ছবি : সংগৃহীত

‘মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধটা শুরু হয়েছে মুক্তির জন্য। সেই মুক্তিটা কী? সেই মুক্তি দ্বিজাতিতত্ত্বের হাত থেকে বাঙালি জাতিসত্তাকে উদ্ধার করা। সেই মুক্তি সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও তার সাহিত্য-দর্শনকে রক্ষা করে স্বকীয় স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা। সেই মুক্তিটা কী? সেই মুক্তি একটি সমাজ বিপ্লব।’

একাত্তরের প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য—শীর্ষক একটি নিবন্ধে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য এভাবেই তুলে ধরেছিলেন প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন, সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ, সেই মহাসংগ্রামে ওতপ্রোতভাবেই জড়িত ছিলেন আমাদের রাজনীতির বহুল আলোচিত ব্যক্তি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

প্রবাদপ্রতিম এই মানুষকে আমরা যতটা রাজনীতিবিদ, দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান, বাগ্মী এবং আইনপ্রণেতা হিসেবে জানি ঠিক সেভাবে জানি না একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা। আলোচ্য নিবন্ধে মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা অল্পবিস্তর তুলে ধরার চেষ্টা করব।

আরও পড়ুন >> মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত 

১৯৭০ সালে যে প্রেক্ষাপটে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ, সেই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রার্থী হয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঐতিহাসিক সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি।

প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে। বর্ষীয়ান এবং প্রভাবশালী রাজনীতিক, আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী অক্ষয় কুমার দাসের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন কুঁড়েঘর মার্কা নিয়ে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে তৈরি হওয়া অভূতপূর্ব গণজোয়ারের সময়ে তিনি বিজয়ী হয়ে চমক সৃষ্টি করেছিলেন। 

প্রবাদপ্রতিম এই মানুষকে আমরা যতটা রাজনীতিবিদ, দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান, বাগ্মী এবং আইনপ্রণেতা হিসেবে জানি ঠিক সেভাবে জানি না একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা।

মাত্র পঁচিশ বছর বয়সের যুবক সুরঞ্জিত সেই আসনে থামিয়ে দিয়েছিলেন নৌকার জয়যাত্রা। সিলেট-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে আওয়ামী লীগের বাঘা প্রতিদ্বন্দ্বী থাকার পরও তারুণ্যের জোয়ার পরাজয়ের শঙ্কা তৈরি হওয়ায় স্বয়ং বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন দিরাইয়ে। জনসভা করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় প্রার্থীর পরাজয় রোধ করতে পারেননি তিনি।

নির্বাচনের পর দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যেতে থাকে। আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পাকিস্তানিরা শুরু করে টালবাহানা। এর বিরুদ্ধে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু মুক্তিসংগ্রামের ডাক দেন। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। সেই আহ্বানে সাড়া দেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

আরও পড়ুন >>> প্যারী মোহন আদিত্য : অল্পশ্রুত মহান দেশপ্রেমিকের প্রতিকৃতি 

সময়ের প্রয়োজনে মাঠে নামেন তিনি। অগ্নিগর্ভ সময়ে তার নেতৃত্বে দিরাই-শাল্লায় বাঙালিরা হয়ে ওঠে দুর্বার। ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জের রাজপথেও মিছিল মিটিংয়ে নেতৃত্ব দেন সুরঞ্জিত। ১২ সদস্যের যে ‘সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’-এর সুনামগঞ্জ কমিটি গঠিত হয় তার অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।

সংগ্রাম কমিটি বেশকিছু কর্মসূচি গ্রহণ করে। সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। প্রথমে তিনি দিরাই-শাল্লায় মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে পুরো সুনামগঞ্জে বিস্তৃত হয় তার কর্মপ্রবাহ।

সুনামগঞ্জ শহর পাকিস্তানিদের দখলে চলে গেলে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে ভারতে পাড়ি জমান তিনি। ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নিজে নির্বাচিত এমপিএ এবং সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের নেতা হওয়ায় নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন তার পক্ষে সহজতর হয়।

তিনি ভারতে আশ্রয় নেওয়া বিপুল সংখ্যক শরণার্থীরা যেনও সমস্যায় আক্রান্ত না হয় সেই ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যা শরণার্থীদের জীবনপ্রবাহকে অনেকটাই স্বাভাবিক রাখে।        

বিস্তৃত ভাটি অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এক অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গঠিত হয় টেকেরঘাট সাবসেক্টর। এই সাব সেক্টরটি গঠনে তিনি পালন করেন মুখ্য ভূমিকা। তাহিরপুর, জামালগঞ্জ (একাংশ), জগন্নাথপুর (পশ্চিম), দিরাই, শাল্লা, ধর্মপাশা (আংশিক), মধ্যনগর, নবীগঞ্জের উত্তর দিক, বানিয়াচং (আংশিক), কিশোরগঞ্জের নিকলী থানা নিয়ে এই সাবসেক্টর গঠন করা হয়।

