে জড়িত সেই ব্যবসা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। উদাহরণ হিসেবে- এভিয়েশন সেক্টরের ব্যবসার কথাই উল্লেখ করা হলো- একজন সেলস্ কিংবা মার্কেটিং প্রতিনিধির সেলস অথবা মার্কেটিং বিষয়ক জ্ঞান থাকলেই যথেষ্ট, অ্যাকাউন্টিং কিংবা রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টের কাজের ধরন হিসাব-নিকাশ সংক্রান্ত যেখানে কাজের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, কেবিন ক্রু, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা পাইলট উভয়েরই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষায়িত হতে হবে। আবার অ্যাডমিন কিংবা এইচআর ডিপার্টমেন্টেরও কাজের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য বিভাগ যেমন পারচেজ, ইন-ফ্লাইট সার্ভিস, কাস্টমার সার্ভিস, সিকিউরিটি, ক্লিনিং, ট্রান্সপোর্ট প্রত্যেকেরই নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আলাদা আলাদা দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্টের কাজের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।

যেকোনো ঘটনার তথ্য-উপাত্ত পেতে হলে যে মাধ্যমটি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য, তা হচ্ছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র তথা জনসংযোগ কর্মকর্তা। আজ সারাবিশ্বে সাংবাদিকরা তাদের কলমের মাধ্যমে দেশের তথা বিশ্বের সরকারগুলোর পাশাপাশি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। আর সাংবাদিকদের কলমের শক্তিকে আরো বেগবান করতে সারাবিশ্বে জনসংযোগে যারা কাজ করেন তাদের ভূমিকাই মুখ্য। কোনো কিছুই ওয়ানওয়ে ভাবার কারণ নেই। জনসংযোগ পেশা আর সাংবাদিকতা দু’জনেই দু’জনার উপর নির্ভরশীল।

একটি ভালো সংবাদ একজন সাংবাদিককে পরিচিতি এনে দেয়, খ্যাতি এনে দেয়, পুরস্কারে ভূষিত করে। আর ভালো সংবাদটি পরিবেশনের জন্য যাদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হয়ে উঠে না, তারাই হচ্ছে জনসংযোগ কর্মী কিংবা জনসংযোগবিদ। সেই সব জনসংযোগবিদদের কি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আছে? আমি সমসাময়িককালে দেখার সুযোগ পাইনি। প্রতিষ্ঠানের যত পজিটিভ কাজ আছে, সব কাজের প্রচারণার অগ্রভাগে থাকতে হয় জনসংযোগকর্মীদের। তেমনি প্রতিষ্ঠানের যত নেগেটিভ প্রচারণা থাকে তার সমাধানেও এগিয়ে থাকতে হয় জনসংযোগকর্মীদের।

যাদের জনসংযোগ পেশার কাজের সম্যক ধারণা না থাকে, তাদের অভিব্যক্তি সকল পজিটিভ সংবাদ পরিবেশন হয়ে যায় অটোমেটিক আর নেগেটিভ সংবাদ পরিবেশন হয় জনসংযোগকর্মীর দুর্বলতার কারণে। যা বাস্তবতার সাথে কোনভাবেই যায় না।

প্রত্যেক বছর বিভিন্ন সেক্টরের জনসংযোগবিদদের উৎসাহ দিতে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নতুন নতুন জনসংযোগবিদদের আবির্ভাব ঘটবে। মেধাবী আর মাল্টি ট্যালেন্টেড কর্মী পাওয়ার সুযোগ রয়েছে জনসংযোগে।

২৪ ঘণ্টায় এক দিন। মাঝে মাঝে মনে হয় দিনটি যদি ৩৬ ঘণ্টায় হতো তাহলে ভালোই হতো। জনসংযোগ পেশাটাই ধৈর্যের টেস্ট ম্যাচ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমহারে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া। আর যদি কোনো সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ পেশা হয়ে থাকে তবে তো আপনাকে যেকোনো সময়ে যেকোনো বিষয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করতে হয়। খুব বেশি সচেতনতার সঙ্গে বক্তব্য রাখতে হয়। ভুল বক্তব্য প্রতিষ্ঠানকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। কঠিন সময়ে সাবলীলভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারাই একজন জনসংযোগবিদ যে অন্যদের থেকে আলাদা তাই প্রকাশ করা।

একজন জনসংযোগ কর্মীর প্রয়োজনীয়তা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য সবসময়ই আছে। তবে ভালো সময়ের চেয়ে খারাপ সময়ে জনসংযোগ কর্মীকে খুব বেশি প্রয়োজন বলেই মনে হয়। প্রতিষ্ঠানের যেকোনো খারাপ সময়ে একজন জনসংযোগ কর্মী তার কমিউনিকেশন দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ভালো সময়ের দিকে এগিয়ে নিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে। একজন জনসংযোগবিদ তার সাবলীল উপস্থাপনা দিয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে সকল স্তরের নাগরিকদের নিকট সঠিক বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে তুলে ধরতে পারেন।

প্রয়োজন থাকলেই সংবাদকর্মীদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা আর প্রয়োজন শেষ হলেই সম্পর্ক শেষ এই নীতিতে যারা বিশ্বাস করেন তাদের জন্য জনসংযোগ পেশা নয়। যারা নির্দিষ্ট সময় মেনে জনসংযোগ পেশায় কাজ করতে চান তাদের জন্যও এই পেশা খুব বেশি মানানসই হবে না। কারো সঙ্গে পরিচয় হবে প্রফেশনালি কিন্তু সম্পর্ক তৈরি হবে পারসোনালি। যে সম্পর্কটা থাকবে আজীবন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে লাভবান হবে প্রতিষ্ঠান।

শুধুমাত্র এক্সটার্নাল রিলেশন ভালো রাখতে হবে ব্যাপারটা আসলে তা নয়, আপনার ইন্টার্নাল রিলেশনও অনেক ভালো হতে হবে। ইন্টার্নাল রিলেশন যত বেশি শক্তিশালী হবে আপনি জনসংযোগ কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠানে আপনার ভূমিকা ততো বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। আপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কোনো বার্তা খুব সহজেই মিডিয়ার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন, যা প্রতিষ্ঠানের অন্য কোনো কর্মীর পক্ষে সম্ভব নয়।

ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে বড় মিডিয়া কিংবা ছোট মিডিয়া বলতে কিছু নেই। একজন জনসংযোগ কর্মী হিসেবে আপনাকে সব মিডিয়াই সমান ধারণা পোষণ করতে হবে। কোনো ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনার সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হিসেবে সত্য ঘটনা তুলে ধরাই কাম্য হবে নতুবা ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে নানাবিধ কল্পকাহিনির সম্মুখীন হতে পারেন, যা ব্যবসার সুনাম ক্ষুণ্ন হতে পারে, ভবিষ্যৎ ব্যবসার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।

সত্য সংবাদ প্রকাশে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠান লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রত্যেকটি মিডিয়া হাউজের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এমনকি সংবাদকর্মীদের কমিউনিটি বেজড অনেক প্রতিষ্ঠান থাকে তাদের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। যেমন- জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ক্রাইম রিপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্র্যাব) ইত্যাদি। একজন জনসংযোগ কর্মী হিসেবে সংবাদকর্মীদের মনোভাব অনুধাবন করা জরুরি।

জনসংযোগ কর্মীর কাজ এবং সময়ের কোনো রুটিনমাফিক সীমাবদ্ধতা নেই। সবসময়ই ফ্রি আবার সবসময়ই ব্যস্ত। প্রতি মুহূর্তেই ব্যস্ততার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।

মো. কামরুল ইসলাম ।। মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স