আরও পড়ুন >>> ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস 

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকেই নিযুক্ত করা হয় এই সাবসেক্টরের কমান্ডার। মুজিবনগর সরকারের অনুমতিক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্ব পান তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরীর ভাষ্যে আমরা জানতে পারি—‘শিলং-এ অবস্থিত ১০১ কম্যুনিকেশন জোন-এর অধিনায়ক মেজর জেনারেল গুরখস সিং গিলের সাথে শিলংয়ের কোনো এক স্থানে সেনগুপ্ত’র সাক্ষাৎ ঘটে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় টেকেরঘাট সাবসেক্টর প্রতিষ্ঠার। গিল ওয়ারলেস আলাপনে মুজিবনগর সরকারের অনুমতি গ্রহণ করে, তাকে এই দায়িত্ব প্রদান করেন।’

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে সামরিক সহায়তা প্রদানের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর রবীন্দর কুমার, মেজর বাথ, ক্যাপ্টেন ভার্মাকে। তাদের সহায়তায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে ভাটি অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক দুঃসাহসিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

হাওরাঞ্চলের প্রতিকূল পরিবেশে এবং নদীপথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেন এই সাব সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা। বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতির নেতৃত্বে দাস পাটির যোদ্ধারা এই সাব সেক্টরে ঝুঁকিপূর্ণ অনেক অপারেশন পরিচালনা করে পাক হানাদার বাহিনীর কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়।

নিজে ভাটি অঞ্চলের সন্তান হওয়ার কারণে পাকিস্তানিদের বিপাকে ফেলার কৌশলগুলো ভালোভাবেই বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন সুরঞ্জিত। এক্ষেত্রে তার ইংরেজি ভাষায় অনর্গল কথা বলার দক্ষতা খুবই কাজে আসে। কারণ ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অফিসারদের কাছ থেকে পরিকল্পনা জেনে নেওয়া এবং নিজেদের অবস্থান এবং কর্মপন্থা সহজেই তুলে ধরতে পারতেন তিনি।

পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ার কারণে দায়িত্বশীল সেনা কর্মকর্তারাও তাকে গুরুত্ব দিতেন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনকে এই সাবসেক্টরে কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।

১৯৭০ সালে যে প্রেক্ষাপটে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ, সেই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রার্থী হয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত...

দায়িত্বের ভার মুক্ত হয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আবারও সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে আগ্রহী করে তুলতে ভূমিকা রাখেন। সেইসঙ্গে ভারতের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের মনোবল চাঙা রাখতে এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে তিনি ছিলেন সচেষ্ট।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন 

দেশ স্বাধীনতার বন্দরে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত দিনরাত সংগ্রামের মোহনায় ছিলেন সুরঞ্জিত। মৃত্যুভয় কখনো স্বীয় দায়িত্ব পালন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি তাকে। মুক্তিযুদ্ধে কঠিন দায়িত্ব পালনে তিনি যেমন পিছ পা হননি, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ছিলেন অবিচল।     

স্বাধীনতার পর দেশ গঠনে রত হন সুরঞ্জিত। মহকুমা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি গঠন করা হলে স্বভাবতই এই কমিটির অন্যতম সদস্য করা হয় তাকে। দায়িত্ব পালনে তিনি কখনোই তার নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেননি। স্বাধীনতা এবং প্রগতিশীলতার পক্ষেই আজন্ম লড়াই করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন প্রগতির এই পদাতিক।   

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু আমাদের মুক্তির সংগ্রাম শেষ হয়নি। সেই সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে অনেক সময় লাগবে, এটি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন তিনি। তাই মুক্তি প্রসঙ্গে তার উক্তি ছিল, ‘আমার মনে হয় যুদ্ধটা হয়েছে, মুক্তি হয়নি। সুতরাং মুক্তির এই যুদ্ধ চলছে, চলবে। ...এই যুদ্ধকে আমরা ইতিহাসে রেখে যাবো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যারা আরেকটি যুদ্ধ করবে। এই যুদ্ধের চূড়ান্ত রূপ দেবে তারা, আনবে প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ মুক্তি।’

ভাটি বাংলার মানুষের রূপকথার নায়ক, স্বাধীনতার অনন্য এই সেনানীর সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ, যেদিন প্রতিষ্ঠিত হবে সেইদিনই তার স্মৃতির প্রতি, নিবেদন করতে পারব আমরা যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য।

অপূর্ব শর্মা ।। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক